আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।
-আব্দুল গাফফার চৌধুরী
কবিতা ও জীবনের সাথে কবি ও পাঠকের সম্পর্ক ও সমন্বয়ের সূত্র
নিয়ে যুগে যুগে অনেক তর্ক বিতর্ক আলোচনা হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকেই নিজ বিশ্বাস ও
ভালোবাসায় অটল থেকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন নিজের দর্শন। কিন্তু একটি বিষয়ে
হয়তো অনেকেই একমত হবেন যে, কবিতা বা কাব্যসাহিত্য কখনোই জীবনের ফটোগ্রাফী নয়।
কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি তার চারপাশের বহমান জীবন ও তার অনুভবের সারাৎসারের এমন একটি
চিত্র নির্মাণে প্রয়াসী হন, যাতে পাঠকের উপলব্ধির স্তরে গিয়ে সেই চিত্র জীবন্ত হয়ে
ওঠে। না জীবনবাস্তবতার ণত্বে ষত্বে নয়, কবিতার অন্তর্দীপ্ত জীবনবোধের দিগন্তেই। এই যে কবিতার অন্তর্দীপ্ত জীবনবোধ সেটিই ফুটিয়ে তোলা সেইটিই
প্রতিষ্ঠিত করা একজন কবির প্রধানতম কাজ। যিনি যত ভালোভাবে সেই কাজটি করতে পারেন, সাহিত্যের
জগতে তিনিই কালক্রমে তত বড়ো কবি হয়ে ওঠেন। আজকের জনপ্রিয়তা দিয়ে কোন কবিকেই বোঝা
সম্ভব নয়। বোঝা সম্ভব নয় কে কত বড়ো কবি। কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, কোনটা কবিতা হয়েছে
আর কোনটা হয়নি। অনেকেই মনে করেন সমাজ মনস্কতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিচারের বাণী নিরবে
নিভৃতে কাঁদতে দেখলেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠাই কবিতা। না তা নয়। নয় কারণ প্রতিবাদের
গর্জন মূলত স্থানিক ও ভৌগলিক। সময়ের স্রোতে তার অবদান ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী- যদি
না, তার মধ্যে আবহমান মানবসত্ত্বার প্রত্যয় ও চিরন্তন জীবনসত্যের নির্যাস থাকে।
এইখানেই পার্থক্য কবিতা ও না কবিতার। দুঃখের বিষয়, অনেকেই বুঝতে চান না এই
প্রাথমিক কিন্তু প্রধানতম শর্তটিই। আবার বিশুদ্ধ কবিতাবাদী অনেকেরই মতে সমাজমনস্কতায়
উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেই কবির পক্ষে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ার প্রবণতাই বেশি। ঠিক যেমন কবি
জীবনানন্দকে পাঠক সমাজে পরিচিত করানোর বিষয়ে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন যিনি, সেই কবি
বুদ্ধদেব বসু রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন জীবনানন্দের পরবর্তী কাব্যধারা প্রত্যক্ষ
করে। ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সমাজসচেতন কবিতা লেখার জন্যে বুদ্ধদেব বসু রূঢ়
সমালোচনা করেছিলেন জীবনানন্দের শেষ দিককার কবিতার। আবার তৎকালের সমাজবাদী কবিরা প্রত্যাখ্যান
করেছিলেন কবি জীবনানন্দকে ‘স্বপ্নক্রান্ত’ কবি বলে। তাহলে কি করবেন একজন কবি?
কোনদিকে যাবেন তিনি? কাকে সন্তুষ্ট করবেন? না কাউকে সন্তুস্ট করে আর যাই হোক কবিতা
লেখা সম্ভব নয়। সে লেখায় প্রতিষ্ঠিত হয় না কবিতার সেই অন্তর্দীপ্ত জীবনবোধের
সারাৎসার। তাই কবিকে নিজের পথ নিজেই কেটে নিতে হবে। হবে আপন অন্তর্লোকের ইশারায়। সমন্বয়
করতে হবে সাহিত্যের জগৎ ও পরিপার্শ্বের কোলাহলের মধ্যে। সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয়
ক্রন্তিকাল থেকে পালিয়েও যেমন কাব্যচর্চা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই সম্ভব নয় কেবলমাত্র
সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোলাহলের সংবাদ ভাষ্য কিংবা প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে উঠে
সৎসাহিত্যের সৃষ্টি। আর এইখানেই কাল নির্ধারণ করে দেয় কে কবি আর কে কবি নয়।
সম্পাদকীয়র শুরতেই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উল্লেখ এই কারণেই
যে, কবিতার লাইনও কখনো সখনো জাতির মেরুদণ্ডকে সোজা করে দিতে পারে। সেটা কবির কাজ
না হলেও সৎকবিতার মধ্যেও নিহিত থাকে সেই শক্তি। সেই শক্তি যখন জাতির মন মনন
মানসিকতায় বিপ্লব তুলে দেয় তখন কবিতারও খুলে যায় এক এক নতুন নতুন দরজা। আমরা বুঝতে
পারি একটি জাতির জীবনে কবি ও কবিতার ভুমিকা কতটা ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে
যুগসন্ধিক্ষণের লগ্নে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ঠিক সেইরকমই আরেক যুগসন্ধিক্ষণের
প্রাকমুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে কবি লেখক
বুদ্ধিজীবিদের বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের পরিসর সম্পূর্ণতঃই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
আরও দুঃখের বিষয় সেই ভয়ঙ্করতম এবং চরমতম লজ্জার বিষয়টিও আজ সাধারণ জনসমাজে মান্যতা
পেয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় অজুহাতে। অনেকেই মনে করছেন ধর্মের অজুহাতে মানুষের বাক
স্বাধীনতা মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়াটাই ধর্মচর্চা। যে কোন জাতির জীবনে এ
এক দূরারোগ্য ব্যাধির লক্ষ্মণ। বস্তুত দেশ থেকে তসলিমা নাসরীনকে বিতারণের মধ্যে
দিয়েই শুরু এই রোগের। তারপর একে একে জাতির মনীষা হুমায়ুন আজাদ সহ একাধিক মানুষের
মতপ্রকাশের উপর নেমে এসেছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার খাঁড়া। মৌলবাদী চাপাতির কোপে একে
একে মৃত্যুমিছিলে সামিল হয়েছে তরুণ তাজা রক্ত। যারা একদিন জাতির বিবেক হয়ে উঠতে
পারতো। যে একুশ ছিল একদিন বাকস্বাধীনতা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জীবন্ত প্রতীক, সেই
একুশের নামাঙ্কিত অমর একুশের গ্রন্থমেলাতেই এক একে নিষিদ্ধ হচ্ছে প্রকাশিত নানান
গ্রন্থ। একে একে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে নানান প্রকাশনী। আটক করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত
লেখকদেরকেও যারা মৌলবাদের চোখরাঙানি হুমকির সামনেও নিজের লেখাটি লিখে যেতে
চাইছিলেন নিজের মতো করে। এই যে নিজের লেখাটি নিজের মতো করে লিখে যাওয়া, সেই
স্বাধীনতাটুকুই যদি কেড়ে নেওয়া হতে থাকে ক্রমাগত; তবে যে কোন জাতির পক্ষেই সে এক
অশনি সংকেত। দুঃখের কথা ধর্মের অজুহাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার এই ধারা
আজ সমগ্র সমাজেই মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় অজুহাতেই। কি করবেন সেখানে একজন কবি
সাহিত্যিক লেখক সংস্কৃতিকর্মী? চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে গিরগিটির মতো রঙ বদলে
ফেলবেন? ক্ষমতার অলিন্দে বন্ধক রাখবেন নিজের বিবেক আর ব্যক্তিস্বাধীনতা? না কি
লড়াইটা চালিয়ে যাবেন নিজস্ব মাধ্যমটিকেই আশ্রয় করে পরবর্তী চাপাতির আস্ফালন কিংবা
সরকারী নিষেধাজ্ঞা জারির আগে পর্য্যন্ত?
আমরা জানি না এর উত্তর। কিন্তু একুশের এই বাৎসরিক
আনুষ্ঠানিকতা ও বসন্তের এই সাড়ম্বর উৎসবের আতিশয্য ম্লান করে দেওয়া এইসময় যে কোন
স্বাভাবিক মানুষকেই ভাবিয়ে তুলবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমাদের কবিতা আমাদের
সাহিত্য যেন সেই ভাবনার দরজাগুলো বন্ধ করে না ফেলে, সেইটুকুই আমাদের নিরন্তর
প্রার্থনা সকল অনুভবী সজীব ও প্রত্যয়ী বিবেকের কাছে। যে, যে প্রান্তেই থাকি না কেন
অন্তর্দীপ্ত সেই জীবনবোধের প্রদীপের শিখাটুকু যেন প্রদীপ্ত করে রাখতে পারি নিজস্ব
প্রত্যয় ও প্রত্যাশার পরিসরে। সেখান থেকেই জন্মাতে থাকুক আমাদের কবিতা। প্রসারিত
হতে থাকুক আমাদের কবিতার ভুবন। কবিতার যে ভুবনেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য এই
কবিতাউৎসব। মাসিক কবিতাউৎসব ওয়েব ম্যাগাজিন।
সেই একুশে ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তে যাত্রা শুরু করে পুরো একটি
বছর পারি দিয়ে এল সদ্যজাত কবিতাউৎসব। যাত্রাশুরুর এই পর্বে কবিতাউৎসবের মূল
লক্ষ্যই ছিল কাঁটাতারের দুই পারের কবি লেখক ও পাঠকের মেলবন্ধনের সূত্রে আবিশ্ব সকল
বাঙালি কবিতাপ্রেমীকেই কবিতাউৎসবে সমবেত করার। সেই উদ্দেশ্য পুরণের পর্বটি চালিয়ে
যাওয়াই আমাদের অভীপ্সা। আর আনন্দের কথা আমাদের সেই যাত্রায় সামিল হয়েছেন অনেকেই।
কবি লেখক পাঠক বুদ্ধিজীবি সকলেই। আরও আনন্দের কথা কবিতাউৎসবের প্রথম বারোটি
সংখ্যায় সমবেত পাঠকের সংখ্যাটিও সম্প্রতি অতিক্রম করে গিয়েছে এক লক্ষের গণ্ডী।
প্রকাশের প্রথম বছরেই এই অর্জন যতটা আনন্দের তার থেকে অনেক বেশিই দায়িত্বের। সেই
দায়িত্বের পথেই কবিতাউৎসবের সম্প্রতি সংযোজনা পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভ। প্রতিমাসের
১৬ ও ৩০ তারিখে জুম এপ্লিকেশনে লাইভ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যার সুত্রপাত।
যেটির পাঁচটি অধিবেশন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। কানাডা নিবাসী কবি মৌ
মধুবন্তীর সুযোগ্য ও নান্দনিক সঞ্চালনায় যে অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ধীরে
ধীরে। আগামী ১৬ই মার্চ পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভের পরবর্তী অধিবেশনের বিষয় নির্বাচিত
হয়েছে “সাহিত্য শ্লীলতা ও অশ্লীলতা” আমাদের আশা অনুষ্ঠানটিতে সমবেত অতিথিরা বিষয়টির
গভীরে গিয়ে আলোকপাত করবেন তাঁদের চিন্তা চেতনা ও অভিজ্ঞতাজাত দৃষ্টিভঙ্গীর
মূল্যায়নে।
কবিতাউৎসবের এই বর্ষপূর্তি সংখ্যায় আমরা আমাদের মধ্যে
পেয়েছি এ মাসের অতিথি কথাসাহিত্যিক ম্যারিনা নাসরীনকে। কবিতাউৎসবের পাঠকদের জন্যে
রইল তাঁর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আমাদের আশা পাঠকবর্গ কথাসাহিত্যিক ম্যারিনা নাসরীনের
সাথে আরও নিবিড় ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন এই খোলামেলা সাক্ষাৎকারে। এই
সংখ্যটির আরও একটি বৈশিষ্ট দুই বাংলার বত্রিশ জন মহিলা কবির একত্রে সমবেত হওয়া। মোট
সাতচল্লিশ জন কবির দুইশত ছিয়াত্তরটি কবিতা দিয়ে সাজানো সুবৃহৎ এই সংকলন পাঠকদের
প্রত্যাশা পুরণে সমর্থ হলে তবেই আমাদের পরিশ্রম ও প্রয়াসের সার্থকতা।
কবিতাউৎসবের ফেসবুক পেজ :
https://www.facebook.com/amaderkobitautsov/ কে লাইক করে ফেভারিট করে রাখলে
কবিতাউৎসবের যাবতীয় তথ্য ও বিজ্ঞপ্তি সরাসরি আপনার ফেসবুক ওয়ালেই দেখার সুযোগ ঘটবে।
এই পেজেই কবিতাউৎসবে প্রকাশিত কবিতাগুলিও নিয়মিত প্রচারিত হয় লিংকসহ।
এবং এরই সাথে কবিতাউৎসবের ফেসবুক গ্রুপ: https://www.facebook.com/groups/kobitaautsov/# এ জয়েন রিকোয়েস্ট পাঠালে গ্রুপের সদস্য হিসাবে গ্রুপের
ওয়ালে আপনার কবিতা ও কবিতা বিষয়ক মূল্যবান মতামত সরাসরি পোস্ট করে সকল সদস্যদের
সাথে শেয়ার করেও নিতে পারবেন। গ্রুপের পিনপোস্টে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলীও
দেওয়া আছে।
এছাড়াও কবিতাউৎসব গুগুল কমিউনিটি: https://plus.google.com/u/0/communities/117144176931778027450 তে সরাসরি জয়েন করে একটি
সম্পূর্ণ ওয়েবসাইটের মতো সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। এখানে আপানার কবিতা পোস্ট করার
সুবিধা ছাড়াও আপনার নিজস্ব সাহিত্য ব্লগের লিংক নিয়মিত ব্যবধানে প্রচারের
সুবন্দোবস্ত ও অন্যান্য একাধিক বিভাগে আপনার যোগদানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে সুস্পষ্ট
নিয়মাবলীও।
***কবিতাউৎসবে লেখা পাঠানোর সাধারণ নিয়মাবলী:
১) স্বনির্বাচিত স্বরচিত ৫টি প্রিয়কবিতা পাঠাতে হবে
২) অভ্র বাংলা হরফে টাইপ করে একটি এমএস-ওয়ার্ড ফাইলে এটাচ
করে
৩) কোনভাবেই পিডিএফ ফাইল ও বিজয় ফন্ট গ্রহণযোগ্য নয়
৪) একটি প্রফাইল চিত্র
অতি অবশ্যই আবশ্যক
৬) পাঠানোর শেষ দিন প্রতি বাংলামাসের ১লা তারিখ
***কবিতাউৎসবে প্রকাশিত কবিতার স্বত্ত্ব লেখকের নিজস্ব।
কবিতাউৎসব আপনার সৃষ্টিশীলতার প্রতি ঐকান্তিক
শ্রদ্ধাশীল থেকে সবরকমের সহযোগিতার বিষয়ে সাধ্যমত অঙ্গীকারবদ্ধ। কবিতাউৎসবের সাথে
থাকুন কবিতাউৎসব আপনার পাশে রয়েছে সবসময়।