রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে




২৫শে বৈশাখ

যে জাতির একটি ২৫শে বৈশাখ থাকে সেই জাতিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। মানে হওয়ার কথা নয়। ইউরোপ আমেরিকা চীন জাপান কোরিয়া প্রভৃতি প্রথম বিশ্বের দেশ মহাদেশে যে কোন জাতির যদি একটি করে ২৫শে বৈশাখ থাকতো, তবে তারা যে শুধু নিজেরাই আলোকিত হয়ে উঠতো তাই নয়, বাকি বিশ্বকেও আলোকিত করে তুলতো। একটি ২৫শে বৈশাখের এমনই বিপুল অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা। অথচ দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের একটি ২৫শে বৈশাখ থাকতেও আজ আমরা ছন্নছাড়া। শক্তিহীন। আমরা আজও একটি জাতি হয়ে উঠতে পারি নি। আমরা আজও নিজের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারি নি। জাতীয়তার উন্মেষ ছাড়া কোন জাতি উন্নত হতে পারে না। সমগ্র জাতির উন্নতি ছাড়া কোন জাতি বিশ্বকে নতুন দিনের পথ দেখাতে পারে না। পারা অসম্ভব। এই শর্তগুলি পুরণ করেই প্রথম বিশ্বের জাতিগুলি সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, দিতে পারছে। কিন্তু তাদের একটি ২৫শে বৈশাখ নাই। থাকলে তারা শুধু নিজেরাই উন্নত হয়ে উঠতো না। গোটা বিশ্বকেই উন্নত করে তুলতে পারতোআজকের উন্নত জাতিগুলি, জাতীয়তার উন্মেষের পথ ধরে আত্নোন্নতি করলেও, সেই উন্নতি আত্মকেন্দ্রিকতা সর্বস্ব। আর সেই কারণেই আজকের বিশ্ব সবল ও দুর্বলে বিভক্ত। কিন্তু ২৫শে বৈশাখের মূল তাৎপর্য এইখানেই যে, ২৫শে বৈশাখ সংকীর্ণ জাতীয়তার উর্দ্ধে উঠে সমগ্র বিশ্বের সামগ্রিক ও সার্বিক উন্নতির পথ দেখাতে পারে। সেই আলোকবর্তিকা রয়েছে ২৫শে বৈশাখের ভিতর।

কিন্তু যে জাতি নিজের ভিতরই জাতীয়তার উন্মেষ ঘটাতে পারেনি, সেই জাতির ২৫শে বৈশাখ থাকলেও তার কার্যকরীতা শূন্য। নিজে উন্নত না হলে, নিজে সম্পূর্ণ না হলে, নিজে শক্তিশালী না হলে, নিজে প্রাপ্তবয়স্ক না হলে বাকিদের টেনে তোলা যায় না। এ প্রকৃতির নিয়ম। বাঙালি আজও তাই চিরদুস্থ চিররুগ্ন দূর্বল ও ছন্নাছাড়া একটি জাতিগোষ্ঠী মাত্র। যে জাতি আজও খুঁজে পায়নি তার নিজস্ব আত্মপরিচয়। অথচ তার হাতে রয়েছে একটি মহার্ঘ্য ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। একটি ২৫শে বৈশাখ। 

বাঙালি আজও তাই একটি সম্পূর্ণ জাতি হয়ে উঠতে পারে নি। সে হিন্দু হয়ে বসে আছে। সে মুসলিম হয়ে বসে আছে। সে ভারতীয় হয়ে গিয়েছে। সে বাংলাদেশী হয়ে গিয়েছে। সে বিভিন্ন উন্নত দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বৈদেশিক নাগরিকত্ব অর্জনের আত্মশ্লাঘায়। তার বাংলাকেই সে অখণ্ড রাখতে পারে নি। তার জন্মভুমি আজ টুকরো টুকরো হয়ে ছিন্নভিন্ন। যে অখণ্ড জনপদে বাঙালির বাসভুমি, সেই জনপদের অনেকটা অংশই আজ বিহারে, ঝাড়খণ্ডে ও আসামে ঢুকে গিয়েছে। বাকি অংশটুকুও কাঁটাতারে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বিদেশী সেজে নিশ্চিন্ত! ভুখণ্ড গিয়েছে। নিজের ভাষার উপর আত্মনির্ভরতা গড়ে ওঠেনি আজও। হিন্দী ইংরেজী আরবী উর্দ্দু না জানলে বাঙালি নিজেকে শিক্ষিত ভাবতে পারে না। অর্থনৈতিক ভাবে অধিকতর শক্তিশালী জাতির সংস্কৃতি নকল করতে না পারলে, বাঙালি নিজেকে আধুনিক ও উন্নত ভাবতে পারে না। এখানেই বাঙালির অভিনবত্ব। ও মূল বৈশিষ্টি। অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় এহেন পরনির্ভর একটি জাতির ২৫শে বৈশাখ আছে। সম্ভবত এটাই বিশ্বের সর্বত্তম আশ্চর্য্য!

তাই ভাবতে দুঃখ হয়, আমাদের হাতে ২৫শে বৈশাখ থাকা সত্তেও সেই উত্তরাধিকারের সীমাহীন গুরুত্ব ও অসীম মূল্য সম্বন্ধে আমাদের কোন সচেতনতা গড়ে ওঠে নি আজও। আসলে জাতি হিসাবে আমরা চির নাবালকঅপ্রাপ্তবয়স্কই রয়ে গিয়েছি। শিশুর যেমন কোন ণত্ব ষত্ব জ্ঞান থাকে না, কোনটা অমূল্য ও কোনটা মূল্যহীন; কোন পথে উন্নতি আর কোন পথে অবনতি; আমাদের দশাও ঠিক সেই রকম। তাই অভিভাবকত্বহীন নাবালকের মতোই আমাদের বর্তমান অবস্থা। ২৫শে বৈশাখ থাকা সত্তেও আমরা দিশাহীন ভাবে ছন্নছাড়া হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে শক্তিহীন ভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। আর অন্যের গোলামির ভিতরেই আত্মপ্রসাদ লাভ করছি নিরন্তর। এবং যতটা পারছি, নিজেদর মধ্যেই বিভেদ বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতার চর্চা করে চলেছি। এটাই বাঙালির স্বধর্ম। নিখাদ বাঙালিত্ব।

জানি অনেকেই প্রতিবাদ করে উঠবেন। বলবেন, কে বলল আমরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করি নি? না, ২৫শে বৈশাখ মানেই শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়। কিংবা রবিপুজো করা নয়। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই ২৫শে বৈশাখ। কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি, ২৫শে বৈশাখ একটি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। ২৫শে বৈশাখ একটা বিপুল শক্তি। অসীম সম্ভাবনা। ২৫শে বৈশাখ একটি উন্নত ও সার্বিক সংস্কৃতি। একটি পরিপূর্ণ দর্শন। একটি ঐশ্বর্য্যময় ঐতিহ্য। একটি অনন্ত উত্তরাধিকার। না বন্ধু, বাঙালি সেই ২৫শে বৈশাখে পৌঁছাতে পারে নি কোনদিন। বাঙালির ২৫শে বৈশাখ ব্যক্তি রবিঠাকুরকে কেন্দ্র করেই আবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছে আজও। বাঙালি জানে, রবি ঠাকুর একটি ভালো ইনভেস্টমেন্ট। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে দুই পয়সা উপার্জনের রাস্তা খুলে যায় সহজেই। রবীন্দ্রনাথ পড়িয়ে সরকারি মাস মাহিনায় অন্ন বস্ত্র বাসস্থানজনিত সমস্যার সুস্থ সমাধান সহজ। রবীন্দ্রনাথ ধুয়ে সিনেমা থিয়েটার নৃত্যগীতে সামাজিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জনও খুব কঠিন কাজ নয়। তাই বাঙালির রবীন্দ্রনাথ লাগেই। বস্তুত আজকের রবীন্দ্রনাথ, বাঙালির জীবনে একটি অর্থকরী দিক মাত্র। তার বেশি কিছু নয় মূলত। সেই অর্থকরী কর্মকাণ্ডের সাথেই যাঁদের স্বার্থ জড়িত, তাঁদের কাছেই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার যোগ্য। বাকিদের কাছে তিনি অপ্রাসঙ্গিক।

আর এরই বাইরে পড়ে থাকে আসল ২৫শে বৈশাখ। যেখানে কবি তাঁর মৃতদেহ নিয়ে আজও নিঃসঙ্গ। আজও অসহায়। কি ভেবেছিলেন, আর কি ঘটল। কি চেয়েছিলেন আর কি হলো। আজীবন একটা গোটা জাতিকে মানুষ করার সাধনা করে গিয়েও, সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার যে অসীম যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার যে বেদনা, তা জানতেন শুধু এই মানুষটি। সেই ব্যর্থতার বেদনা বুকে নিয়েই লিখেছিলেন সেই আমোঘ সত্য। ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি’।  তিরিশের দশকে সাহিত্যিক যাযাবরের একটি প্রশ্নের জবাবে কবিকে বলতে হয়েছিল, সেই সময় যদি লিখতে বসতেন, তবে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ লিখতে গেলে সার্থক কথাটি কেটে দিতেন। এই একটি বাক্যেই জাতি হিসাবে বাঙালির ২৫শে বৈশাখের প্রকৃত অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

না একটি জাতি হিসাবে বাঙালি আজও রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করে নি। করলে সে আর যাই হোক, হিন্দু বাঙালি হতো না। মুসলিম বাঙালি হতো না। ভারতীয় বাঙালি হতো না। বাংলাদেশী বাঙালি হতো না। সে অখণ্ড বাংলার বাঙালি হয়ে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতো। নিজ জন্মভূমিকে টুকরো টুকরো হতে দিত না। নিজের ভাষাকে ছেড়ে অন্য কারুর ভাষার উপর নির্ভরশীল হতো না। আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে অগ্রাহ্য করে পরজাতির সংস্কৃতিকে নকল করতে ছুটতো না। সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ সক্ষম ও উন্নত একটি জাতি হিসাবেই বিশ্বকে আপন করে নিয়ে অন্যান্য জাতিসমূহকে বিশ্বমানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলার সাধনায় মগ্ন হতো। এই যে সংস্কৃতি ও বোধ, এই যে সাধনা, এই সেই ২৫শে বৈশাখ, যে ২৫শে বৈশাখ যে কোন জাতির জীবনেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

তাই ২৫শে বৈশাখ কোন বিশেষ দিন নয়। ২৫শে বৈশাখ একটি দর্শন। একটি ঐতিহ্য। একটি উত্তরাধিকার। একটি অর্জন। এক বিপুল সম্ভাবনা। এক অসীম শক্তি। এবং এক অনুপম সত্য। সেই সত্যকে স্মরণে রেখেই কবিতাউৎসবের এবারের বৈশাখী আয়োজনে আমাদের এই ২৫শে বৈশাখ সংকলন।