রমা সিমলাই
মাধুকরী
এই যে
এতো যত্ন করে নিজের মৃতদেহ আগলে বসে আছি, - আদতে একেই বেঁচে থাকা বলে!
নাভিশ্বাস
ওঠার দিন শেষ। নাভিকুন্ড জুড়ে জমা করেছি শীতল ক্রুদ্ধতা আর অবয়বহীন খিদে - লাল
নীল বেগুনী খয়েরী।
প্রপিতামহের
আমলের প্রাচীনা এক পঞ্জিকা, আমার শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঠাকুরঘরে বসে নিয়মকরে ফুল
বেলপাতা নকুলদানা জর্দাপান খায় আর আমাকে দেখলেই অভ্যাসমতে বলে, "তোমার কোনও
মৃত্যুযোগ নেই!" - আমি নিশ্চিন্তে চৌকাঠ ডিঙিয়ে যাই দিকশূন্যপুরের দিকে...
মই বেয়ে
আকাশের ঝুল ঝাড়তে গিয়ে, হঠাৎই কানে এলো প্রাচীনা পঞ্জিকার বিড়বিড়ে কণ্ঠস্বর, "মৃত্যু, তোমার কোনো
মৃত্যুযোগ নেই"...
পঞ্জিকাকে
নির্বাসন দেবো বলে হাতে নিতেই, নিজের অব্যর্থ মৃত্যুযোগে হিংস্র হয়ে উঠলো সে, " মর মর মর
হারামজাদা"...
মহাকাব্য
যেখানে মাটি জুড়ে শুয়ে আছে, আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনের বাগানে, সমাহিত করলাম
পঞ্জিকা আর মৃত্যুমুখী এক বাদুরজননীর সন্তানশোক। - যদি কাল রোদ আসে বা রাতের
কালপুরুষের শরীর ছুঁয়ে নেমে আসে অমেয় জোছনা, - থাক, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর আঁশটে
গন্ধ আর ভালো লাগে না।
অনন্তকাল
নিজের মৃতদেহ ছুঁয়ে বসে আছি।
এবার
তোমরা আমাকে একটু জীবনের গল্প বলো, গরম ভাতের গন্ধ আর শরীর জুড়ে খিদের শব্দ বলো, বলো সোঁদা মাটি আর
পাখিদের সংসার ...
বিদুষী অন্ধকার
অগাধ রাতে প্রতিটি নির্দোষ
বাতিস্তম্ভে
ঝুলে থাকে ভ্রাম্যমান কিছু
শূন্যতা,
অথচ
এমন নয় কবিতার সাথে তার নিত্য
রেষারেষি।
জনৈক মৃত মানুষ, সমস্ত লেনদেন
চুকিয়ে,
মাত্র
চারটি কাঁধ আর ইতস্তত কিছু
উড়োখইএর ভরসায়
হেঁটে গেল অনিবার্য দিগন্তের
দিকে ।
কবি তার না-ঘুম অসুখের ভরসায়
নিঃশব্দে জড়ো করেছে স্বরবর্ণের
বিভূতি।
বিনাবাক্যব্যয়ে আপনাআপনি
জড়ো হয়েছে ব্যাঞ্জনবর্ণ, সন্ধি-সমাস ।
উলুখাগড়া
বন উজাড় করে ছুটে এসেছে সমারূঢ় স্মৃতি আর
নিষিদ্ধ গোলাপী আপেল.......
অথচ বাতিস্তম্ভে পুড়ে মরা
পতঙ্গের নিয়তি নিয়ে
সুদকষা বা সিঁড়িভাঙার প্রতিটি
অঙ্ক,
দিনের আলোয় মিথ্যে হয়ে যাবে –
এটুকু বুঝতে এত বেশি
সময় নিলেন কবি,
কবিতার মৃত্যুতে বা অপমৃত্যুতে
"বলহরি হরিবোল" অপ্রাসঙ্গিক
! –
ঈশ্বরীর আশ্চর্য বাঘছালে কবি আর
কবিতা
একাত্ম হয়ে যায় বিদুষী
অন্ধকারে !!
কোজাগরী
প্রোমোটার
বন্ধুটি বলেছিলো, "আমি একটা মাল্টিস্টোরিড কবিতা লিখবো। গ্রাউন্ড ফ্লোরে
কিছু বাতাস আর আলোর বাসভূমি হবে! ফার্স্ট ফ্লোরে ফুল আর ফসলের সোহাগজলে জীবন এর
বিন্যস্ত যাপন আঁকা থাকবে। সেকেন্ড ফ্লোরে ব্যাবসা মানে বেঁচে থাকার আয়োজন আর থার্ড
ফ্লোরে আকাশের অবিরাম আনাগোনা !!"
আমি হেসে
বললাম,
"সে
তো বুঝলাম। তবে সেখানে আমার ভূমিকা কী !!
আমি না'হয়", আমাকে থামিয়ে দিয়ে
প্রোমোটার বন্ধুটি বলেছিলো, "আরে তুইই তো উদ্দেশ্য - বিধেয় ! তুই ফুলের বাগান হয়ে
জড়িয়ে রাখবি। কবিতার শরীর জুড়ে মধু বৃন্দাবন !!"
তারপর
কেটে গেছে গোটা একটা বছর !
দৈনন্দিন
রোজনামচায় ভুলে গেছি সেদিনের সেই সান্ধ্য
আড্ডা !! কবিতার নাম রাখলাম "কোজাগরী", - বন্ধুর ফোন, "তোকে দেখাবো । চলে
আয় ! " মজাই পেলাম। কবিতা "কোজাগরী" শোনা নয়, দেখতে যাচ্ছি !! বাতাস
আর বাতিস্তম্ভে তুমুল শীত। অসময়ের অঝোর ঝরণে ভিজে যাচ্ছে ভিতর - বাহির !!
প্রোমোটার বন্ধুটি কবি হলো অবশেষে !!!!
গাড়ি
ছুটছিলো। বন্ধুর পাঠানো গাড়িতে আমি আজ
কবিতা শুনতে নয়, দেখতে যাচ্ছি। বৃষ্টি ভেজা
মৃদু আলো ঝুরঝুর করে সন্ধ্যাকে ডেকে পাঠালো। সন্ধ্যা না নামলে যে ছাড়পত্র পায় না
রাত আর রাত্রি মানেই তো "কোজাগরীর " রূপকথা !!
গাড়ি থেকে নামলাম।
এক বিশাল ইমারত। ঝলমল করছে চাঁদ
আর
নিয়নের মিলিত মূর্ছনা !!
চারতলা বিল্ডিং এর মাথায়
চন্দ্রমৌলীর মতো
জ্বলজ্বল করছে "কোজাগরী"!!
বন্ধুর হাত ধরে, পৌঁছে গেলাম কবিতা -
উৎসবে!
গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফুল আর ফসলের
হাসিমেলা !!
ফার্স্ট ফ্লোরে অনাথ শিশুদের
বাসযোগ্য পৃথিবী !!
সেকেন্ড ফ্লোর - স্নিগ্ধতায়,
পরম মমতায় জায়গা দিয়েছে
বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের,
যাদের দেখার কেউ নেই !!
থার্ড
ফ্লোরে,
আহা !!
- কি অসামান্য ক্ষিপ্রতায় জীবন বুনছে, জীবিকা বুনছে, সময় বুনছে একদল তরুণ - তরুণী
!! ওদের রোজগার রোদের মতো অন্ধকার তাড়াচ্ছে, খিদে তাড়াচ্ছে, অভিশাপ তাড়াচ্ছে !!
কোজাগরী
পান্ডুলিপি জুড়ে অন্যরকম সুখ
প্রোমোটার বন্ধুটির কবিতা লেখা
নিয়ে সংশয় ছিল
হৃদয়ের এ পিঠে ও পিঠে
নীচে তাকালাম
আলোময় শহরে মিছিল ভাঙার শব্দ
মিছিল ভাঙার শব্দে এই প্রথম কেঁপে উঠল
আমার কবিজন্ম
!!!