সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে



কবিতাউৎসব মাঘ ১৪২৫

চলতে চলতে পায়ে পায়ে পূর্ণ হয়ে গেল তিন বছর। হঠাৎই শুরু হয়েছিল কবিতাউৎসবের পথ চলা। সেখান থেকে ঘড়ির কাঁটা ধরে নিয়মিত একটানা তিন বছর প্রকাশিত হওয়া খুব একটা কম কথা নয়। যদিও অনলাইনের ওয়েব প্রকাশনা, ছাপাখানা ঘুরে সুদৃশ্য মলাটবন্দি হয়ে আবহমান ধারায় প্রকাশিত পত্রিকা নয়, তবুও। এবং আরও বড়ো কথা প্রকাশের প্রথম বর্ষেই গুগুল পরিসংখ্যান অনুসারে কবিতাউৎসবের পৃষ্ঠাদর্শন এক লক্ষ অতিক্রম করে গিয়েছিল। সংখ্যাটি নেহাৎ অবেহলা করাও মতোও নয়। বিশেষত ওয়েব পত্রের জগতে। এই সবই ঘটেছে কাঁটাতারের বাধা ডিঙিয়ে দুই বাংলার কবি ও পাঠকের সম্মিলিত আগ্রহে। আন্তর্জাতিক মানচিত্রের সীমানা ডিঙিয়ে আবিশ্ব ছড়িয়ে থাকা বাঙালির উৎসাহে ও উদ্দীপনায়। এটাই হয়তো কবিতাউৎসবের মূল অর্জন। সেই অর্জনের পথেই কবিতাউৎসবের মাঘ ১৪২৫ বর্ষশেষ সংখ্যারও আয়োজন।

কবিতাউৎসবের অভিমুখ দুই বাংলার সাহিত্যচর্চার সাথে আবিশ্ব প্রবাসী বাঙালির সাহিত্যচর্চার মেলবন্ধন। কবিতাউৎসবের লক্ষ্য শখের কাব্যচর্চার বিপ্রতীপে কাব্যচর্চার দিগন্তে সাহিত্য ও জীবনকে পরস্পর মেলানো। এবং নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে আবহমান কালচেতনায় বাংলাসাহিত্যের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সামঞ্জস্য সাধন। এই সামঞ্জস্যের মধ্যে দিয়েই নতুন যুগের নতুন বাণীকে খুঁজে নিতে হবে আমাদের। পার করতে হবে একটি শতাব্দী থেকে আরও একটি শতাব্দী। সময়ের সাথে জীবনবীক্ষার সাথে এগিয়ে চলতে হবে নতুন দিনের খোঁজে। তৈরী করে নিতে হবে এমন একটি রাজপথ, যেখানে এসে বাংলার সাহিত্যচর্চার জগত হাত ধরতে পারে সাহিত্যচর্চার বিশ্বজগতের সাথে। বাংলার কাব্যচর্চা যদি শুধুমাত্র বাংলার ও বাঙালির ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদি শুধুমাত্র বঙ্গসংস্কৃতিরই প্রতিফলন মাত্র হয়, এবং সেখানে বিশ্ববাসী কোন রকম পুষ্টিই যদি না পায়, তবে আমাদের সকল প্রয়াসই ব্যর্থ হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে ইংরাজি সাহিত্য, রুশ সাহিত্য ফরাসী সাহিত্য জার্মান সাহিত্য স্প্যানিশ সাহিত্য সংস্কৃত সাহিত্য, কোনটিই কিন্তু কেন দেশকালের সীমানায় আটকিয়ে পড়ে থাকে নি। এইগুলির প্রত্যেকটিই পুষ্ট করেছে পরস্পরের সাহিত্য সমাজকে। সমগ্র বিশ্বসাহিত্যই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এইসকল আঞ্চলিক সাহিত্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাবে। আমরা যখন বাংলা সাহিত্য বা বাংলা কাব্যসাহিত্য নিয়ে চিন্তা করবো, খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সেটাই।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্জগতের সাথে বাংলা সাহিত্যের যে যোগ, বাংলা সাহিত্যের সাথে অন্য কোন দেশের সাহিত্যজগতেরই তেমন সুদৃঢ় যোগ নাই। অর্থাৎ বলতে চাইছি, বাংলা সাহিত্যের উপর আবিশ্ব বিভিন্ন সাহিত্যের যে প্রবল প্রভাব বিদ্যমান, বিশ্বের কোন দেশের সাহিত্যেই বাংলা সাহিত্যের বিশেষ কোন প্রভাব নাই। না, এমন কি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের হিমালসম প্রভাবও বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যে বিশেষভাবে পড়ে নি। আর এইখানেই আটকিয়ে আছে আমাদের বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত। আটকিয়ে আছে মানে এই নয় যে বাংলাসাহিত্যের চলার পথ থেমে গিয়েছে। তা কখনোই নয়। কিন্তু অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে নিজের ভিতরেই। নিজেকে ঘিরেই। আবিশ্ব অন্যান্য দেশকালের সাহিত্যে আমাদের প্রভাব নাই বললেই চলে। এই প্রভাবটুকু থাকা খুব জরুরী। না থাকলে কোন সাহিত্যই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে না। আপন দেশকালের সীমানায় আটকিয়ে থেকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে তার আপন সমৃদ্ধি। আপন শক্তিই।

এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে সম্ভব হবে আপন পরিসীমাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতায় উত্তরণের? অবশ্য চোখের সামনে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু এক আধজন রবীন্দ্রনাথের কাজ নয় এটি। হলে তো রবীন্দ্রপ্রভাবের দ্যূতিতেই আজও আবিশ্ব সাহিত্যজগত পুষ্টি পেতে থাকত বাংলা সাহিত্য থেকেও। সমৃদ্ধ হতো নিরন্তর। কিন্তু তাতো হয় নি আদৌ। অনেকেই বলবেন, রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়ে ছিলেন বলেই না, তাঁর তবু একটি পরিচিতি গড়ে উঠেছিল বিশ্ব সাহিত্যজগতে। অর্থাৎ নোবলে প্রাইজই সেই আলাদীনের আশ্বর্য্য প্রদীপ, যার হাত ধরে একটি দেশের সাহিত্য আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে পরে। আর দুঃখের বিষয় হলো বাংলায় আর কোন সাহিত্যিকের ভাগ্যেই এই শিকে ছেঁড়ে নি। তাঁরা এও বলবেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের নোবেলজয়ী সাহিত্যিকেদের হাত ধরেই তাঁদের সাহিত্যও ছড়িয়ে পড়ে আবিশ্ব। কিন্তু তাও যদি একমাত্র কারণ হতো, তবে তো দান্তে ভলতেয়র শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে টলস্টয় ভিক্টর হুগো গ্যয়েটে দস্তভয়স্কি গোগোল চেখভ এঁদের কারুর সাহিত্যের কোন প্রভাবই তাঁদের দেশকালের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়তো না বিশ্বময়। তাই নয় কি? তাহলে বলা ভালো, না নোবেল প্রাইজ কোন বড়ো বিষয় নয়। শত শত নোবেল প্রাইজ না পাওয়া কবিসাহিত্যিকদেরই ভুবন ব্যাপি প্রভাব রয়ে গিয়েছে আজও। রয়ে গিয়েছে দেশকালরে সীমানা অতিক্রম করেই।

এইখানে অনেকে এও বলবেন, সেটি সম্ভব হয়েছে ইউরোপের দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতির হাত ধরেই। ইংরেজরা বাংলা দখল করে আমাদের আড়াইশো বছর পদানত করে না রাখলে, আমাদের উপর ইংরেজী সাহিত্য তথা ইংরাজি ভাষার দৌলতে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব পড়তে কি এমন সহজে? না পড়তো না নিশ্চয়। বা পড়লেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে ধীরে ধীরে দিনে দিনে কালের স্বাভাবিক নিয়মেই পড়তো নিশ্চয়। কিন্তু এত দ্রুত নয়। এমন অমোঘ ভাবেও নয়। কিন্তু পড়তো তো অবশ্যই। পড়তো আধুনিক বিশ্বের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির হাত ধরেই। ফলে কোন সাহিত্যের প্রভাব সেই দেশের সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতির উপরেই যে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এমনটাও নয় বোধহয়। নয় সেই দেশের কতজন সাহিত্যিক নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন বা পেয়েছেন তার উপরেও।

তাহলে একটি দেশের সাহিত্যের প্রভাব ঠিক কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে প্রভাব বিস্তার করতে পারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহিত্যের উপর? অবশ্যই এমন গুরুত্বপূ্র্ণ একটি বিষয় সাহিত্যের বিশেষজ্ঞদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া সমীচিন। আমরা শুধু বলতে পারি, আমদের খেয়াল রাখতে হবে এই বিষয়গুলির উপর। আমাদের ভাবতে হবে নিরন্তর। ভাবতে হবে, ঢুকতে হবে বিষয়ের গভীরে। আমাদের বুঝতে হবে শখের কাব্যচর্চা সাহিত্য নয়। আমাদের দেখতে হবে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহিত্যের যে প্রভাব রয়েছে আমাদের কাব্যচর্চার দিগন্তে, সেই সেই সাহিত্যের গভীরে ঠিক কি সম্পদ রয়েছে, যা আমাদের এমন অমোঘ টানে টান দেয়? তাঁরা কি কি মৌলিক ধ্যান ধারণা দিগদর্শন দিয়ে যেতে পেরেছেন বিশ্ববাসীকে? সাহিত্যের মধ্যে এই যে মৌলিক দিগদর্শন, এইটিই যে কোন দেশের যে কোন সাহিত্যেরই মূল সম্পদ। এইটি না থাকলে সব সাহিত্যই ফোঁপড়া। নেহাতই শৌখীন মুজদুরি।

দুঃখের বিষয় অনলাইন ভিত্তিক ওয়েব পত্রে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চা মূলত শখের কাব্যচর্চারই প্রসারিত রূপ। শখের দিক দিয়ে এটি অবশ্যই অন্যতন সুন্দর একটি শখ। সেই বিষয়ে কারুরই বলার কিছুই নাই। থাকতে পারে না। কিন্তু কাব্যচর্চার জগতে শখের কবিতা লেখার প্রবণতা নেহাতই সময়ের অপচয় মাত্র। যদিও সেটিও চিন্তার কোন বিষয় নয়। যদি না, সেই শখের কাব্যচর্চাই সাহিত্যচর্চার মাপকাঠি বা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হলে যে কোন ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই সেটি কিন্তু মারাত্মাক। কবিতাউৎসব সেই মারাত্মক প্রভাবের বিপ্রতীপেই কাজ করতে উৎসাহী, প্রত্যাশী। আমরা আমাদের লক্ষ্য ও অভিমুখে কতটা এগোতে পারছি, বা পেরেছি সেটি ভাবীকাল বলবে। কিন্তু আমাদের সাধ্যমত প্রয়াসের যে খামতি নাই, সেইটুকুই আমাদের মূলধন। সেই মূলধনকে সম্বল করেই আগামী ফাল্গুনে চতুর্থ বর্ষে পা রাখতে চলেছে কবিতাউৎসব। কবিতাউৎসবের তৃতীয় বর্ষে আমাদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে আমাদের অগ্রগতির মূল্যায়ন করবেন কবিতাউৎসবের পাঠক। আমাদের আশা আমাদেরকে সঠিক দিশায় এগিয়ে যেতে পাঠকের মতামত যথেষ্ঠই সাহায্য করবে সময় মত। আমরা অপেক্ষায়। কবিতাউৎসবের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে উৎসবের সকল গুণাগ্রাহী বন্ধস্বজন কবি ও পাঠককে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। শৌখিন সাহিত্যচর্চা নয়, সাহিত্য ও জীবনের মেলবন্ধনে কবিতাউৎসবের পাশে থাকুন। কবিতাউৎসব সকল সময় আপনাদের পাশে রয়েছে। কবিতাউৎসব বিশ্বজনীন জীবনের শ্বাশত উদ্বোধন।