শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়


সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

তুই এলে

তুই এলে, আকাশ তার মেঘরঙা জামা পাল্টায়
আর আমি বৃষ্টি ধরার মতো হাত পেতে
                আজও তোর চোখের জল ধরে রাখি,
এক গণ্ডূষ জলে ভালোবাসার নাও ভাসাবার স্বপ্ন
দেখতে দেখতে শরৎবাবুর কথা শোনালি-
"যাদের চোখের জলের হিসেবে কেউ নিল না..."
আমি তখন বিনুনির ফিতে ফুল খুল
          কিশোরী তারাদের যুবতী সাজাতে ব্যস্ত!
তুই হা হা শব্দে হাসিতে ফেটে পড়লি
হাসিগুলো পেখম মেলে সাজিয়ে চলেছে ফুটিফাটা
হাড় জিরজিরে বসত বাটির একান্নবর্তী উঠোন।

আমি হা-ভাতে চালার পাশে অনাদরে বেড়ে ওঠা
কৃষ্ণচূড়ার পুষ্পিত দেমাকে সঁপে দিয়েছি চোখ,
কানামাছি খেলায় চোখ বাঁধার মতো দুষ্টুমি নিয়ে
তর্জনীতে আমার চোখ বাঁধতে এসে
                                   থমকে গেলি।
আমার সমস্ত শরীর লজ্জাবতী লতার মতো কুঁকড়ে যায়,
তোর সুঠাম শরীরের ঘাম বিন্দু অভ্রকুচির মতো
ছড়িয়ে পড়তেই আমার সমস্ত গোপন ইচ্ছেরা
জোনাকির মতো মিটমিট করে হেসে ওঠে।

তুই এলি। কিন্তু বসলি না।
কেবল তাকিয়েই রইলি।
কি অপূর্ব নির্মোহ দৃষ্টিপাত,
                            আকাঙ্ক্ষার মতো নির্মল!
কতগুলি ইচ্ছের ফসিল,
আমার অভিমানের পাশে সাজিয়ে রেখে
ক্ষিপ্র গতিতে জ্যোৎস্না কেটে কেটে পথ করে চলে গেলি অকস্মাৎ,
তোর ফেলে যাওয়া অশ্রুবৃষ্টিতে আমি ভিজে যাচ্ছি,
যাঃ! তোকে যে বৃষ্টিতে ভেজানোই হল না !!







স্পর্শ, গন্ধ এবং অস্ফুট কথা

স্পর্শটুকু রেখে যখন তুই শ্যু-রেকের পাশে দাঁড়ালি,
তখনও তোর পারফিউমের গন্ধের ভিতর থেকে
প্রজাপতি উঁকি দিচ্ছে। আর আমি ভাঁজ করা পর্দায়
অর্ধেকের বেশী শরীর ঢেকে মুচকি হেসে অর্ধনারীশ্বর!
তখন অজস্র কথা আঙুরথোকার মতো ঠোঁটে ঝুলছে,
আঙুর ফল টক -ভেবে ছিঁড়তে পারলি না একটাও,
আমি বোকার মতো তখনও ভালোবাসার ছুঁচে
একটা একটা করে কথা সেলাই করে চলেছি,
যদি কোনোদিন শিলিভূত সমাজ একে শিল্পিত করে।

তুই চোখ না তুলেই অস্ফুটে বললি--
"আবার আসিব ফিরে..."
ক্ষণিকের জন্য জীবনানন্দ ঝিলিক দিল বুকে,
আর একটা আস্ত রঞ্জনা নদী জন্ম নেবার তাগিদে
তার ভ্রূণ নিয়ে জরায়ুর ভিতর বদর বদর শব্দে
পাল তুলে দিতে লাগল।
উটের গ্রীবার মতো কিছু বিচ্ছিন্ন বিস্ময়,
রক্তবহতায় স্রোত খুঁজে পাগল হয়ে যেতে লাগলো।
আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম।
পেরিয়ে যেতে লাগলাম রীপু ঘাট, কাম নদী, সঙ্গম খাল...

তুই যখন চৌকাঠ পেরিয়ে গেলি,স্পষ্ট দেখলাম
আমার মতো একটা দুঃখী ছায়া তোর পাশে,
যে অস্ফুটে গাইছে--
"তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী..."






          
ইশারা

আসুন আমরা ক্যানেস্তারা পেটাই
শব্দের নানাবিধ রূপক আর আমাদের নয়,
ঋতুমাসি আম্রপল্লবে সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে
ঘট সাজিয়ে নিঃসঙ্গতার বোধন পর্ব উজ্জ্বল করছে!
জাফরানি নিস্তব্ধতার ভিতর হরিতকি ফলের পতন দেখে
লাফাঙ্গা হরিণেরা ঘৃতকুমারির বনে
রেখে যাচ্ছে রহস্যময় চোখের ইশারা।

আমি জনান্তিকে হরিণি ইশারা তুলে এনেছি,
তাকে শুইয়ে রেখেছি আমার শোবার ঘরে,
সে আমাকে প্রেমের মুদ্রা শেখাতে লাগলো।
আর আমি ঘোরের মধ্যে ঘাই হরিণির মতো
সঙ্গ পিপাসায় কাতর হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম,
প্রতিটি কাতরতার মোচড় আমাকে
একাকিত্বের পৃষ্ঠপোষকতা শেখাতে থাকে,
আমি শ্রান্ত বুলবুলির মতো চঞ্চলতা ঝেরে ফেলে
ফকির বারান্দার কোনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।
বিছানায় উঠে বসে ইশারাটি কাছে ডাকে,
আমি যাই। আমায় স্তন্য দান করে,চুলে বিলি কাটে,
গায় কাঁটা দেয়,মায়ের আঁচলে আশরীর ঢাকে।
অস্ফুটে ডেকে উঠি --মা!
ইশারাটি একছুটে হরিণির চোখের অন্দরে ফেরে।

এবার  ইশারাটি একটা ত্রিফলা বল্লম নিয়ে ফিরে আসে,
লাঠি দিয়ে সে ক্যানেস্তারা বাজাতে থাকে
আর তিন ফলায় বিঁধতে থাকে অকাল শূন্যতা,
তারপর ত্রিভুবন কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকে---
তফাত যাও।      তফাত যাও।      তফাত যাও...