সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৯

গোপাল চন্দ্র সাহা


গোপাল চন্দ্র সাহা

নীল  রঙ্গের  কেশর

সদ্য ষোল পেরিয়ে এসে ষোড়শীর কুসুম বুক
যখন কুড়িয়ে নিচ্ছে থোকাথোকা বসন্ত ফুল, কিংশুক
তখন হৃদিপাড়ে নেমে আসে অসীমান্ত শপানবেশ
ভেসে ওঠে কিশোর রোদ ওর মরমী গাঙে

ষোড়শীর রেণুরেণু সময় তখন ঝড়ে যেত কিশোর বুকে
আর ভেঙে যেত আকাশ নদীর সীমান্তে এসে
রাতের নিভৃত চিহ্ন নিয়ে জ্বলে উঠত অজস্র তারাও
#

দেখে নিও কোন এক পূর্ণ-বিকেল ভেসে যাবে
বিসমিল্লার মূর্ছনায় : স্বর ভাঙে কিশোরী স্বরে

তবু বাজেনি সেদিন কোন সানাই, কোনও করুন সুরে
ক্ষুধিত বাতাস যেদিন টেনে দিল দাগ সেই বসন্তে
: ক্ষুধার হরফে যন্ত্রণার
ভেসে এল ভেলা ষোড়শীর যৌবনে ভিনদেশের
যেখানে আজান রেখে আসে পথের শেষ, অশেষ যোজনে

ঘুন ধরা পূর্ণিমা নেমে এল হৃদিপাড়ে অনুজ্জ্বল শ্রান্ত ব্যবধান টেনে
#

নিয়নের নীচে এখনও জেগে আছে রাত্রিশহর
জ্যোৎস্নার উন্মত্ত প্রহরে
আর পুড়ে যাচ্ছে ছায়াদের সুদেষ্ণাবেশ, দংশিত সুখের নগ্নতায়
সেখানে নিস্তব্ধে খুলে যাচ্ছে দেহ পল্লব অর্থের কর্ষণে

তবু  দহনেও তো বেঁচে থাকে কিছু অদগ্ধ স্বপ্ন
তৃষ্ণার অন্তরিন লাজে
সেই কিশোরী যেমন অশ্রু জলের বিদ্রুপেও খুঁজে চলেছে সংসার !
#

যে নষ্ট ক্ষত চেপে আছে কিশোরী বুক, ক্ষুধার বিনিময়ে তিলে তিলে
এপারে জমে ওঠে সেই দাগ,  ক্লান্ত-নীল
ধিমা আঁচে আমার হৃদের কেশর রং ধূয়ে   ।।








ফরমালিন

উঁকি দিচ্ছি যেখান থেকে একটি অন্ধকারময়-আলোর সাকিনে
সেখানে নির্লিপ্ত -  মানুষিক ক্রন্দনের উদ্দাম ছন্দ
এই বিস্ফার অন্ধকারে 'বিলু ডোম'  সেঁকে নিচ্ছে নিজেরই অদৃষ্ট

আত্মজের আত্মযন্ত্রণায় ভেসে যাচ্ছে রিক্ত তোরণ -   মৃত্যুর ঈশানকোণে
তখন ওই আনন্দ ঠাকুর মন্দির চুড়া হতে নামিয়ে আনে বন্ধ্যা নদী
বিলুর বুকে লালিত ব্যথার আলপথ ধরে

নদী-ভাটে ভোরের হাওয়ায় শুকিয়ে আসে রাত
পরে থাকে বাসি ফুল, আঁশটে শরীরী গন্ধ
আঁধারের তপস্যায় মগ্ন আগুনের ফুলকি-চিহ্নরা এখন অনূদিত অঙ্গারবিষাদ

খোঁজ্ খোঁজ্ সেই নিখোঁজ দৈত্য, যে চিরাগ ছেড়ে আশ্রিত ধনীর আস্তিনে
স্তব্ধ-শৈলির আয়োজনে হেমলক বিষ টানে

লালমাটির লালিত্যে মরু কাঁটার খসখসে ছায়ায়
নোনা ভাতের দু'টি দানার তল্লাশে
ক্ষুধার আকাশে প্রবৃত্তিরা দিচ্ছে হামাগুড়ি, চৌকির চারপায়ে

সময়ের নিরিখ মেপে নিচ্ছে দূরত্ব, মৃত্যুর অবধি, ক্ষণিক প্রহর ক্ষরণে

বিলু ডোমের ইতস্ততঃ প্রলাপ নিশ্চিহ্ন, আশা-হতাশার প্রলয়সঙ্গমে
শুধু বেঁচে আছে অভিমান সন্তানের ক্ষুধার্ত নাভিফুলে
অঙ্গাঙ্গি, স্মৃতির ফরমালিন গন্ধে   ।।







কবিতার  স্বৈর  দেহ

তারপর চেয়েছিলাম একটি গান বাঁধতে -
নিজস্ব দর্শনের নিজস্ব বর্ণে, মন্বন্তরে মগ্ন শহরের নগ্ন স্বরে

ফেনিলোচ্ছল নিশিরোদে ঝিকিমিকি বালির আঁচ
সেদ্ধ হতে হতে বেঁধেছি একটি রাত, ঝুমুর গানের মৌতাত -
আকন্ঠ মৌন আঁচে রক্তের মধু ঢেলে, মরমের শ্রমে

প্রেম-ক্ষোভ-বেদনা ?  সেওতো হৃদয়ের রাজসিক শ্রম
শ্বসনের সপ্তপদী বাতাস আর ভাষার তিতলি রঙ

সেদিনের সেই দৈন্য ঐহিক ছিল ললাট সান্নিধ্যে
পোড়া মৃত্তিকায় ঢেকেছিল তিলকের রাজপথ,
তবু আমার ধূসর-সিক্ত কাল ছিল সম্পৃক্ত :
অপার্থিব চৈতন্যের অনিন্দ্য প্রহরে

শিউলির সাবেকী আলপনা মুছে শুধু প্রেমিক গন্ধের সংস্লেষে
জন্ম দিলাম অনুভূতির অনন্য আবহ, অর্বাচীন অন্ত্যমিলে  
::
এই দ্যাখ, একটি মন্বন্তর-শরীর খুবলে খাচ্ছে
কবিতার স্বৈর দেহ ।।






কাঁটাতার

নখর কার্নিশ বেয়ে নেমে প্রত্যহিক খুঁটিনাটি
ভিজে ওঠে ক্ষুধার লালায়
চক্ষু মেলে দিব্যজ্ঞান রোমের রোমন্থিত যন্ত্রণায়

এই যে সমবেত দিব্যজ্ঞানে অসহ বহ্নির দহন -
পুড়িয়ে দিচ্ছে ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীয় সমীকরন

শুনতে পাচ্ছ ! .......না শোনার মত করেও -
ভোরের মাস্তুলে পেরিয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার ক্রন্দন
যদিও সে পরদেশী কোন হৃদয়ের আবাসিক
অথবা রোহিঙ্গার পায়ে বেষ্টিত ধূলোর চিকচিক

ওপার চাঁদে মুদ্রিত অনধিকার অনুপ্রবেশ
মান্দাস-আশ্রিত এপার জলে ফেলছে নোনার আবেশ !

দলে দলে উদ্বাস্তু শৈবালের জীবনী আরোহণ
এখন বিধ্বস্ত কাঁটাতারে করছে সপ্তর্ষি লেহন, কালশিটে-তেরাত্তি ধারায় !

পুড়ছে পারাপার- এপার ওপার, রাষ্ট্রীয় কলার সমাবৃত্তে
জমছে দগ্ধ-বাগধারা উজবুক আবাল-যৌবন-বৃদ্ধে  ।।







দুটি সমান্তরাল উপকণ্ঠ

নেমে আসে স্রবন্তী রাতের জ্যোৎস্নীল অবয়ব
দীর্ঘ আঁধার-সম্পৃক্ত পথ বেয়ে
যেখানে সুপ্ত আলোক গর্ভে নিষিক্ত হচ্ছে বাসনা
হৃদয়ের টিমটিম আলোর প্রসূতি যন্ত্রণায়,
কিশোরীর দেহে তখন অন্তরঙ্গ সদ্য উষসী-যৌবন

হৈমন্তীর স্নেহে লেগে থাকা শরৎ-আঘ্রাণ
আর গন্ধবহের মিলনে নিস্তব্ধ-শীৎকার  -
তিরতির করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে কিশোরী বুক

অথচ আবেগের প্রথম কনায় আলোড়িত
সেই যুবকের অন্তরস্থ পৌরুষ আকাশ, আহত
নাবালক আলোর নশ্বর প্রত্যয়ে, আলিঙ্গন নিস্পৃহে

পশ্চিম কোনের ইঙ্গিতে এগিয়ে আসে ক্লিষ্ট দিন
কিশোরীর দীর্ঘতর নিশ্বাসে, নিষ্প্রভ মমতায়
পড়ে থাকে অনাবশ্যক একটি অনুসৃত বিকেল
দ্বৈত যৌবনে

তখন ভেসে যাচ্ছে দুটি উপন্যাসের হৃদয়াবেশ
বিচ্ছিন্ন যুক্তবেণির সমান্তরাল উপকণ্ঠে  ।।







মূ হু র্ত

তুমি ক্ষনিকের কাছে দাঁড়াও যেখানে রেখেছি
আত্মজীবনী, থেমে যেতে সবুজ সভ্যতা, মূহুর্ত
হলদে হাওয়া জুড়ে যাওয়ার একটু কাল আগে

অযাচ্য অনুরোধে জমে ওঠে বিন্দুবিন্দু আসক্তি
নীরব-আর্দ্র আদিগন্তে
মরফিন নেশার মত লালিত্যে,   প্রহেলিকাময়

উপায় কি ছিল না রেখে দিতে অর্ঘ্য-উপরোধ
অস্তিত্বের অন্তর-বিমূর্ত রংয়ে
যেখানে একই মোহনায় সুখ দুঃখ আনন্দ ভাসে !

গুঁড়িয়ে যাচ্ছে মূহুর্ত সাজ, ক্রন্দসী ধূলোর নীচে
তবুও একরোখা আবেগ,
জানি, ফিরতি পায়ের পাতায় দুর্গম্য ছাপ থাকে

'মূহুর্ত' পর্বে ফেলে আসা অক্ষর বিমুগ্ধ হয়ে ওঠে
কোন এক অতীত ঠিকানায়
হয়তোবা ছলছল গুপ্তবাসে হারিয়ে যায় সামীপ্য

' সময়, নখর ক্ষত নিয়েও দুর্বল তৃণের বিদ্ধ বুক
শুধু আকাশ আকাশ খেলে
তখন ঢেকে যাচ্ছে সৌর-হেম রিক্ত হাসির হলদে ছায়ায়  ।।