মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

সৌমিত্র চক্রবর্তী


সৌমিত্র চক্রবর্তী

বিদ্ধ বজ্রপাতের সেকেন্ড


কারেন্ট চলে গেল কি এই আবদ্ধ জলভূমে! এখন ছাদের ওপরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় বাতিল জ্যারিকেন। ছাদের বিমগুলোর নীচে যত্নে রাখা সমস্ত গাড়ি ও সরীসৃপ কঙ্কাল হচ্ছে একে একে। লোডশেডিংয়ের অন্ধ কালোর দড়ি পেঁচিয়ে চলেছে না-দিনের স্মৃতি। আচ্ছা শান্তি কাকে বলে? অশান্তি কিম্বা শান্তি এক সুতোর তফাতে নাচানাচি করে হাত ধরাধরি করে। ভেতরের কিচেনে অনাত্মীয় মাংসের দুর্গন্ধ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ভাইরাল হয়ে গেলে মাথার তিন তালগাছ অন্দরে অমানুষিক যন্ত্রণা বন্ধ বাক্সের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে। যন্ত্রণারা কথার কারিকুরিতে কখন যেন আলাদিনের দৈত্য হয়ে যায়। কোথাও কোনো অদ্বৈতার জন্ম হলো নীরব নার্সিং হোমের চার সাদা দেওয়ালের মাঝে। প্যারা নর্ম্যাল যুবতীর উদ্ধত বুকে লোমশ হাত রাখলে চোখ বুজে আসে পরম আবেশে। একে একে পর্দা খুলে যায় উলঙ্গনীল প্রান্তর ঠা ঠা করে হাসে। গতরাতের ককটেল নেশার আবেশে পীরগাছায় আবছায়া নেমেছিল। একটানা মোবাইল কেঁদেছিল, অথচ সেই আধঘুম আধজাগা প্রাচীন জলায় ছড়িয়ে পড়তে পড়তে কান্নার তরঙ্গ উদারা মুদারা তারায় জ্বলতে জ্বলতে দপ করে জ্বলে উঠে ফের নিভে গিয়েছিল। অনেক দূরের মধ্যরাতের সঙ্গম শেষে উঠে বসা গৃহস্থ জন তাই দেখে বিড়বিড় করেছিল, আলেয়া! আসলে পৃথিবীটা কি সত্যিই গোল, নাকি ডিমের আকার, নাকি চৌকোনা পরিত্যক্ত বাসনের মতো সেটা নিয়ে মতভেদের বিলম্বিত সময়ে রাতচরা পাখিছানা কেঁদেছিল। আর কোনও মায়ার তোয়াক্কা না করেই উড়ে গিয়েছিল সাইবেরিয়ান পাখির নির্দয় সম্প্রদায়। দুই আর দুইয়ে চারের অঙ্ক কখনোই মেলেনি আজও।







একটা সময় পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটায় তুরতুর হাঁটাচলা। কোন এক অপরিচিত ভীড় ভাড়াক্কায় অপেক্ষার টিকটক টিকটক। ট্যাক্সির উইন্ডস্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায় নাগাড় আকাশ কান্নায়। অথচ তখন বিষাদের আবহ জরুরী ছিল না। ইঁট রঙ গলি বেয়ে তরতর ... ওমনি আকাশ চোখ মুছে একগাল হেসে... 'এসো হে জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি ...'। লম্বা কালো অ্যাসফল্টের রাস্তা বেয়ে অচেনা এক ব্রিজের মাথায় পতপত পতপত পতাকা উড়িয়ে কোন দূর এক মন্দিরের দরজায় ঢং ঢং ঢং চার্চের ঘন্টা বেজে ওঠে। অবাক, ভীষণ অবাক করা শরৎ হেমন্তের সন্ধিক্ষণ পার্স থেকে ভেজা ন্যাপকিন বার করে যত্নে মুখ গাল ঠোঁট মুছিয়ে হাসে। পঞ্চমুন্ডির আসনে খিলখিল হেসে ওঠে খিল্লিবাজ শকুন্তলার আত্মা। নেচার তার দুশো পঞ্চাশ এমএম জুম লেন্সে তুলে নেয় সদ্য পট বিবর্তনের গল্প। সানগ্লাসে রিফ্লেট হয় আগামী ঘৃণার নীল শার্ট প্রতিচ্ছবি। এখানেই শুরু হয়ে যায় পম্পেই নগরীর ধ্বংসের কাউন্টডাউন। অঘোর তান্ত্রিক জেগে ওঠে মধ্যরাতের সতীচ্ছদ পর্দা ছিঁড়েখুড়ে। গতকাল কেটে আনা শিশুমুন্ডের করোটির সাবেক পানপাত্রে ভরে নেয় তরল জ্বলন্ত মশাল। মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে তুমুল হিংস্রতায়। কালো মাটির আদিম ত্বক ভেদ করে উঠে আসে লক্ষ অক্ষ সম্ভোগী তুখোড় শয়তান। কচি সবুজ গাছ শুকিয়ে যায় বিষাক্ত নিঃশ্বাসে। খ্র্যা খ্র্যা শব্দে বিকট হেসে খড়গ হাতে তোলে অঘোর কাপালিক। রাত্রির আত্মা ভয়ে সংকুচিত হয়ে সরীসৃপ দেহ লুকিয়ে ফেলে লুচ্চা পাথরের শ্যাওলার ফাঁকে। আশ্চর্য! সেখানেই মাথা তোলে সদ্য জন্মানো এক সবুজ পাতা। অঘোর কে সে ভয় পায় না কোনো নির্দিষ্ট জন্মেই।







লাস্ট ডাউন লোকাল চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফোনটা এসেছিল। সবুজ থেকে আচমকাই লাল হয়ে যাওয়া সিগন্যালের একলা তার তখনও ঝনঝনিয়ে কাঁপছে, তার সুখসেকেন্ড টুপ করে ডুবে গেছে সাইকো সূর্যের হাত ধরে। ভিড় পাতলা হয়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্মে কুন্ডলী পাকানো কুকুর, বিড়ির আধপোড়া টুকরো, চাওলার ঝিম স্বপ্নযাত্রা আর বাঁধানো ইউক্যালিপটাসের অন্ধকার হয়ে আসা ক্রমিক তলায় বিধূরিত টিন চুমুর ঝড়। তখনই ফোনটা এসেছিল চলন্ত ট্রেনের কমপার্টমেন্টের ক্লান্ত ভয় মাখানো একরাশ স্বর বয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে। হঠাৎ কি ম্যাজিকে লাজুক মফস্বলি প্ল্যাটফর্ম মধ্য আফ্রিকার জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল! তার জ্বালামুখ বেয়ে গড়িয়ে নামতে লাগলো রাশি রাশি আগুন বমি করা লাভাস্রোত! পুড়তে শুরু করলো এক এক করে যত্নে, প্রেমে, আনুগত্যে গড়ে তোলা বসত গুলো। চারদিকে উড়তে থাকলো কালো পাঁশুটে ছাই - ছাই - শুধুই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া ছাই। চড়চড় শব্দ করে সন্ধ্যেটা পুড়ে যেতেই ঝুপ করে ফাঁকা অনুরাগ সময়ের জবরদখল নিলো হিংসুটে রাত্রি। আকাশে তখনো আগুন উৎসবের শেষ প্রহরে শিকারী মাসাই ড্রাম বাজিয়ে চলেছে - দ্রিম দ্রিম দ্রিম ... টিন চুমুগুলো আগুন এড়িয়ে কিভাবে যেন মাটির সাততলা অন্দরমহলে সেঁধিয়ে ইউক্যালিপটাসের আগামী অঙ্কুর হয়ে যেতে থাকলো। শেষ বসতবাড়ির একতলার ভাড়াটিয়াদের বাচ্চাটা তখনো পড়েই চলেছে, টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার...।