সৌরভ মজুমদার
কবিতা ঋণ
কবির প্রশ্ন, ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা !
উত্তর খুঁজি সেই কবিতার কাছে
কবি বলেন, নদীর সঙ্গে দেখা
শুনেই আমি স্রোতের ছবি আঁকি ।
কবি শুধান, অবনী বাড়ি আছ ?
নীরব হয়ে আয়নাতে মুখ দেখি
কবি যখন মেঘের মাঠে যান,
আমিও অঝোর বৃষ্টি ভিজতে থাকি ।
কবি যেদিন সাগর থেকে ফেরেন
সেদিন আমি অথই জলে ভাসি,
কবি যখন শান্তি খুঁজতে হাঁটেন
আমার তখন ফুরায় শান্তবেলা ।
কবি যখন সাম্ম্যের গান, গান
আমিও যেন ভীষণ সাম্ম্যবাদী,
কবি যেদিন দেশলাই কাঠি হন,
আমার ভেতর দাবানল জ্বলে ওঠে ।
কবি নিজেই যখন কথোপকথন এ
বিভোর বিবশ আমার স্নায়ুতন্ত্র,
কবি যখন পাগলী বলে ডাকেন
হাতড়ে বেড়াই পাগল হওয়ার মন্ত্র ।
কবি যখন দিলেন গোল্লাছুট
আমিও ছুটি এক বয়ষ্ক বালিকা
যখন কবির সু মন গর্জে ওঠে
আগুন দেখি আমি জানলায়, আর -
এক সমুদ্র ঋণ স্বীকারের মাঝে,
কবিতা আমার প্রতিটা হারিয়ে যায় ।।
সময় কমে যাচ্ছে
এক একটা রাত দু-একটা দিন হারিয়ে যাচ্ছে । ক্রমশ
।
বোধিবৃক্ষও পাতা ঝরায় ।
ক্রমশ দূরে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে, যেমন যায় । স্মৃতি ।
অথচ, জাতিস্বর সময় আকাশ খুঁজে নেয় ।
খুঁজে নেয় আলোপথ, ছায়াপথ। কত কত জন্মের
কথাদৃশ্য ওড়ে। শব্দ কত, কত নৈশব্দও । উড়েই চলেছে -
আমিও চলেছি । ক্রমশ অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। ক্রমশ
মূক, বধীর । সময় কমে যাচ্ছে …
আর ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছি আমি ।।
যেতে চাই
রাতপাহাড়ের কোটর থেকে ঝ’রে পড়া ভেজা ভেজা ঘন
অন্ধকার
আর ফোঁটা ফোঁটা নিঝুম শূন্যতা নিয়ে, যেতে চাই তোমার কাছে ।
শব্দহীন যেতে চাই । যেতে চাই অঝোর ভিজে । ক্রমাগত আছড়ে
পড়তে থাকা এক একটা দিনকে অতিক্রম ক’রে যেতে চাই ফিরে
সেই কবেকার না পাওয়াতেই । যেতে চাই দীনতার কাছে । আবার ।
যেতে চাই আরও একবার তোমার সমুদ্রে । তটে । ভাঙ্গা বাতিঘরে ।
দিগদর্শী আলোয় যেতে চাই তোমার কাছে । নোয়ার দুরন্ত নৌকার যাওয়ার
মত, মত্ত অশান্ত ঢেউপথ চিরে
চিরে । দানবীয় দোলাচলে কোমল গান্ধার
ছুঁয়ে ফিরে ফিরে যেতে চাই আড়ালের কথামালায় । তারসপ্তকের পঞ্চমে ।
যেতে চাই তোমার অন্ধকারের ছায়ায় । আমার প্রাক্তন আলোকগহ্বরে ।
প্রতিদিনের অস্তিত্ব নিয়েই যেতে চাই তোমার ভীষণ প্রচণ্ডতায় । রুক্ষবিলাসে
।
নির্লিপ্ত অবজ্ঞার তাপে পুড়ে যেতে চাই । তোমার কালো আকাশের মেঘমেঘ স্তরে,
যেতে চাই তোমারই উষ্ণতায় ভেসে, ব্যারেন আইল্যান্ডের মত।
আগুনপাহাড় ঝড়ে ।
এক একটা নিভন্ত ছাইকণার মত, উড়তে উড়তে যেতে চাই তোমার
নক্ষত্রলোকে -
সব সুর, সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে
পৃথিবীর, যেতে চাই । যেতে চাই তোমার
উদ্দেশে ।।
টুটুলদা কে
মধ্য জীবন পার করেছি অনন্ত অস্থিরতায় । থিতু আর হওয়া হবেনা আজীবন -
যেন অমোঘ এক দেওয়াল লিখন । সুস্পষ্ট । ক্রমশ যেটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে
বড় একটা দেওয়াল-ছবির অবয়ব নিয়ে ফেলছে প্রায় । টুটুল দা - আজ মন
বলছে, কথাটা আমার যতটা ততটাই
তোমারও ছিল । ঘুমের ভেতরে টুটুল দা ।
আমার নতুন দেওয়াল দেখা তোমার সাথেই । দেখেছিলাম ছায়া হরিণের খেলা ।
তোমার হাতে খরগোশ টাও গাজর খেত ছায়া হয়েই ।
আর আমি তুমি হতে চাইতাম
আমার হাত নিয়ে বারংবার । যেদিন খুব ভোরবেলা দুর্গাপূর ব্যারাজে তুমি আনন্দ
মিশিয়ে দিয়েছিলে পাথরে, জলে, আকাশে অফুরান । আমরা রঙ্গিন বেলুন হলাম ।
প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েও হাসিটুকু ধরে রাখা নিজের বউভাতের দুপুরে,
আর ধর্মযাত্রার সমস্ত আয়োজনে ক্লান্তিহীন তুমি । ঘুমের ভেতরে আমার টুটুল দা ।
সেজমামা যেদিন পাড়ি দিল চিরনীলের দেশে, নীলরতনের সেই কাটাকুটি খেলাঘরে -
শুধু তুমি ছিলে আমার পাশে । মামার পাশে । ঘর ভর্তি জীবন্ত মমি আর মৃতের ভিড়ে ।
তোমার হাত ধ’রে -
ঘুমের ভেতরে টুটুল দা । দূরে থেকে
পাশে থাকা, দেবভূমে ।
অন্যবেশে একদিন রুবির বিছানায় বসে বলেছিলে - এখনও অনেক কাজ বাকি –
সেকথাও সেদিন, যতটা তোমার ছিল ততোটাই
আমারও হল । ভুলে গেলে টুটুল দা !
বাকি কথা না বলে, চলে গেলে আমাদের ফেলে !
ঘুমের ভেতরে টুটুল দা । চিরঘুমে ।
ল্যান্ড করলাম
এইমাত্র
ল্যান্ড করলাম এইমাত্র । সেই কথাই বলছি, হ্যাঁ । না, স্মুথ ল্যান্ডিং । এক্সিট -
দরজা
খোলেনি, হ্যাঁ - এখনও । এখন ! না, টারম্যাকে । আমাকে নিয়ে আর চিন্তা কোরো না ।
হ্যাঁ ট্যাক্সিওয়েতেই আছি । না, চলে যাব ট্যাক্সি নিয়েই ।
হ্যাঁ তো ! একেবারে সোজা,
না ! তোমাদের কাছেই । হ্যাঁ, কাছেই তো ! তো, সময় ঠিকই নিলো । নীল এরওব্রিজ -
লেগে গেছে । গুছিয়ে এনেছি । এনিবডিস গেম । গেমিং সিডি, হার্ডডিস্ক, ল্যাপটপ, ফ্রিজ -
থেকে আগেভাগে বের করা প্রি-কুকড খাবারের প্যাকেট । প্যাক করা সব ফয়েলে ।
তোয়ালে
টাও নিপাট ভাঁজ ক’রে । ওরে, সহজ কাজ নয় । নয় নয় ক’রে কম দিন তো হলনা ।
হ’লে,
লাউঞ্জে, কত কত মুখ । সুখ থিকথিক ।
চিকচিক দুঃখঝরা । কড়া-নরম চোখের ভিড় । ধীরস্থির
ল্যান্ড করলাম এইমাত্র । যত্র তত্র, অন্য জীবনে । জীবন আমার এখনি শেষ না হওয়া তরজা...