বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২১

সম্পাদকের কলমে

 


 

সম্পাদকের কলমে



কবি বলেছিলেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’। সত্যই কবির এই শাশ্বতবাণী মানব সভ্যতার শাশ্বত পরিচয়ই শুধু নয়, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডেরও শাশ্বত পরিচয়। কবি’র বহু শতাব্দী পূর্বেই মনীষীরাও বলে গিয়েছিলেন চরৈবেতি চরৈবেতি। শেষ নয়। থেমে যাওয়া নয়। চলতে চলতে ক্রমেই এগিয়ে চলা। সেই এগিয়ে চলাই জীবন। সেই এগিয়ে চলাই প্রকৃতিরও ধর্ম। মহামতি ডারুইন যাকে অভিযোজন বলে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ থামা নয় চলতে থাকা। কোথাও কোন সমাপ্তিরেখা টানা নয়। তাই বলে কি নক্ষত্রপতন হয় না? হয় নি কি? নাকি আর হবে না কোনদিন? অবশ্যই হবে। প্রতিনিয়তই হচ্ছে। নিয়তই হবে। আমাদের এই মাটির পৃথিবীও থাকবে না একদিন। ফুরিয়ে আসবে তার আয়ু। ঠিক যেমন ব্যক্তি মানুষের নিয়তি একদিন শেষের ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু তবু মানুষ মরে গেলেও রয়ে যায় মানুষ। একটি জীবনের শেষেও শেষ হয় না মনুষ্য জীবন। এতো আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। জীবন ঝরে গেলেও নতুন জীবনের অঙ্কুর বাঁচিয়ে রাখে সেই জীবনের জীবন্ত ধারাকেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের সৌরজগৎ একদিন অবলুপ্ত হবে যেমন সত্য। ঠিক ততধিক সত্য নতুন নিহারীকার কোলে জন্ম নেবে নতুন কোন সৌরজগত। সৃষ্টি হবে আরও এক নতুন পৃথিবীর। একটি সৌরজগতের ধ্বংসেই সৃষ্টির বিনাশ নাই। একথা বিজ্ঞানের। এমন কি বর্তমান ব্রহ্মাণ্ডেরও আয়ু ফুরিয়ে যাবে একদিন। কিন্তু তাই বলে মহাজগত কোনদিনও ব্রহ্মাণ্ড শূন্য হয়ে যাবে না। এ কোন কথার কথা নয়। বিজ্ঞান জানিয়ে দেয় এই মহা সত্য। সেই সত্যই কবির বাণীতে ধরা দেয়, ‘শেষ নাহি যে, শেষকথা কে বলবে’।


শুভ নববর্ষ ২০২১। বিগত ২০১৬’র ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূণ্যলগ্নে দুই বাংলার কবিদের নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল মাসিক কবিতাউৎসবের। প্রথম সংখ্যার উদ্বোধন হয়েছিল দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মী ও নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদকীয় দিয়ে। এবং অচিরেই কবিতাউৎসব প্রিয় কবির প্রিয় কবিতার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। কবিতাউৎসব বরাবরই বিশ্বাস করে এসেছে কবিতা বিশ্বজনীন জীবনের শাশ্বত উদ্বোধন। মাসিক কবিতাউৎসবের প্রতিটি সংখ্যা সেই বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক। বিগত সময়ে কবিতাউৎসব প্রতি মাসের ২১ তারিখ ভারতীয় সময় রাত্রি ১২টা ৫মিনিটে ও বাংলাদেশ সময়ে রাত্রি ১২টা ৩৫ মিনিটে নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই প্রকাশিত হয়ে এসেছে। কিন্তু প্রত্যেক উৎসবের যেমন শুরু থাকে। ঠিক তেমনই একদিন সেই উৎসবের সমাপ্তিরেখাও টানতে হয়। কবিতাউৎসবও তার ব্যাতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দুই বাংলায় এবং বাংলার বাইরে বাঙালি অধ্যুষিত বৃহত্তর বঙ্গভুখণ্ডে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার নানান কারণ রয়েছে। এবং অধিকাংশ সময়েই পত্রিকাগুলি আগাম ঘোষণা ব্যতীতই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু মাসিক কবিতাউৎসবের পক্ষে আমরা হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী নই। তাই কবিতাউৎসব তার পথচলার পঞ্চমবর্ষ পূর্তিতেই উৎসবের সমাপ্তিরেখা টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা জানি সেই সিদ্ধান্ত কবিতাউৎসবের সাথে সংযুক্ত সকলের পক্ষেই অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। কিন্তু একদিন না একদিন তো কোথাও এসে থামতেই হয়। সেক্ষেত্রে, আগাম ঘোষণা ব্যতীত বছরের মাঝখানে হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সঠিক সময়ে সমাপ্তিরেখা টানা অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে।


এইপ্রসঙ্গে আমরা বিশেষ করে জানাতে চাই। মাসিক কবিতাউৎসবের বিগত পাঁচ বছরের মোট ষাটটি সংখ্যা কবিতাউৎসবের ওয়েবসাইটে বরাবর পরপর মজুত থাকবে। এবং সাথে থাকবে বিগত ১৪২৬’র শারদসম্ভারও। যেকোন বছরের যেকোন সংখ্যাই মাত্র একটি মাউসক্লিকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ওয়েবসাইটের বামপার্শ্বে নীচের দিকে “কবিতাউৎসবের আগের সংখ্যাগুলি” শিরোনামে সব সংখ্যা পরপর সাজানো রয়েছে এবং থাকবে। এছাড়াও কবিতাউৎসবের সাথে সংযুক্ত সকল কবির প্রত্যেকের নামে পৃথক পৃথক পেজ খোলা রয়েছে। ওয়েবসাইটের একেবারে নীচে “উৎসবের কবিবৃন্দ” শিরোনামে প্রত্যেকের নিজস্ব কবিতা-পাতার লিংক সাজানো রয়েছে। কবির নামে ক্লিক করলেই নির্দিষ্ট কবির কবিতাউৎসবে প্রকাশিত সকল কবিতাই পরপর দেখা যাবে। এই সুবিধাগুলি আগামীতে একই রকম ভাবে অক্ষুন্ন রয়ে যাবে। যেকোন সময়ে যে কোন কবির কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে। পাঠ করা যাবে। এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কবিতার ওয়েবলিংক শেয়ার করাও যাবে। ফলে কবিতাউৎসবের মাসিক প্রকাশনার সমাপ্তি ঘটলেও, বিগত পাঁচ বছরের প্রতিটি সংখ্যা ও প্রত্যেক কবির প্রকাশিত কবিতা একই রকম ভাবে বিন্যস্ত থাকবে। হ্যাঁ, অনেকটা নিজ গৃহে সযত্নে রক্ষিত রচনাবলী সংকলনের মতোই। এখানেই কবিতাউৎসবের অনন্যতা। পরবর্তীতে কবিতাউৎসবের এই ষাটটি খণ্ডের ভিতর দিয়ে বাংলা কবিতার পাঠক বিগত পাঁচ বছরের বাংলা কবিতার চলমান একটি ধারার সাথে পরিচিত হওয়ারও সুযোগ পাবেন। আমাদের আশা, বাংলা ওয়েবসাহিত্যের ইতিহাসে সেই ধারার মূল্য খুব সহজে হারিয়ে যাবে না।


যে কথা বলে শুরু করেছিলাম। সেই কথাই আবার নতুন করে বলতে হচ্ছে। এক আধটা কবিতাউৎসব পাঁচ বছরের শেষে এসে থেমে গেলেও বাংলা ওয়েবসাহিত্যের পরিমণ্ডলে তার কোন আঁচ লাগারই কথা নয়। কবিতাউৎসবের বহু আগেই বহু সাহিত্যপত্রের ওয়েবপোর্টাল জন্ম নিয়েছিল। অনেকেই আজও সচল রয়েছে। অনেকেই হারিয়ে গিয়েছে হঠাৎ করে। বিগত পাঁচ বছরের কবিতাউৎসবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েও একাধিক সাহিত্যপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটছে ওয়েব দুনিয়ায়। তারা রয়ে গেল। আরও আরও নতুন উন্নত মানের সাহিত্যপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটবে ভবিষ্যতে। বাংলা সাহিত্যের ক্রম বিকাশের ধারায় যারা নতুন থেকে নতুনতর অবদান রেখে যেতে সক্ষম হবে। তাই একটি কবিতাউৎসবের মাসিক প্রকাশনা বন্ধ হওয়া অনেকের কাছে আত্মীয় বিয়োগসম শোকাবহ হলেও বাংলা সাহিত্যচর্চার দিগন্ত নব নব শাখায় প্রাণবন্ত থাকবে প্রতিদিন। এবং হ্যাঁ, কবিতাউৎসবের বিগত ষাটটি খণ্ডসহ পাঁচ বছরের পথচলার অর্জনও রয়ে যাবে তারই সাথে পাশাপাশি। বাংলা ওয়েব সাহিত্যের ইতিহাসে। সেও বড়ো কম কথা নয়। হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার থেকে সময় করে থেমে যাওয়ার ভিতরেই বরং একটা পূর্ণতার দ্যোতনা রয়ে যায়।


শুভান্যুধায়ী অনেকেরই মনে একটিই প্রশ্ন। এমন সাফল্যের শিখরে থেকে, পঞ্চম বর্ষ পূর্ণের শুভলগ্নে কেন এই থেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কবিতাউৎসবের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই জানেন, কবিতাউৎসবে কোন সংখ্যায় কবিতা প্রকাশের জন্য প্রায় তিন মাস আগেই কবিতা পাঠিয়ে দিতে হয়। তার একটিই কারণ। প্রতি সংখ্যার সকল কাজ প্রকাশের তিন মাস পূর্বেই শেষ হয়ে যায়। তাই প্রায় তিন মাসের অপেক্ষা ব্যতীত কবিতাউৎসবের কোন সংখ্যায় কবিতা প্রকাশ সম্ভব হয় না। যে কোন ওয়েব পত্রিকার পক্ষে এটি এক বিশেষ অর্জন। অর্থাৎ বহু মানুষের ভালোলাগা ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জড়িয়ে থাকে কবিতাউৎসবের এক একটি সংখ্যার সাথে। তাই অনেকেই আমাদের প্রশ্ন করছেন। এমন অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতার বিষয়ে। আসলে সাধারণ ভাবে ওয়েব পত্রিকার প্রকাশ মূলত ব্যক্তিনির্ভর। যিনি ইমেল থেকে কবিতা গ্রহণ করেন। প্রয়োজনে সম্পাদকমণ্ডলীর সহায়তায় কবিতানির্বাচন করে তিনিই কবিতা সম্পাদনা করেন। এবং তাঁকেই প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি কবিতা আপলোড করতে হয়। যে কাজটি মূলত টেকনিক্যাল। ফলে প্রতি সংখ্যার কবিতাপ্রকাশ আসলে মাত্র একজন ব্যক্তির উপরেই নির্ভরশীল। কোন কারণে তিনি না থাকলে, হঠাৎ করে তাঁর কিছু হলে আর কারুর পক্ষেই কবিতাউৎসবের একটি সংখ্যাও প্রকাশ করা সম্ভব হবে না কোন ভাবেই। এবং হঠাৎ করেই হারিয়ে যাবে সাফল্যের সাথে চলতে থাকা একটি ওয়েব পত্রিকা। কাউকে কিছু না জানিয়ে। সেই রকম অনভিপ্রতে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যেই এই সিদ্ধান্ত। এমন কি মূলধারার বাংলা সাহিত্যপত্রের ইতিহাসে এমন ভাবে কত শত সহস্র মূল্যবান পত্রিকা হারিয়ে গিয়েছে। তার ঠিক নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পাদক নিজেও জানতেন না, এটাই তার সম্পাদিত শেষ সংখ্যা। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বোধকরি কবিতাউৎসবই প্রথম। এমন আগাম ঘোষণা সহকারে নির্দিষ্ট পর্যায় পৌঁছিয়ে সাফল্যের শিখরে থাকতে থাকতেই উৎসবের সমাপ্তিরেখা টানতে পারছে। আমাদের এই সিদ্ধান্ত আগামীতে নতুন পথের দিশা দেখাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। শুধুই চলতে থাকাই নয়। সময় মত থামতে জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জানি এসবই আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিজাল। তেমনটাই মনে করবেন অধিকাংশ শুভান্যুধায়ীই। তাঁদের এই মনে করার পরতে পরতে যে ভালোবাসা মায়া ও শ্রদ্ধার পরশটুকু জড়িয়ে। কবিতাউৎসবের সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে সেটাই পরম আশীর্বাদ।


২১শে জানুয়ারী কবিতাউৎসবের এই শেষ সংখ্যাটি প্রকাশের সাথেই আমাদের মাসিক প্রকাশনার সমাপ্তি ঘটলো। ফলে কবিতাউৎসবের ইমেল ঠিকানায় আর কোন কবিতা গ্রহণ করা হবে না। আমরা আশা করবো সকল কবিবন্ধু পাঠক ও শুভান্যুধায়ীই আমাদের এই সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করবেন। কবিতাউৎসব বন্ধ হলেও রয়ে যাবে বিগত পাঁচ বছরের সকল অর্জন ও সঞ্চয়। বাংলা ওয়েব প্রকাশনার ঐতিহ্যে সেইটুকুই কবিতাউৎসবের অবদান বলে মান্যতা পেলে আমরা কৃতজ্ঞ। সেখানেই আমাদের আনন্দ।

 

৭ই মাঘ’ ১৪২৭