তন্ময় ধর
বৃক্ষজন্ম
১।
আমাদের ভুলভুলাইয়ার
ভেতরে এসে দাঁড়াল একটা গাছ
গাছের ভিতরে ঝড় থেকে
তুমি এক পাখির শরীর তুলে আনলে
অতিবৃষ্টি হতে থাকল
ঈশ্বরের প্রসবনালীতে
আর অপ্রস্তুত পাখির
ক্ষুধাবোধ ভেঙে ফেলল গেরস্থালি
দৃশ্যের বিরতিতে
ভুলভুলাইয়ার নকশা বদলে ফেললে তুমি
মাংসের ভিতরে ও
বাইরে দৃশ্যশূন্য একটি শব্দ
উদ্ভিদের নীরবতা আরো
কিছুটা বাড়্ল
একটি অন্ধ অভিনয়
উপশিরা হয়ে উঠল হলুদ পাতায়
২।
গাছের ভিতরে একটি
গাছকে কেটেই চলেছি আমরা
শাখাপ্রশাখার দাগ
থেকে সরিয়ে নিচ্ছি প্রেম
তরুক্ষীরগন্ধ থেকে
এক মৃত ঈশ্বর নেমেই চলেছেন অনন্ত মিসক্যারেজে
বৃক্ষের নীরবতা
সামান্য শিথিল হচ্ছে
দুঃখের আবছা বাকলে
আমরা চিঠি লিখছি
আস্তে আস্তে চিড়
ধরছে দেহবোধে
জল পড়ছে, পাতা নড়ছে
ঊর্দ্ধমূল অবাকশাখ
বৃক্ষ কাঁপছে আমাদের নখ ও নাভিতে
৩।
বৃক্ষের স্বাদগ্রন্থিতে
বোবা এক কান্নার আলো
তার আস্তরণ থেকেই
তুমি সরিয়ে নিয়েছো খিদে
কেটে ফেলা প্রশাখার
পাশে পাখির অন্ধকারে
আটকে যাচ্ছে
ঈশ্বরবিম্বের দু’টি স্তব্ধতা
এই ছায়া নাকি দীর্ঘ
এক সুখ ফেলে গিয়েছে তোমার ভ্রুমধ্যে
হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে
যাওয়া রঙ ফেলে গিয়েছে
শরীরে কাঁটা-দেওয়া
শ্বাসধ্বনির মধ্যে
তৃষ্ণাহীন মুখে
খাদ্য জমিয়েছো তুমি
৪।
ক্ষুধার্ত ঈশ্বরের
সামনে একই শাখায় দু’টি পাখি
দংশনের দাগে গহন রঙ
দিচ্ছেন অন্ধ বিনোদবিহারী
প্রেমজাতীয় একটি ফল
ঠুকরে ঠুকরে
তুমি ফেলে দিয়েছো
শূন্যতায়
শূন্যতার ভেতরেই
অজস্র পত্রধারণ করেছে গাছ
শিকড়ের বিপরীতে
আমাদের অতল খনন ধাক্কা মারছে
তীব্র কুঠারের
অভিনয়ে প্রস্তুত দু’টি চরিত্র
বার্গম্যানের
ক্লান্ত ক্যামেরায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে কাঠবিড়ালী
৫।
কাঠের সমস্ত দৃঢ়তায়
জগন্ময় মিত্র গাইছেন-
‘ঝরা ফুলে ভরা এই যে
সমাধিতল’
করাতকল থেকে হিংস্র
জোড়া-ভ্রু তুলে ঈশ্বর আমাদের দেখছেন
দৃশ্য নষ্ট করে
দিচ্ছে এক অনন্ত ক্ষতস্থান
এরপরে একটি কাঠের
ঘোড়া উপমিত হবে
উপমান হাওয়া ছুটে
যাবে আমাদের মাংসাশী চাবুকে
ধোঁয়া-ওঠা কাঠের
উনুনে মাংসে মশলার আন্দাজ ঠিক করতে করতে
তুমি সুতো বেঁধে
দেবে কাঠের অন্যায়-পুতুলে
রাতের দেউলে জাগে
বিরহী তারা
অসংখ্য
আয়নার মধ্যে কোনটি আসল, তা বোঝার আগেই আমাদের প্রতিবিম্বে রক্তাক্ত ছুরি ফেলে
দিল কেউ। নির্বাসন থেকে আমরা দেখলাম, হত্যাকারী ঈশ্বরের চোখের অভিনয় ঠিক হচ্ছে না।
দৃশ্যের
বাইরে থেকে উর্ণনাভদোষ এসে আটকে পড়েছে ছায়ানটের অন্ননালীতে। খিদের ভেতরে অগণন পাখি
জেগে আছে তোমার মেক-আপে। কিছুতেই রাত বাড়ছে না।
অতল
সিঁড়িতে নেমেই চলেছে সেই স্মৃতিহীন ছুরির সংলাপ। ক্ষতচিহ্নে চমকে উঠে থেমে গিয়েছে
ঈশ্বরবিম্বের দু’টি পা। সুর আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ঝরা
ফুলে ভরা এই যে সমাধিতল
শূন্য
অন্নপাত্রের ক্ষতচিহ্নে সামান্য আলো লেগে ছিল। সেই আলোর সামনে নির্মম অভিনয় আস্তে
আস্তে চলে গেল ছায়াঠোঁটের বাইরে। প্রেমকে অনেক বেশী ক্ষতবিক্ষত করে ফেললাম আমরা।
জগন্ময় কিছুতেই গাইতে পারলেন না। শূন্য রেকর্ড ঘুরে চলল।
জীবনের
কয়েক টুকরো অন্ধত্ব থামতে চেয়েও থামতে পারল না। ঝরা ফুলের ওপরই বৃষ্টি শুরু হল।
আরও পরে অতিবৃষ্টি। পায়ের অসুখ ভিজিয়ে আমরা দ্রুত এগিয়ে গেলাম দৃশ্যহীনতার দিকে।
কিম্বা দীনতার দিকে।
সুর বদলে
ফেলল আমাদের কথা এবং কথাহীনতা। রঙ বদলে ফেলল বেহিসাবী ফুল।
সে
কোন শাঁওনি মেঘ
সত্যিই
কি কোন বৃষ্টি থেকে ছিটকে ওঠা আলোয় খিদে সরে গেল? খিদে থেকে আর কথা খুঁজলাম না
আমরা? পাখিদের অব্যবহৃত
খেলাধুলোর মাঝখানে আটকে গেল অনেক পুরনো কন্ঠের সিল্ক।রেশম মথ তীব্র বেগে ঘুরতে
লাগল।
বিস্তীর্ণ
জলমন্ডলে বিছানো তুমি-আমি কথাহীন, স্মৃতিহীন, গতিহীন। অদ্ভুত এক শুষ্কতা আস্তে আস্তে দখল করছে
ঘর। তার জিভের শব্দ একটি নিঃসঙ্গ মাছকে চমকে দিচ্ছে অ্যাকোরিয়ামে। মাছের ব্লাডার
ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে দৃশ্যের বাইরে।
মাছের
খাবার দিতে যেতেই বিষন্ন সুর বিষদাঁত বসিয়ে দিল আমার প্রতিধ্বনিতে। প্যাথোসের আঁশটে
গন্ধের নীচে চাপা পড়ে গেল শূন্যতা।
তুমি
কি এখন দেখিছো স্বপন
প্রলয়বিন্দুর
হিসেব তোমার কপালে নড়াচড়া করছে। ফোঁটা ফোঁটা ঘুম থেকে অস্থির হয়ে উঠছে ভাসমান
শংখচিলের নখ। বাকি সমস্ত পালকে থেমে আছে রূপকথা।
তুমি
শুনছো না,
শূন্যগর্ভ
এক তরঙ্গমুখ থেকে চমকে উঠছে প্রাচীন চান্দ্রবর্ষ। সাবালক ছায়াপথ
আলো
ভাঙছে। মহাকালের সংসার-নদী ভাঙছে। জলমন্ডলের সমস্ত সঙ্গমচিহ্ন ভাঙছে। জন্মান্তর
নেমে যাচ্ছে মহাসমুদ্রের পতনে।
হঠাৎ মোড়
ঘুরতেই পায়ে লাগছে চোরাবালির ঘর। সেখানেও সমস্ত শঙ্খের পা অবুঝ হয়েই চলেছে।
আমিষাশী জিভে সুর লেগে যাচ্ছে।
জানিতে
যদি গো তুমি পাষাণে কী ব্যথা আছে
আবছা এক
দোষে আমরা ভিজে যাচ্ছি। পায়ের ছাপ থেকে বহুদূর এই শ্রুতিজন্ম আলগা হয়ে যাচ্ছে
দৃশ্যজন্ম থেকে। পৃথিবীর প্রতিধ্বনিহীন স্মৃতিহীন এক মাংসাশী উচ্চারণ ফিরতে পারছে
না।
দ্যাখো, এই শব্দের শরীরে
গর্ভপুষ্প নেই,
মৃত্যুফাঁদ
নেই, কালনিরোধক নেই।
ভেঙে
পড়ছে পাথরের কঠিনতম ছদ্মবেশ। একটি সুর ও একটি অন্ধকার অনাদৃত মাংস ফেলে রেখে
যাচ্ছে তোমার গ্রাসনালীর অন্ধকারে।
পুবের
হঠাৎ তরল আকাশে ঈশ্বরের স্তব্ধতায় তুমি হাঁটা থামাতে পারো নি। এই নেশাগ্রস্ত
মৃগব্যাধনক্ষত্রের বিক্ষেপে, সত্যি করে বলো দেখি, তোমার এই অনুভূতিহীন ক্ষরণের
কাল শেষ হল নাকি?