সম্প্রীতি একটি জরুরী প্রতিষেধক
মানুষে মানুষে সংযোগের প্রশস্ত রাজপথের
নামই হলো সম্প্রীতি। এই সম্প্রীতির উন্মুক্ত পথেই বিভিন্ন ধরণের মানুষ পরস্পর পরস্পরের
কাছাকাছি আসতে পারে। পরস্পর মিলতে পারে। আর সম্প্রীতির ঠিক বিপরীতে অবস্থান করে দ্বেষ।
মানুষে মানুষে নানা ধরণের পার্থক্য থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। থাকে বলেই এত রকমের বৈচিত্র।
না হলে মানুষে আর রোবটে কোন পার্থক্য থাকতো না। এই পার্থক্যের সুযোগ নিয়েই মানুষে মানুষে
বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশেই সক্রিয় করে তোলা হয় পারস্পরিক দ্বেষকে। সেই দ্বেষকে কখনো কখনো
সহিংস করে তুলে পারস্পরিক হানাহানির পথে ঠেলে দেওয়ার আর এক নাম রাজনীতি। রাজনীতির নানবিধ
সমীকরণ থাকে। থাকে নানান ধরণের হিসাবনিকাশ। লাভক্ষতির ক্ষতিয়ান। তার ভিত্তিতেই পারস্পরিক
দ্বেষকে সক্রিয় করে তুলে পারস্পরিক হানাহানির পথে মানুষকে ঠেলে দেওয়াই সাম্প্রদায়িকতা।
অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তিই হলো সহিংস বিদ্বেষচর্চা। যে বিদ্বেষচর্চা একজন
সাধারণ মানুষকেও অমানুষ করে তুলতে সক্ষম। মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাসই সাম্প্রদায়িকতার
ইতিহাস। এর বিপ্রতীপে মানুষ থেকে মানবিক হয়ে ওঠার ইতিহাসই সভ্যতার ইতিহাস। সম্প্রীতির
হাত ধরেই সম্ভব হয় সেই ইতিহাস গড়ে তোলার। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস খুঁড়ে দেখলেই এই সত্য
প্রমাণিত হবে।
একথা বললে ভুল হবে না, সম্প্রীতির বেদীতেই
মানব সভ্যতার অধিষ্ঠান। তাই সেই সভ্যতাকে নিরন্তর লালন করার প্রয়োজনেই সম্প্রীতির চর্চা
জারি রাখা দরকার। প্রতিটি মানুষ আর একজনের থেকে নানান ভাবে আলাদা। এই যে একান্ত বিশিষ্টতা,
যা একজন মানুষকে আর একজন মানুষের থেকে বিশেষ করে তোলে, এইটিই মানুষের জীবনের অন্যতম
শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু সেই শ্লাঘা যখন অহং সর্বস্ব ঢঙে পরিণত হয়ে যায়, মুশকিল হয় তখনই।
তখনই একজন মানুষ আর অন্যজনের সাথে সমান ভাবে মিলতে পারে না। পারে না কারণ সেই অহং সর্বস্ব
ঢঙে সম্প্রীতির কোন স্থান থাকে না। অন্যের সাথে মিলবার একটিই পথ। সেই পথ সম্প্রীতির।
সেই পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেই মনুষ্যত্বের বিলুপ্তি ঘটে। ঘটতে বাধ্য। কিন্তু প্রতিটি মানুষের
যে বিশিষ্টতা, সেই বৈশিষ্ট্য যদি তাঁর কাছে অহং সর্বস্ব ঢঙে পরিণত না হয় তাহলে সেই
মানুষের পক্ষে তার নিজস্ব বিশিষ্টতাকে রক্ষা করেই অন্যের সাথে মিলতে কোন অসুবিধা হয়
না। হয় না কারণ, তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার যে আনন্দ। সেই আনন্দ তার ভিতরের
সম্প্রীতিকে নষ্ট করে ফেলে না। অর্থাৎ আমাদের দেখতে হবে, আমাদের একান্ত আপন বৈশিষ্ট্যগুলি
আমাদের যেন আনন্দের কারণ হয়। সেগুলি যেন আমাদের কাছে অহং সর্বস্ব ঢঙে পরিণত না হয়ে
যায়। এইটি নিশ্চিত করতে পারলেই আমাদের ভিতরে সম্প্রীতিবোধের অপমৃত্যুকে ঠেকানো সম্ভব
হবে। বাইরে থেকে রাজনৈতিক প্ররোচনা যতই থাকুক না কেন। এর সাথে আরও একটি বিষয়ে খেয়াল
রাখা জরুরী। আমার নিজস্ব একান্ত বিশিষ্টতা আমার কাছে যেমন মূল্যবান ও আনন্দের, ঠিক
তেমনই, অন্য একজনের তার নিজস্ব একান্ত বিশিষ্টতাও তার নিজের কাছে তেমনই মূল্যবান ও
আনন্দের। আমি যদি তার বিশিষ্টতাকে মূল্য দিই, তবে সেও আমার বিশিষ্টতাকেও মূল্য দেবে।
কিন্তু আমি যদি তার বিশিষ্টতাকে অবজ্ঞা উপেক্ষা ও অস্বীকার করি, তবে সেও আমার বিশিষ্টতাকে
অবজ্ঞা উপেক্ষা ও অস্বীকার করার সুযোগ ও যুক্তি খুঁজে পাবে। ফলে তখন আর আমাদের ভিতর
সম্প্রীতির কোন গুণ অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা পারস্পরিক সম্প্রীতির চর্চার বদলে পারস্পরিক
বিদ্বেষচর্চার চক্রব্যূহে ঢুকে যাবো। আর সেই সুযোগে রাজনীতি আমাদের দিয়ে তার নিজের
স্বার্থে যাখুশি করিয়ে নিতে পারবে। তখন কিন্তু আমদের নিজস্ব আর কোন বৈশিষ্ট্যই অবশিষ্ট
থাকবে না যা আমাদের আলাদা করে গৌরবান্বিত বা চিহ্নিত করতে পারে। তখন আমরা দুই পক্ষই
রাজনীতির হাতের পুতুল। যার নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নাই। অন্যের সুতোর টানে নাচানচি করা
ছাড়া।
ঠিক এই অন্যের সুতোর টানে নাচানাচি করানোর
জন্যেই রাজনীতি দেশব্যাপী বিদ্বেষচর্চার পাঠশালা খুলে রাখে। সেই
পাঠশালায় ছেলে বুড়ো সবাই মিলে সাম্প্রদায়িকতার সিলেবাসে পণ্ডিত হয়ে উঠতে থাকে। যে যত
বেশি পণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে, তাকে দিয়ে পরবর্তী পর্যায় আরও বেশি মানুষকে এই বিদ্বেষচর্চার
পাঠক্রমে পণ্ডিত করে তোলা যায়। ফলে ঠিক ভাইরাসের সংক্রমণের মতোই মানুষে মানুষে বিদ্বেষচর্চার
এই পাঠক্রম একসময় অনেক বেশি পরিমান মানুষকেই অসুস্থ অমানুষ করে তুলতে পারে। আর সাম্প্রদায়িক
রাজনীতির সেটাই মূল লক্ষ্য, কার্যক্রম ও দূরভিসন্ধি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশযুগ
থেকেই এই কার্যক্রম অত্যন্ত সাফল্যের সাথে রূপায়িত হয়ে আসছে মূলত শাসক শ্রেণীর স্বার্থ
রক্ষায়। দেশ স্বাধীন হলেও শাসক বদলিয়ে গেলেও শাসকের প্রকৃতি বদলায়নি। কখনো কম কখনো
বেশি সেই রোগ দেশব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু বর্তমান
সময়ে এই রোগ প্রায় করোনা ভাইরাসের মতোই এক মহামারীর রূপ গ্রহণ করতে চলেছে। করোনা ঠেকাতে
যেমন স্যোশাল আইসোলেশনের কথা বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতেও ঠিক তেমন সম্প্রীতির
কথা বলাটা জরুরী। সোশ্যাল আইসোলেশন যেমন করোনা ঠেকাতে জরুরী। ঠিক তেমনই সম্প্রীতির
চর্চাও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রতিরোধে ততধিক জরুরী।
করোনা হয়তো একদিন প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আদৌ প্রতিহত করা সম্ভব হবে কিনা, সেকথা এখন আর জোর দিয়ে
বলা সম্ভব নয়। করোনার বৈনাশিক শক্তি যত প্রবলই হোক সেটি একটি সাময়িক বিষয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক
বিদ্বেষের সংক্রমক শক্তি করোনার থেকেও প্রবলই শুধু নয়, এটি কিন্তু করোনার মতো সাময়িক
কোন বিষয় নয়। তাই এর বৈনাশিক শক্তি করোনার থেকেও প্রভুত পরিমাণে বেশি। এই বৈনাশিক শক্তির
বিরুদ্ধে একটিই মাত্র অস্ত্র। সেটি মানুষে মানুষে সম্প্রীতির চর্চা। এই সম্প্রীতিচর্চার
দিগন্তকে নিরন্তর প্রশস্ত করে তুলতে না পারলে, একদিন মনুষ্যত্বের অবলুপ্তির হাত ধরে
সভ্যতা অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মূখীন হতেও পারে।
ভারতবর্ষে সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক
বিদ্বেষচর্চার রাজনীতি যেভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে, তাতে এই দেশের সামনে অনেক বড়ো বিপর্যয়
অপেক্ষা করছে। সেই বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করা যেকোন নাগরিকের আশু কর্তব্য হওয়া উচিৎ
বলেই মনে হয়। দেশের প্রতি কর্তব্যের ভিতর দিয়েই আমাদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা হয়ে থাকে।
সেই দেশপ্রেম থেকেই আমরা যত দ্রুত ও যত ব্যাপক হারে বুঝতে পারবো, এই অন্ধকার সময়ে পারস্পরিক
সম্প্রীতিচর্চাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার সংক্রমণ থেকে আমদেরকে ও আমাদের দেশকে রক্ষা
করতে সক্ষম, ততই মঙ্গল।
আমাদের সীমিত সাধ্যের পরিধিতেই পারস্পরিক
সম্প্রীতিচর্চার আবহমান ধারাকে জারি রাখতে হবে। নিজস্ব বিশিষ্টতাকে আনন্দের ভিতর দিয়ে
বহন করে অন্যের বিশিষ্টতাকেও মান্যতা দিয়ে স্বীকার করে নিতে হবে। হবে নিজের স্বার্থেই।
আর এই পথেই পারস্পরিক সম্প্রীতির রাজপথকে আমরা নিরন্তর প্রশস্ত করে তুলতে পারি। এই
রাজপথ যত প্রশস্ত করে তোলা যাবে, ততই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার বৈনাশিক সংক্রমণকে
প্রতিহত করে তার থেকে থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর সেইখানেই পরীক্ষা
আমাদের দেশপ্রেমের।
অনেকেই মনে করতে পারেন, আপনি বাঁচলে বাপের
নাম। আগে তো করোনার থেকে বাঁচি। তারপর দেশ। দেশবাসী। পারস্পরিক সম্প্রীতি নিয়ে ভাবা
যাবে। খুব সত্যি কথা। বিশ্বব্যাপী
করোনার সংক্রমণে আজকে মানুষ
দিশাহারা। সকলেরই একটি চিন্তা কবে আবিষ্কৃত হবে করোনার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা সেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য উঠে পড়ে
লেগেছেন। সাধারণ মানুষ আপাতত সোশ্যাল আইসোলেশনকেই করোনা মোকাবিলায় একমাত্র উপায় বলে
বুঝতে পারছেন। এই দুটি বিষয়ই আশার কথা। এই পথেই করোনার মোকাবিলায় অচিরেই মানুষ সক্ষম
হবে সন্দেহ নাই। যদিও করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি এখনো। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস সেটি
হবেই। অথচ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার যে ভ্যাকসিন অর্থাৎ পারস্পরিক সম্প্রীতিচর্চা,
সেটি তো আমাদের হাতেই রয়েছে। সেটি তো কোন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের উপর নির্ভর করছে না।
তাই যে প্রতিষেধক আমাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে, অন্তত সেই প্রতিষেধক প্রয়োগ করে করোনার
থেকেও ভয়ঙ্কর বৈনাশিক শক্তি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার অপ্রতিহত গতিকে প্রতিহত করতে
আমাদের এত আলস্য কেন? আজকে একজন চিকিৎসক তো কই করোনা সংক্রমিত কোন রুগীর সাম্প্রদায়িক
পরিচয়ের উপর নির্ভর করে তার চিকিৎসা করছেন না? কিংবা কোন রুগী তার ডাক্তারের সাম্প্রদায়িক
পরিচয় জেনে তবেই তার কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন না? ফলে মাথার উপর যখন মৃত্যুর খাঁড়া
ঝুলছে, তখন কিন্তু সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের আর কোন গুরুত্বই থাকছে না। জীবনমৃত্যুর এই
সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও কি আমরা এই সত্য উপলব্ধিতে ব্যার্থ হব? সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার
সংক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে আমাদের মনবিক পরিচয়ই কালিমালিপ্ত হবে। অন্তত জীবনমৃত্যুর
এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের এই উপলব্ধিটুকু ঘটুক।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার সংক্রমণ প্রতিহত
করতে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্প্রীতিচর্চার যে ভ্যাকসিন, যা আমাদের শুভবোধের ভিতরেই
রয়েছে, সেই ভ্যাকসিনকে আরও বেশি মানুষের নাগালের ভিতরে এনে দিতেই মাসিক কবিতাউৎসবের
আয়োজনে নববর্ষের এই বিশেষ সম্প্রীতি সংখ্যার প্রকাশ। দুই বাংলার মোট আটচল্লিশ জন কবির
কলমে সম্প্রীতির এই বিশেষ সংখ্যা সেজে উঠেছে। উঠেছে এই সাধারণ বার্তাটুকুই ছড়িয়ে দিতে
যে, সম্প্রীতিই সেই আয়ুধ যা বিদ্বেষচর্চার সংক্রমণ প্রতিহত করে মনুষ্যত্বের জয়যাত্রাকে
অব্যাহত ও সুস্থ সবল সুন্দর রাখতে পারে।