সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৯

এ মাসের অতিথি সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়




কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  ১৪২৫

কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়:  শুরুতে কবিতা উৎসবকে বিশেষ ধন্যবাদ। আমার লেখার বয়স খুবই কম। ঠিকভাবে ধরলে একবছরও হয়নি তবে কখনও সখনও লেখা ছেপেছে টুকটাক। ওই আর কি। আসলে কবিতার কাছাকাছি ছিলাম না কোনদিনই। আমার মামা বাড়ির দাদু ছিলেন স্বর্গীয় কবি চন্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়। দাদুর কাছাকাছি থাকলেও কবিতা থেকে সাত হাত দূরে থাকতাম। ভালো লাগত থ্রিলার পড়তে। গোয়েন্দা গল্প ভীষণ প্রিয়। ছোট থেকেই বাবা মায়ের হাত ধরে বইমেলা যাওয়া আর পছন্দের আঁকার গল্পের বই বোঝাই করে বাড়ি ফেরা ছিল প্রতিবছরের রুটিন। এছাড়া স্কুলের ফাইনাল প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে প্রতিবারই মোটামুটি পুরষ্কার হিসাবে মিলত ভালো গল্পের বই। সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ছোটবেলার ছড়া যতটা মন দিয়ে মায়ের কাছে শুনতাম বড় হয়ে কবিতার প্রতি ওই আকর্ষণটা আর ছিল না। গল্প পড়তে ভালো লাগত। তারচেয়েও প্রিয় ছিল ছবি আঁকা, হাতের কাজের নানান জিনিস বানানো, গান করা। কত্থক নাচও শিখেছি পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত। তবে ছোট থেকেই ডায়রী লেখার শখ ছিল প্রবল। তার ভেতর থাকত আমার লুকোচুরির দুনিয়া। একবার সাহস করে দাদুকে পড়িয়েছিলাম সব হাবিজাবি। ওখান থেকেই একটা ছড়া দাদু বেছে নিয়ে সেবছর আসানসোল থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার শারদীয় বিভাগে লেখাটি ছাপলেন।তখন আমার ক্লাস সেভেন। তবে প্রকাশিত কবিতাটির দু তিনটি শব্দ পরিবর্তন করেছিলেন বলে ভীষণ রাগ হয়েছিল সে সময়। তারপর মাঝে মাঝে আসানসোল থেকে প্রকাশিত অতসী পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হত। দাদু মারা যাওয়ার পর সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু ঘটক লেখা পাঠাতেও বলতেন। কিন্তু আমি নিজেই এই ধারাবাহিকতা রাখতে পারিনি পড়াশোনার চাপে। ডায়রীর ভেতরের জগতটাকে কখনও খুলে বসতাম আবার কখনও এমনও গেছে যে বহুদিন খুলেই দেখিনি সে যাই হোক, অনেকপরে হিতাংশুর ( স্বামী) সূত্রে কবি মুনির হোসেনের সংস্পর্শে আসি। তিনি তার ত্রৈমাসিক ট্রৈনিক পত্রিকায় আমার একটি করে লেখা রাখতে শুরু করেন গীত( আমার মেয়ে) হওয়ার সময়টা বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ ছিল প্রায়। এই সময়ই কখন যেন লিখে ফেলতে লাগলাম মনের কথাগুলো। তারপর যখন আনন্দ সুযোগ দিল, তখন ২০১৮, ফেব্রুয়ারী মাস। প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায় কলকাতা বইমেলায়। কবি দীপঙ্কর গোস্বামীর সাথে আলাপ হয় তারপর। ওনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমার খুব কাজে আসে। আপাতত চেষ্টা করছি লেখার। শেখার।  ফেসবুকের কাছে আমি ঋণী। বাড়ি থেকে বের হতে পারি না। তবু অনেক বড় বড় কবিদের সাথে বার্তালাপের সুযোগ পেয়েছি। সাজেশন গুলো মেনে চলার চেষ্টা করি আমার যাত্রাটা শুরু হয়েছে উল্টোদিক থেকে। বই প্রকাশ পেল আগে, তার সাথেই শুরু হল পড়া শেখা। কি জানি কবে ঠিকঠাক একটা লাইন লিখে উঠতে পারব!



কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে মনে হয় আপনার।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: দেখুন আগেই বললাম আমার লেখা খুব বেশিদিন নয়। প্রথম বই, চারদেওয়ালি চুপকথারা (সিগনেট) তবে বইপ্রকাশ আর আজকের মধ্যে পরিবর্তন তো ঘটেছে অবশ্যই। কবিতাকে চেনার চেষ্টা চলছে ভীষণরকম। মনের কথা লেখার ধরনটা এখন খানিকটা পাল্টেছে। আসলে আমার মনে হয়, কবিতা ঋতুদের মত। লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তে তার ধরণ পাল্টায় কৃত্তিবাস, কবিসম্মেলন, এইসময়, একদিন, কবিতা আশ্রমে, আবহমান এবং আরও অনেক ম্যাগাজিন ওয়েব ম্যাগাজিনে ক্রমশ যে লেখাগুলি বেরোচ্ছে তাদের ধরন আগের চেয়ে আলাদা। আসলে লেখাটা একটা অভ্যাস, পড়ার মতই। ভালো রেজাল্ট করতে গেলে যতটা লেবার দিতে হয়, নিজেকে তৈরী করতেও তাই। ঘষা মাজাটা দরকার। খারাপ লাগে একটাই। এই সময়টা আমার খুব কম। আপাতত আমার প্রথম প্রায়োরিটি আমার মেয়ে। তবে শেখাটা থামাব না কখনও। শিখছি, শিখবও আর হুজুগ আছে কিনা জানি না। যারা লিখতে ভালোবাসে তারা ভালোবাসে বলেই লেখে। এবার সেটা কবিতা হল না কবিতা হল না তা বলার আমি কে? আমিও তো শিখছি। তবে হ্যাঁ, হুজুগ দিয়ে একটা দুটো লেখা চালিয়ে দেওয়া যায়, কবিতায় যাপন, হয় না। তার জন্যই সাধনা। প্রচুর পড়তে হয়, জানতে হয়। একটা ক্ষেত্র তৈরী করতে হয় ভাবনায়। তবে সৃষ্টি আরও প্রশস্ত হয়। এসব হুজুগে পাওয়া অসম্ভব  



কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক বিকাশ, কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন এই বিষয়ে।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: অতি মাত্রায় আবেগ কবিতায় কাম্য নয় কখনই। কবি অংশুমান কর একবার বলেছিলেন, ‘ চোখ কান খোলা রাখো আর লেখো।আমিও চেষ্টা করি সেগুলো দেখার। জীবন থেকে কবিতা উঠে আসে। কবিতা মানুষ থেকে উঠে আসে। সকাল থেকে রাত নানা ঘটনা থেকে উঠে আসে। কবি জয় গোস্বামীরএকান্নবর্তীবইটা আমায় খুব টানে। কিভাবে মাটি জল বায়ু ধান গাছ, পাশের বাড়ির বুড়োবুড়ি সবাই কবিতা হয়ে উঠছে তা দেখতে পাই। কবি অংশুমান করের কবিতাও যেন জলজ্ব্যান্ত জীবনচিত্র। ছোট ফ্ল্যাট হোক বা চায়ের কাপ সব কিছুই তার কবিতার চরিত্র। আবেগ তো থাকবে কিন্তু তার লাগাম থাকবে কবির কাছে। রূপকের আড়ালে কতটুকু আবেগ মেশালে সে কবিতা অমরত্ব লাভ করে তার উদারহণ দিয়ে গেছেন বহুকবি। সেসব বই পড়তে হবে। ভীষণ ভাবে পড়তে হবে আর একপ্রিয় কবি সুধীর দত্তের কবিতায় আমি সেই রহস্য খুঁজে পাই। যেন ঈশ্বর দর্শন অথচ তাতে মিশে আছে বাস্তবও। তাকে ধরা খুব কঠিন। কবি তার চারদিকে যেন রচনা করে চলেন অদৃশ্য মায়াজাল। অদ্ভুত শব্দবন্ধের নতুনত্ব এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমার মনে হয় উনি একজন স্বতন্ত্র কবি। অননুকরনীয়। এটা সত্যি শেখার বিষয়। সাধনার বিষয়



কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন। একবিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: আমি আগেও বলেছি সাহিত্য সমুদ্রে আমার সন্তরণ খুব বেশিদিন নয়। তবু যতটুকু পড়েছি,  তাতে মনে হয়েছে সাহিত্যে যদি প্রেম আসে, সম্পর্ক আসে তবে শরীর বা যৌনতাও আসবে খুব স্বাভাবিক নিয়মে।  আমি যদি রবিঠাকুরের গীতবিতান পড়ি, সর্বত্র আমি প্রেম দেখতে পাই। নারী পুরুষের প্রেম। প্রেম থেকে নানান অনুভূতি আসে আরও যেমন বিরহ যন্ত্রণা বা বিচ্ছেদ। এই ভালোবাসা চিরন্তন তাতে কাম শরীর সবকিছু মিশে আসে প্রকৃতির রূপের মতই। জীবনানন্দও এই ধারা থেকে বেরিয়ে এলেও কি যৌনতা থেকে বেরিয়েছেন? শব্দের কৌশলে নারী কি ওঠে আসেনি তার নগ্নতা নিয়ে? এখন প্রশ্ন হল, প্রযুক্ত শব্দ শ্লীল না অশ্লীল? কোনটাকে আমরা শ্লীলতার তকমা দেব কোনটাকে নয়? কবি কবিতা সিংহ গতশতাব্দীর পাঁচের দশকে যখন কবিতায় শিশ্ন শব্দের প্রয়োগ করলেন তা অসম্ভব আলোড়ন সৃষ্টি করল। তবে কি কবিতাটি অশ্লীল হয়ে গেল? কবি যখন লিখতে বসেন তখন কি তিনি আদপে জানেন কোথায় কোন শব্দে তার কবিতাটি কোথায় কিভাবে থামবে? একটা মানুষের চোখ কান হাত পা যেমন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, কবিতারও তাই। একটি স্পষ্ট উচ্চারণ কবিতাটিকে অনেকসময় বলিষ্ঠ করে তোলে। আবার অনেকসময় অন্যএকটি ধারার প্রচলনও ঘটায়। কৃত্তিবাস কবিরাও অনেক স্পষ্টভাবে কবিতায় নিয়ে এলেন যৌনতা। কিছু শব্দ যা অশ্লীল বলে পরিচিত ছিল কি সহজে তারা তাদের বসিয়ে দিলেন কবিতায়। পুরোটাই কবি আমাদের যেভাবে ভাবান। হাংরি আন্দোলন, কিভাবে ভুলে যাবে সাহিত্য? তবে একান্ত ব্যক্তিগত মত, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। একঘেয়ে শব্দের ব্যবহারও মনকে ভারাক্রান্ত করতে পারে। আঁশটে গন্ধ আসতে থাকে, তাই পরিবেশনাও বদলে ফেলতে হয়লেখাটা আগে নিজের, তারপর পাঠকের। নিজের কাছে কম্প্রোমাইজ না করাটাই ভালো। সাহসী লেখা যেন কখনও লেখকের দুর্বলতা না হয়ে ওঠে, অর্থাৎ সেই গন্ডী ভেঙে তিনি বেরোতেই পারছেন না আর, এই বিষয়টাও মাথায় রাখা দরকার



কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: নিজের কথা বলতে পারি, আমি তো রবীন্দ্রনাথ থেকে এখনও বেরোতে পারিনা। কি নেই তার সৃষ্টিতে? কোনটা তার নজর এড়িয়েছে? সমস্ত অনুভূতি নিহিত আছে তার রচনায়। আর প্রেম!  সে তো চিরন্তন সত্য। এখন সময় কাল বিচার করলে অনুভূতি আমাদের একই রয়ে যায় বদলে যায় প্রকাশের ধরণ। জীবনানন্দ সে পথ দেখালেন। জীবন মৃত্যু প্রকৃতি নারী শরীর সবই এল কিন্তু বদলে গেল ভাষা, পরিবেশনা। আর একটু সাহসী হল সাহিত্য। চোখের ভাষা নেমে এল ঠোঁটে। আর নজরুল তো নিজেই রবিঠাকুরকে গুরুদেব মানতেন। কবিতা লেখার পর অনেক কবিতা তাকে পড়ে শোনাতেন। অদ্ভুত ছিল এই গুরুশিষ্য সম্পর্ক। তাদের সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য হয় না। তারা মিশে আছেন সর্বত্র। শুধু তাদের গ্রহণ করার ধরণ বদলেছে। রবি ঠাকুরকে যখন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঘরের ছেলে হিসাবে চিত্রিত করলেন তারআমি তিনিকবিতায় তখন সেটি যেভাবেই গৃহীত হোক না,  পরবর্তীতে এই পরিবর্তন পাঠকদের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল। অদ্ভুত সাহসী এক পদক্ষেপ। এতসব, পরিবর্তন চলবেই। সমাজে প্রচলিত ভাষা কবিতায় উঠে না এলে তার সাথে রিলেট করা সম্ভব হবে কিভাবে! এই বদল স্বাভাবিক বলেই আমার মনে হয়



কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়:  মানুষ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। তাহলে সৃষ্টি বাদ যায় কেন? সমালোচকের ভূমিকা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে অসুবিধাটা অন্য জায়গায়। কিছুদিন আগে কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য এই বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন যে যোগ্য সমাচোলক কি হারিয়ে গেছে।  সর্বত্র শুরু হয় দলাদলি, মুখ চেনাচিনি। আদতে কতটুকু সৎ ভাবে কোন বই বিচার করা হয় সেটিই বর্তমানে ভাবার বিষয়।  তবে, মিডিয়ার দায়িত্ব তো আজকের যুগে অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। মিডিয়া ক্যাপশন তৈরী করে। তবে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা নতুন শিখতে আসা মানুষরা যোগ্য সমালোচক চাইছি যারা শুধু কলকাতার আশেপাশের নয়, দূরবর্তী কবিদের সৃষ্টিও তুলে ধরবেন পাঠক সমাজে। যাতে সাহিত্যের সঠিক মূল্যায়নটুকু হয়



কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: আমি মনে করি, সমাজবদ্ধ জীব বলেই সমাজের প্রতি দায়টা বেড়ে যায়। আগে তো মানুষ, তারপর কবি। কবি সৃষ্টি করেন সমাজ থেকেই। সমাজের ভালো মন্দ সবটা ধরা পড়ে তার রচনায়। তবে শুধু লিখে প্রতিবাদ,করলেই যে সমাজ বদলে যাবে তা তো নয়! অ্যাক্টিভ হতে হবে। যে যেভাবে পারবে। দুটো গরীব বাচ্চাকে বিনা বেতনে শিক্ষাদানটাও সমাজের উপকার।  নিজের বাড়িতে শিশু পরিচারিকা না রাখাটা যেমন প্রতিবাদ তেমন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে  মুখ খোলাটাও প্রতিবাদ। কোন অত্যাচারিত নারীকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলাটাও একটি সামাজিক কাজ। তাই নিজেকে কাজে লাগানোটা খুব প্রয়োজন। তার আগে দরকার নিজেকে জানার। অন্তরের শক্তিকে যাচাই করার। প্রকৃত মানুষ হতে গেলে চরিত্রগঠনও বিশেষ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বিনয়, শ্রদ্ধার অর্থ কখনও হার স্বীকার বা মাথানত করা নয়। সামজকে কিছু দিতে গেলে আগে নিজের সততাটুকুকে যাচাই করা ভীষণ প্রয়োজন।  আর পাশাপাশি যদি আমার লেখা পড়ে একটি মানুষেরও বিবেক জাগ্রত হয়, সেখানেই লাভ। তাই নয় কি?



কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি। না কি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হয়ে রাজনীতির প্রভাব থাকবে না, তা হয় কি? তবে সাহিত্য সৃষ্টিতে সে প্রভাব না থাকাই ভালো। তবুও সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন,আছেন,  চিরকাল থাকবেনও
সেটা একটা ধারা ঠিকই। তবে সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন কবিই বোধগয় বেশিদিন নিজেকে একটা গন্ডীতে বেঁধে রাখতে পারেন নানিজেকে ভাঙাই কবির প্রধান কাজ



কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজআপনিও কি সেই মতে বিশ্বাসী? আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়। একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে আপনার মনে হয়?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: কোন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পক্ষ বা বিপক্ষ বিচার করাটা উচিত নয়। এটুকু বলতে পারি, এর কিছু দিক যেমন ভালো তেমন খারাপও। কবির জীবন এক পোড়া কাঠের মতো। তা প্রকাশ্যে এলে এসটাবলিসন্ট পেলে কোথাও কি তার প্রাপ্তি নয়? আর কবি তো নিজেকে সবসময় ভাঙেন। তবে অর্থ যশ খ্যাতিতে যদি অহং মনুষত্বের আগে আসে তবে সৃষ্টি ব্যাহত হতে বাধ্য। আবার বিনয় মজুমদারের জীবনটা? আমাকে ভীষণ ভাবায়। কিভাবে শুধু নিঃস্বার্থ সৃষ্টি। জীবনানন্দের ত্রিশ থেকে ছত্রিশ বছরে লেখা অসংখ্য কবিতার একটাও ছাপা হয়নি কোথাও। পরিচয়ে প্রথম ছাপে। অথচ তার কবিতা আজও পাঠক সমাজে অধিক পঠিত। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যা? তার ফ্যান সংখ্যার হিসাব কি সত্যিই আছে আজও? অথচ তিনি ছিলেন বাংলা সহিত্যের মহীরুহ। ছাতা। আমি হতভাগ্য যে এমন মানুষকে দেখার সৌভাগ্যটুকুও হল না আর আজকের প্রতিষ্ঠিত কবিরা? তাদের সৃষ্টি কি থেমে আছে? অথচ খ্যাতির শিখরে থাকা এইমানুষগুলো পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়ও



কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব সর্বজনবিদিত। আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি কারা?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: মাধ্যমিকের পর থেকে পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়া। তারপর কেমিস্ট্রি অনার্স পরে এম সি কমপ্লিট করলাম। এতে সিলেবাসে যেটুকু বিদেশী সাহিত্য হতে পারে আমিও ওটুকুই পড়েছি। স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই। আমি তো কৃতজ্ঞ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের কাছে। আবহমান এবছরই একবার অনুবাদ সংখ্যা করল। হিন্দোলদা আমার কাছে লেখা চেয়েছিলেন। সেই প্রথম পড়লাম সিলভিয়া প্লাথ, পাররা, গিন্সবার্গের কিছু লেখা। কবি আফজল আলিও সাজেস্ট করেছিলেন। ভীষন ভাবে নাড়া দিল প্লাথ। সিলভিয়া প্লাথের কবিতা নিয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছা আছে। সেই সংখ্যায়  The Moon And The Yew Tree কবিতাটি অনুবাদ করেছিলাম প্রথম। তবে বিষয়ে আমি আরও একজন মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব তিনি কবি সুধীর দত্ত। এখন পড়ছি। ইন্টারনেটের আমলে এটাই একটা বিরাট সুবিধা অনেককিছু আমরা বাড়িতে বসে পেয়ে যাচ্ছি। ছুটির দিন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোনো একরকম অসম্ভব। হাতের মুঠোয় যা পাই তা পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। এখন অবশ্য রুমির অনুবাদ পড়ছি। বইটি কুবোপাখি থেকে বেরিয়েছে, অগ্নি বসুর লেখা ভালো লাগছে খুব



কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: দেখুন আমি আগেই বলেছি খুব বেশি কিছু বলতে পারব না। অগ্রজরা পারবেন বিষয়ে জানাতে তবে এখন তো বেশ কিছু কাজ হচ্ছে বলেই মনে হয়। তবে টেগর ছাড়াও যে বাংলা সাহিত্য এগজিস্ট করে তার জন্য প্রয়োজন হল অনুবাদ। হয়ত আরও হওয়া উচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। তা হলেও হচ্ছে।  কিছুদিন আগে বারাসাত রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠিত এক নজরুল সন্ধ্যায় গিয়ে দেখলাম এতদিন পর নজরুল নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে। নজরুলের গান কবিতার ইংরাজী অনুবাদ বাংলা বাংলাদেশের যৌথপ্রয়াসে আরম্ভ হয়ে গেছে। দেরীতে হলেও আশাবাদী যে এই বাংলাসাহিত্য নিয়ে আরও কাজ হবে   



কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: পুরষ্কার পেতে কার না ভালো লাগে। পুরষ্কার অবশ্যই প্রেরণা যোগায়। তবে এটাও ঠিক পুরষ্কারই শেষ কথা হতে পারে না। কিংবা কোন কবির মূল্যায়নও নয়। তাই যদি হবে তবে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় কি এতদিনে এমনই এক অসাধারণ সৃষ্টি করলেন যা আগে কোনদিন করেননি? কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়?  তিনি কি জ্ঞানপিঠ পাওয়ার যোগ্য নন? তার কারনে কোনভাবে কি তাদের সৃষ্টি বিঘ্নিত হয়েছে? প্রকৃত কবি বা লেখক ঘুমের ভেতরও বুনে চলেন বলে আমার মনে হয়  



কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী আপনি?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: সাহিত্য নিজেই একটি ঐতিহ্য। যদি ভাষার কথা বলেন তো, বলব, ভাষা পরিবর্তিত হবেই। সময়কাল অনুসারে ভাষার এই পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যে স্থান পাবে। সহজ থেকে সহজ ভাষা সহজভাবে জায়গা নেবে পাঠকের মনেও। হাসতে হাসতে প্রতিবাদ আবার কেঁদেও ফেলা। যত সহজভাবে উপস্থাপিত হবে শৈল্পিক ভঙ্গিমায়, পাঠক হয়ে অতি সহজেই রিলেট করা যাবে তার সাথে। সেখানে নিজেদের মত করে ভাবার একটা জায়গা তৈরী হয় খুব সহজে। আর কাকে কি বলি, আমি তো নিজেই শিখছি এখন। ভালো বই পড়তে হবে। লেখকের কাজই হল পড়া। একটা লেখাই আর একটা লেখার জন্ম দেয়। পড়ার অভ্যাসটা তৈরী করা খুব প্রয়োজন
               


কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন। অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের বিষয়ে যদি বলেন।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: বাজারমূল্য কথাটা শুনতে খারাপ লাগে। তবে বাজারমূল্য কিন্তু কোন কিছুর সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। অনেক প্রত্যন্ত কবি আছেন যাদের বাজার চেনেই না। তাদের মৃত্যুর পর তাদের নিয়ে কাজ হয়েছে। আবার এমন অনেক কবি যাদের বই বাজারে চলেনি তবু তারা নিঃসন্দেহে ভালো কবি। প্রচারের আলো পেলে জনপ্রিয়তা বাড়ে এটাই স্বাভাবিক। আর তাতে বাজারমূল্যও বাড়তে থাকে খানিক। আর আমরা সাধারণত আলো দেখেই ছুটে মরি। তাই নয় কি?



কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে জানতে চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলার স্পর্ধা আমার নেই সাহিত্য আমাদের ঐতিহ্য আমাদের গর্ব। আর ঐতিহ্য তো এত সহজে ভেঙে যেতে পারে না। প্রতিভা বাংলায় জন্মেছে বরাবর, জন্মাবেও।সৃষ্টিও হবে কিন্তু আমার ভয়টা অন্যদিকে হয় যে মাত্রায় আমরা বাংলা ভাষা বিরোধী হয়ে উঠছি, বাংলা পড়তে বলতে বললেই নাক সিঁটকাচ্ছি, তাতে আদৌও নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে ভালোবাসবে তো?
এই অবস্থাটা বদলানো দরকার আগে। বাংলা মিডিয়ামে পড়ে যদি বাংলা, ইংরাজী, সংস্কৃত ( আমরা পড়েছি ফ্রেঞ্চ) এগুলো শেখা যায়, তবে বাড়ির বড়দের বুঝতে হবে ইংরাজী, হিন্দীর পাশাপাশি বাংলাটাও শেখা যায়। শুধু ইচ্ছাটা তৈরী করতে হবে ছোট থেকেই। আর দায়িত্ব বাড়ির গার্জেনদের  



সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়:  কম্পিউটার অ্যাপ্লিপেশনে মাস্টার্স করলেও নিজেকে চাকরীর ঘেরাটোপে রাখতে চাননি। শৈল্পিক সত্ত্বায় নিজের ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে বেঁচে থাকতে আগ্রহী চিরকাল। প্রথম কবিতার বই চারদেওয়ালি চুপকথারা প্রকাশিত হয় সিগনেট প্রেস, ২০১৮ তারপর থেকে আজ অবধি সই, কৃত্তিবাস, কবিসম্মেলন, কবিতা আশ্রম, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, বিনিউস, একদিন, এইসময়, আবহমান, মাসিক কবিতাপত্র, বহমান সহ আরও অন্যান্য মাগাজিন প্রচুর ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে জন্ম ২০ শে সেপ্টেম্বর। চন্দননগর নিবাসী ছিলেন। বর্তমানে বারাসাতে থাকেন তার স্বামী একমাত্র কন্যার সাথে