শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২০

সম্পাদকের কলমে

 


 

সম্পাদকের কলমে

এটা ঠিক ইনটারনেটের হাত ধরে বাংলায় কবিতার উৎপাদন অনেক বেড়ে গিয়েছে। উৎপাদন বলতেই আমাদের মনে হয় চাহিদা ও যোগানের কথা। চাহিদা ও যোগানের ভিতরে সেতুবন্ধনের কাজটিই করে উৎপাদন। জানি আমরা। কিন্তু কবিতাকে সেইরকম কোন উৎপাদন সামগ্রী বলা যায় কি? সত্যিই কি কবিতার এমন কোন চাহিদা রয়েছে, যে ঠিকমত কবিতার যোগান নিশ্চিত করার জন্য সাহিত্যসমাজ উদগ্রীব হয়ে থাকে? না মনে হয়। কবিতা এমন একটি সামগ্রী। এমন একটি অদ্ভুত সামগ্রী, যার চাহিদা ছাড়াই প্রভুত উৎপাদন হয়ে চলেছে। উৎপাদন কথাটি বলতেই হচ্ছে দুটি কারণে। এক চাহিদা অতিরিক্ত যোগানের দিকে তাকিয়ে। এটি পরিমাণগত কারণ। আর, অধিকাংশ কবিতার সাহিত্যিক উৎকর্ষতা এত কম, যে কবিতা বলে মনে করাই কষ্টকর। কবিতার আকারে লেখা অথচ কবিতা নয়। অর্থাৎ কবিতা লেখার চেষ্টা করলেও যা কবিতা হয়ে উঠতে অক্ষম। সেই প্রয়াসকে উৎপাদন বলা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে। এই বিপুল উৎপাদনের ভিতরে কবিতা খুঁজে বের করা সত্যিই দুরূহ।


এই এক দুঃখজনক পরিস্থিতি আমাদের সমাজে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত বিপুল উৎপাদন অথচ তার অধিকাংশই কবিতা হয়ে উঠতে পারছে না কেন? লেখকের চেষ্টা রয়েছে। উৎসাহ উদ্দীপনা প্রচুর। পরিশ্রমেরও অভাব নাই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেকেই আছেন, যারা প্রতিদিন কবিতা লেখাটি দৈনন্দিন কাজের সামগ্রী করে তুলেছেন। এটা হয়েছে মূলত ফেসবুকের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণেই। কিন্তু সেই প্রয়াসেও কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে কম। যা হচ্ছে তা হলো কবিতার আকারে কিছু শব্দ ও বাক্যসমষ্টির বিপুল উৎপাদন। সেই বাক্যসমষ্টির ভিতরে অবশ্যই কিছু কথা আছে। বক্তব্য আছে। কাহিনী রয়েছে। বিশ্লেষণও রয়েছে। ছবি ও গান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কবিতা নাই। কবিতা লেখার চেষ্টা থাকলেও কবিতা কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে যৎসামান্য। অথচ প্রতিদিন শত শত ওয়েব জার্নালে এবং ফেসবুকের কোটি কোটি ওয়ালে আছড়ে পড়ছে কবিতার সুনামি। কিন্তু কবিতা নয়।


এর একটা কারণ হতে পারে সংযোগহীনতার সমস্যা। আরও অনেক কারণ নিশ্চয় রয়েছে। কিন্তু কবিতা লেখার প্রয়াস থাকলেও কবিতা না হয়ে ওঠার পিছনে সংযোগহীনতার সমস্যা একটা বড়ো কারণ। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় বর্তমানে আমাদের জীবনযাপন প্রণালী দিনকে দিন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে বড্ড বেশি করে। আগে একান্নবর্তী পরিবারের যুগে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বৃহৎ পরিবার আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের একটা সরাসরি সংযোগ ছিল সজীব। বর্তমানের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক পাঠামোয়, সেই সংযোগটি বলতে গেলে প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে। পেশা ও জীবনযাপনের মাঝে সমাজের সাথে সজীব কোন সংযোগের প্রশস্ত পথ আজ আর খোলা নাই। লক্ষ্য করে দেখতে হবে, সেই পথটি খোলা নাই বলেই আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এমন দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আমরা মনে করছি, দিনের একটা বড়ো অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ রেখে বসে থাকলেই বুঝি সমাজের সাথে সরাসরি সংযোগের কাজ হবে। হচ্ছে। কিন্তু না, সেটা সম্ভব নয় কোনভাবেই। উল্টে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দপটে নিজের বাড়িতেই স্বামী-স্ত্রী পুত্রকন্যা ভাইবোন বাবা-মা। সকলের সাথেই আর একটা পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টির পথ খুলে যাচ্ছে।


একটু খেয়াল করে দেখলেই দেখতে পাবো। আমাদের ব্যক্তি জীবনের পরতে পরতে, আমাদের চারপাশের জীবনের সাথে আমাদের সরাসরি সংযোগের পরিসরটি দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সমাজ বলে যে বস্তুটি এক সময়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সত্য ছিল। সেইটি এখন আর ততটা সত্য নাই। বহুতল আবাসনেই থাকি, আর গলির প্রান্তেই থাকি। আমাদের জীবন যাপনের সাথে সমাজের আজ আর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নাই ততটা। পাড়া ছেড়ে চলে গেলেও কারুর মনে বিশেষ কোন রেখাপাত করবে না। নতুন পাড়ায় এসে পৌঁছালেও নতুন কোন বিশেষ সংযোগসূত্র গড়ে উঠবে না। এতো আমাদের নিত্যদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। কিন্তু এর প্রভাব মারাত্মক। আমাদের চিন্তা চেতনায়। মন মননে এর প্রভাব দিনে দিনে সর্বাত্মক হয়ে উঠছে। ফলে সমাজের সাথে বৃহত্তর জনজীবনের সাথে আমাদের মানবিক সম্পর্কসূত্র দিনে দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়ে উঠছে। বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। করোনার কারণে সরকার দ্যুম করে লকডাউন ঘোষণা করে দিয়ে সমস্ত পরিবহণ বন্ধ করে দিল। আমরা যে যার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সরকারী ছুটি উপভোগ করতে শুরু করে দিলাম। সেই একই সময়, কোটি কোটি আশ্রয়হীন নিরাশ্রয় পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার মাইল পথ পারি দিয়ে নিজের নিজের গ্রামে ফিরতে পথ হাঁটতে শুরু করলো। মানুষের ইতিহাসে যা সম্পূর্ণ অভুতপূর্ব। আমরা টিভিতে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলাম। সরকার বিরোধী হলে সরকারের মুণ্ডপাত করলাম। না হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দিলাম। কিন্তু দিনের শেষে লকডাউনের সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে এসে বঙ্গসংস্কৃতি চর্চায় মশগুল হয়ে গেলাম। তখন কোথায় কে কত হাজার মাইল পথ হেঁটে কোথায় মরে পড়ে থাকলো। সেসব সরকারের দেখার কথা মনে করে দিব্যি, “মধুর বসন্ত এসেছে। মধুর মিলন ঘটাতে আমাদের”, গাইতে শুরু করে দিলাম। অর্থাৎ এই যে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক। এদের সাথে মানুষ হিসাবে আমাদের নিজেদের কোন মানবিক সংযোগসূত্রই গড়ে ওঠে নি। ওদের জীবনমৃত্যুর সাথে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের কোন তুলনাই চলে না। দেশের বৃহত্তর জনমানসের সাথে এই যে এক বিরাট সংযোগহীনতা। সেই সংযোগহীনতাই আমাদের চিন্তা চেতনায় মন মননে আমাদেরকে দেশ থেকে, সমাজ থেকে পৃথক করে রাখে। বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।


আমদের কবিতা রচনার প্রয়াস, সেই পৃথক জমি থেকেই শুরু। সংযোগহীনতার বিপ্রতীপে একটিই সম্পর্ক থাকা সম্ভব। সেটি বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক। আমাদের দেশ ও সমাজ, জাতি ও সহ নাগরিক থেকে বস্তুত আমরা অধিকাংশ সময়েই বিচ্ছিন্ন থাকি। এবং এই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাটি এতটাই স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে গিয়েছে যে, সেটি আমরা আর আলাদা করে বিশেষ করে অনুভবও করতে পারি না। এই বিচ্ছিন্নতার দিগন্তেই আমাদের কবিতার ভাবনা। সেই ভাবনা মূলত আমাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। বড়োজোর আমাদের নিজ নিজ গোষ্ঠী বা অর্থনৈতিক শ্রেণীর পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সংযোগহীনতার সাথে এক বিচ্ছিন্নতার চর্চাই আমাদের কবিতা রচনার ভিত্তি। সেই কবিতার ভিতরে আমরা নিজেকেই গড়তে থাকি। সময় ও সমাজকে ধরতে পারি না। আবার সময় ও সমাজকে নিজের উপলব্ধিতে ধারণ করতে না পারলে নিজেকে গড়াও সম্পূর্ণ হয় না। ফলে সেই অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের পক্ষে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব হবে কি করে? হয়ও না। যেটা হয়, সেটি হলো শব্দ ও বাক্য, কথা ও কাহিনী, বক্তব্য ও স্লোগানের উৎপাদন মাত্র। কবিতা নয়।


দেশ ও জাতি। সময় ও সমাজের সাথে ওতোপ্রোত ভাবে নিজেকে না জড়াতে পারলে, সমাজের সাথে, বৃহত্তর জনমানসের সাথে সংযোগসূত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যার ফলে সকলের সাথে একটা বিচ্ছিন্নতার দূরত্বে আমাদের বাস করতে হয়। নিজের নিজের চার দেওয়ালের ভিতর। যেখানে বসে নিজের ঢাক নিজে যত জোরেই পেটানো যাক না কেন, সেটা আত্মপ্রচার হতে পারে। সাহিত্যকীর্তি হয়ে ওঠে না। তাই সারা মাসে কতগুলি পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হলো, সেটি আত্মশ্লাঘার বিষয় হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নাই। নিশ্চয়তার জন্য কবিতার উৎপাদন নয়। কবিতা সৃষ্টির পথে এগোতে হবে। আর দেশ ও জাতি, সময় ও সমাজ। মানুষ ও মানবিকতার সাথে আমদের ব্যক্তিত্বের সংযোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র তখনই আমাদের শব্দ ও বাক্য কবিতার অভিমুখে এগিয়ে যেতে পারবে। সমকাল ও সমাজের সাথে সংযোগসূত্রের ভিতর দিয়ে। সেই সংযো‌গই আমাদের হাতে কবিতার জন্ম দেবে। কারখানার উৎপাদন নয়। সাহিত্যের নির্মাণ।

 

৪ঠা আশ্বিন’ ১৪২৭