মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

রুদ্রশংকর


রুদ্রশংকর

মরুভূমির মেয়ে

বয়স ছয়। মুখে গোলাপি আভা, গায়ে পাকা গমের মতো রঙ,
রোদ্দুর-পোড়া চামড়ায় চিকচিক করে বালির ঘ্রাণ।
সেই বয়সে যেমন হয়, ঠিক তেমনই আর কি!
জ্বলন্ত জিভের দিকে চেয়ে থাকে আমার মেয়েবেলা।
হাতে একের পর এক খেলনা নিয়ে মেতে উঠি, আর
একের পর এক খেলার অভাব এসে হাজির হয় উঠোনে।  

খেলতে খেলতে আমার মেয়েবেলার শরীরে জমে ঘাম;
আগের রাতে সেই ঘাম-শরীর স্বপ্নে দেখেছিল বাবার বন্ধু।
সে এক আশ্চর্য স্বপ্ন!
মরুভূমির এক মহান ঈশ্বর আদেশ দিয়েছেন বিয়ের। 
কারোর কিছু বলার ছিল না, কারোর কিছু করার ছিল না!
তাই স্বপ্নের কথায় বাবার বন্ধুর সঙ্গে বিয়ে হল,
বুকে তার একাধিক বউ, একাধিক যৌনদাসী;
সম্ভ্রান্ত অতিথিরা এটা সেটা বোঝায়, আর হাতের মুঠোয়
আমার গৃহপালিত ইচ্ছেগুলো চোখের সামনে ভাঙতে থাকে।

এইভাবে দিন ঘোরে, মাস ঘোরে, মৃত্যুময় বছর ঘোরে,
এইভাবে মনের ধ্বংসস্তূপে তিনটে বসন্ত ঘুরে যায়।
অভ্যাসবশত আমার অনিচ্ছাকে অসম্মান করে
টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন বিছানায়,
ন’বছরের বালিকা শরীরে তখন পঞ্চাশ পেরোনো যুবক।
ঈশ্বর দেখলেন, আকাশে উপভোগ করলেন যন্ত্রণা!
সেই মুহূর্তে নিজেকে হাঙর মাছের খাদ্য মনে হল,
বড় বেশি অচল মনে হল আমার। তারপর থেকে
যে রাস্তায় সকলে হাঁটে, ফুল ফুটলে সে রাস্তায় হাঁটিনি কখনো।







সব তার ইচ্ছে

আমার মধ্য বয়সে বারবার নেচে ওঠে পারভেজ চাচার স্মৃতি।
সামাজিক সততায় প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন চাচা;
আর তাঁর ছোট মেয়ে তামান্না, আমার হৃৎপিণ্ড অলস করে বোঝাত
তার আসমানি কিতাবে লেখা আছে সব তার ইচ্ছেতে হয়।
আমার শীতল রক্তে চিত হয়ে সাঁতার কাটত তার ইচ্ছের কথা,
তার ইচ্ছে ছাড়া গাছের পাতাও সাহস করে নড়তে চায় না।

এরপর থেকে মেঘের উপরে দাঁড়ানো বন্ধুর কোন ঘুড়ি কেটে গেলে
আমি বলতাম ‘সব তার ইচ্ছেতে হয়’। সেই সেবার যখন
গ্রামের মঙ্গল পুরোহিতের অর্ধমৃত হৃৎপিণ্ড বিকল হল,
অ্যাম্বুলেন্স ডাকার আগে চেঁচিয়ে বললাম ‘সব তার ইচ্ছেতে হয়’।
স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফোকলা অস্তিত্ব নিয়ে কেউ ফেল করলে,
কোন উচ্চ বর্ণের হিন্দু শূদ্রের অভিমানী ছায়া মাড়িয়ে গেলে, এমনকি
হিন্দুর লাঠি মুসলমানের ঘাড়ে বা মুসলমানের ছোরা হিন্দুর বুকে লাগলে;
সটান সূর্যের দিকে তাকিয়ে হেসে বলি ‘সব তার ইচ্ছেতে হয়’।

অনেক দিন পর বদলে যাওয়া পৃথিবীর, বদলে যাওয়া মানুষের ভাত খেয়ে
আমার ইচ্ছেরা শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। মহান শূন্যতায় ধর্মের বাকল খুলে যায়।
গরম উনুনের পাশে ভাতগুলো চিবোতে চিবোতে বুঝতে পারি
তারা কেউ সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে না নিজেদের, বিশ্বাস করে না ঈশ্বরকে।
এক ঝাঁক অবিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে, ভিতরে ভিতরে অন্তঃসারশূন্য মানুষের সঙ্গে
আমি মনুষ্যত্বের দিকে একলা হাঁটতে থাকি; একসঙ্গে অনেকটা হেঁটে যাই।






অধিকারের পংক্তিমালা

যতদূর হাঁটি, পাকেচক্রে নিজেকে অন্য প্রাণী মনে হয়।
মানুষের সমস্ত শাখায় ঈশ্বরের নির্বোধ জন্ম দেখি,
চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের মৃত্যু দেখি আমি।
ঠিক সেসময় মধ্যবিত্তের অসংখ্য পাঁচিলে মেঘ জমে;
আরও এক ঈশ্বরের অসুখ, আরও এক ধর্ম-বইয়ের বিষাদ 
ঢোকে ঘরে। সেই থেকে...
মানুষের জ্যামিতিক অধিকার নিয়ে ফুটবল খেলে ধর্ম,
আর আমি ভাঙতে ভাঙতে ভিটেমাটি বিক্রি করি।
তারপর আমাদের আনন্দ-মৃত্যুর ভিতর
আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রেমের কবিতা হয়ে থাকি,
কবিতা ঠোঁটে পাগলামি করি পৃথিবীর আশ্চর্য গলিতে। 
এই মুহূর্তে কোন মিছিল নয়, হাতে পায়ে শান্তি অমরত্ব পাক,
এক পরিচ্ছন্ন ঘুমের জন্য আমার শোষণ-মুক্ত শিরদাঁড়া চাই।