সপ্তদ্বীপা
অধিকারী
আমার ব্রহ্মা
সে
সামনে আসে না। শুধু যখন আমার হারানো তালপাতার বাঁশিটি মৃদু মৃদু সুর
করে কঁকিয়ে ওঠে,সে অমনি দামাল-মাতাল বাতাসে চেপে আমায় এক মুহূর্তে ছুটিয়ে নিয়ে যায় সেই
ছেলেবেলায়। অধরা বাঁশি বেজে ওঠে। সুরে সুরে মিলন হয়।
মিলনে
মিলনে বিরহ। "দুঁহু কোরে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া,আধ তিল না
দেখিলে যায় যে মরিয়া!"আমি মরমে মরে গিয়ে ভাবি,আমি
অনন্যোপায়। কিন্তু সে বাতাস
তখন ঝড়। ঝড়ের তান্ডবে তছনছ কতো শত বৃক্ষ। সে হাওয়া! আমার বুকে ঝড়।
আকাশমুখো
হয়ে ঝড়ের দাপট সহ্য করি। আর একটু একটু করে নিজের ছেলেবেলা থেকে ফিরে আসি।
ঝড় শান্ত
হয়। কালিমালিপ্ত হবার আগে সব মোহ ঘুচে যাক।
পরমুহূর্তেই
আবার সে আসে। উন্মত্ত আগুন! সব গ্রাস করতে চায়। প্রবল হাওয়ায় নিভু নিভু
প্রদীপ করতলের আড়ালে কি বাঁচে?হাহাকার করে অসহায় কান্নারা প্রেতের মতো অন্ধকারে
আশ্রয় নেয়। সে এবার পোড়াতে শুরু করে। শুরুটা শুরু হয় চোখ
দিয়ে। তারপর সে আমার চোখ,মুখ,ফুসফুস,
কলিজা দাউদাউ আগুনে ঝলসে দিয়ে যায়। আমার অশ্রুসজল আঁখি
দেখেও ঠা ঠা অট্টহাসি হেসে উঠে বলে--"তোমাকে পোড়ানোটাই আমার সাধনা।
"
সে
সুর দিয়ে,গান দিয়ে ব্রহ্মা হয়ে আমার সকল চেতনের দখল নিয়ে বসে থাকে অনন্তকাল...
কবির মৃত্যু
আমি
ঠিক সেখানেই আছি,আমি ঠিক তেমনই আছি
ডেকে
দেখো একবার...
ঘাটজ্যোৎস্নায়
বিছিয়ে দেবো শীতল পাটি
সমস্ত
পাহাড় ঠেলে ঠেলে পৌঁছে যাবো
শূন্যে,শূন্যে সেই
মহাশূন্যে...
তবু
ছুঁয়ে যাবো বারবার;
দেখে
নেবো মরণের পরেও
কীভাবে মরণ ডাকে হাতছানি দিয়ে,
আমি
ঠিক তেমনই আছি;
কবিতাপ্রেমিক---
শব্দেরা,অক্ষরেরা এখনো
আসে
তোমার
আলোকবর্ষে লুটোপুটি খায়,
আমি
শুধু অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ মেপে মেপে
দেখি
সপ্তর্ষিমণ্ডলের
কোনখানে জ্বলেছিল আগুন
পুড়েছিল
সবুজ কবিতারা কবে সবই
মীরার
ভজন জানে,জানে চাতক পাখি
পুড়ে,পুড়ে, জ্বলে গেছে,মরে গেছে
কবিতাপ্রেমিক
সেই কবি...
মানুষ, না-মানুষ এবং
একটি বৃক্ষের কাহিনি
রাতের পৃথিবী ঝিম ধরে আছে। আকাশের চোখে ঘুম-জড়ানো মুচকি হাসি। আমি ভালো বুঝি না,মন্দ বুঝি না! যমুনাতে যাই!মানুষ থেকে ক্রমাগত না-মানুষ হতে থাকি তাই!শরীর কথা বলে। কন্ঠে খেলা করে শিউলি ফুল। আমি শুকতারার মত চেয়ে থাকি। আচমকা আকাশ নেমে আসে একেবারে ঠোঁটের উপরে। হাত বাড়াতেই হুস!আমার দম আঁটকে আসে। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই দিগন্তে মিলিয়ে যাই। আঁখি দুটি দান করি ফটিক পাখিকে। আঁখিপল্লব তবু দস্তখতের আশায় স্থলপদ্ম।
মানুষ
হবার আশায় আমি সারাদিন বেশ থাকি। কিন্তু মাঝরাতে লাশকাটা ঘরের
প্রতিটি মানুষকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে শিকল খুলতেই আমি নতুন করে আবার না-মানুষ।
আর আবার
আকাশ প্রদীপ চেয়ে থাকা। হু হু বাতাস বয়ে আনে অজানা তথ্য,অচেনা সূর্য।
সকাল অচেনা
হলে হৃদয়ে ভাস্কর্য চলে। নির্দিষ্ট অবয়ব পাওয়ার আগেই কাঠবিড়ালির মত নেমে আসে আকাশ।
বলে
ফেলি--কেন এসেছো?জানো না,বৃষ্টি ছাড়া,রৌদ্র
ছাড়া তোমার মূল্য নেই!
খুব
শান্তভাবে,স্নিগ্ধস্বরে সে বলে--সমস্ত মেঘ টুকরো টুকরো করে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছি
ইচ্ছেসাগরে।
ক্ষুব্ধকন্ঠে
বলি--নিষিদ্ধ ড্রয়ারে ভরে রেখে দাও ওসব।
মিষ্টি
হেসে শান্তস্বরে সে বলে--আচ্ছা বেশ! কিন্তু তুমি তাহলে বাঁচবে তো?
আমি
আকাশের এক্কেবারে বুকে!
মণিতে
মণি মিশিয়ে প্রশ্ন করি--তুমি কে?
---আমার আমিত্ব দেখে বোঝো না
---না..
---আমার হৃদয় মেখে টের পাও না?
---উফ না...
---আমার জন্যই বেঁচে আছো তুমি!
অধৈর্য
গলায় সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে--সেটা বুঝতে পেরেছো বলেই এত উপেক্ষা? এত অপমান?
অপমান? উপেক্ষা?
তোমাকে? আমি?
আকাশের
কোনে কোনে জমে ওঠে মেঘ।
বলে---
আমিও তোমায় ছাড়া বাঁচবো না!
অবাক
আর সুখের যুগপৎ মিশ্র দোলায় থই থই সাগরও বাকরুদ্ধ।
আকাশ
সহজ হল খুব। টুকরো টুকরো
মেঘেরা পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে সমস্ত চরাচর অন্ধকারে নিমজ্জিত হল।
আকাশ হেসে
উঠলে যেই অন্ধকার নতমুখী হয়ে স্বীকার করলো। স্বীকার করল,যে,সহজ স্বীকৃতির অর্থই হল বিরহ। আর আকাশ সমস্ত ধারণ
করেছে বলেই সে নির্দিষ্ট সীমানায় অসীম। তার শিকড় মাটিতে প্রোথিত।
সে বন্দী।
সে-ই আসলে
বৃক্ষ।
সত্যের
সাবলীল স্বীকারোক্তিতে আকাশ ভেঙে পড়ল ঝরঝর করে ভিজে যেতে লাগল,ভেসে যেতে লাগল
সব। আকাশের আপ্রাণ চেষ্টায় শিকড়ের মাটি গলে গলে সমুদ্রের
গভীরতা কমাতে লাগল। বৃক্ষেরা ভিজতে ভিজতে আবর্জনা-মুক্ত হয়ে নতুন সৃষ্টির
স্বপ্নে ভাসতে লাগল।
আর
আপাদমস্তক ভিজতে ভিজতে মিষ্টি এবং নোনাজলের মিলন ঘটিয়ে আমি ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠতে
লাগলাম।