সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
জনৈক ধর্ষকের মৃত্যু
*****************
উঃ, একটু হাওয়া নেই, একটু বাতাস চাই---
দাও না গো একটু হাওয়া,
দম বন্ধ হয়ে আসছে যে আমার---
বাপটু, কোথায় গেলি বাপ?
ইনহেলারটা ফুরিয়েছে তিন দিন আগে,
বলেওছিলাম তোকে--
আজ আনছি, কাল আনছি বলে
আনলি না এখনো!
ও বৌমা, মাথার দিকের জানলাটা খুলে
দাও না,
একটু বাতাস আসুক--
আমার যে নামার শক্তিটুকুও নেই আর--
নাঃ, কেউ নেই আশেপাশে, কেউ না!
নিজেই নামি---
পারব না? এই তো মোটে ক'পা--
পারব না?
কি দেখছ পুতুল, অমন করে?
খুব মজা লাগছে, না গো?
ভাবছ-- সারা জীবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করেছে
লোকটা,
বেশ শাস্তি পাচ্ছে! পাক! আরো কষ্ট পাক!
তিলে তিলে শেষ হাওয়াটুকু
ফুসফুস নিংড়ে বার করে নিক মরণ!!
ঠিক ভাবছ, পুতুল!
ঠিক!
কতবড় অমানুষ আমি গো,
বিয়ের রাতে জানতুমও না,
তোমার মনের মানুষ আছে ভিন শহরে।
রুখুমাথা, সিড়িঙ্গে হরেন দোকানি,
আমি,
অমন চাঁদপানা বউ পেয়ে কেমন বোকা বনে গেলুম।
বোকাই তো!
বাতি নেবানো বিছানায়,
আমার অমন পাগলা সোহাগ সয়েও,
তুমি কখখনো বলোনি পুতুল--''এই, আমার লাগছে!''
আমি ভাবতুম, কাঠকে আদর করলেও বোধহয় এর
চেয়ে বেশি নড়ে চড়ে!
ওফ্! আর পারিনা! জানলার পাল্লা দুটো লোহার মত
ভারি যে!
খুলব কি করে??
ও বাপটু! একটু আয় বাপধন আমার!
একটু খুলে দে না--
তোর বাপ যে আকুলি বিকুলি করে---
হদ্দ বোকা নয়ত কি?
বিয়ের সাতমাস পরে বাপটু হলো--
মোটাসোটা নধর ছেলে!
ষষ্ঠীপুজোর দিন ধাইকে লুকিয়ে,
আঁতুড়ে ঢুকলুম আমি--
সেই প্রথম, তুমি মুখ সরিয়ে নিলে,
আমার চুমুতে নাকি বিড়ির গন্ধ-- গা গুলিয়ে ওঠে!
আমি গুটিয়ে গেলুম পুতুল,
অবিকল কেন্নোর মত!
আর একদিন, খুব জ্বর এসেছিল আমার,
মনে পড়ে?
বেলাবেলি দোকান বন্ধ করে বাড়ি এসে দেখি--
দোরে খিল তোলা,
কান পেতে শুনি,
ভিতরে খিলখিল হাসি--
''ছাড়ো না, কি হচ্ছে?
পারোও বাপু তুমি!!!
ধ্যাৎ! অসভ্য!!---''
তোমার ভিনদেশি নাগর!!!
দরজা ঠেঙাতেই,
সে পালিয়েছিল বীরপুরুষের মত--
একবার, শুধু একবার মনে হয়েছিল,
তোমায় কোমরের বেল্ট খুলে মারি, সিনেমার নায়কদের মত---
কিন্তু হরেন দোকানির মালকোঁচা মারা আধময়লা
ধুতিতে,
বেল্ট বাঁধার ধক ছিল না যে!
তার বদলে, পুতুল, আলুথালু তোমাকে নিয়েই,
ওই এলোমেলো বিছানায় ঝাঁপিয়েছিল হরেন দোকানি,
গায়ে কি জোর,
তুমি চেষ্টা করেও সরাতে পারোনি--
কেবল, দুচোখে আগুন জ্বেলে,
সাপের মত হিসহিস করে বিষের মত, একদলা ঘেন্না ছিটিয়েছিলে--
''ইইইস!! পুরুষ হয়েছেন!
পুরুষ!!!''
আমার বীর্যে আর চোখের জলে,
মাখামাখি হয়েছিলে সেদিন,
মনে পড়ে, পুতুল?
সেদিন, তুমি চিৎকার করেছিলে--
''সরে যাও জানোয়ার,
আমার লাগছে!''
মনে পড়ে?
আমি ছিলুম পুতুল,
এখনো আছি--
বাপটুকে কেউ বেজম্মা বলেনি কোনদিন,
আমি ছিলুম বলে।
তবু আমার ফুরিয়ে যাওয়া ইনহেলারটা,
ও বেবাক ভুলে গেল কেন?
আমি ওর কেউ নই বলে?
তুমি তো ওর মা--
তোমার ছবির মালাটা,
বাসি হয়ে গেছে কবে,
ওর চোখেও পড়ে না?
আমার জানলাটার মতো,
তোমার মালার কথাও ভুলেছে বাপটু,
না গো?
নাঃ, আর পারছি না ঠাকুর,
পা দুটো বড় থরথর করছে,
বুকের মধ্যে একটা লোহার বল
ড্রপ খাচ্ছে যেন--
একটু হাওয়া দেবে গো কেউ, হাওয়া?
কেউ নেই, পুতুল, কেউ নেই,
বাপটু নেই, বৌমা নেই,
হাওয়া নেই, মালা নেই,
তুমি নেই, কেউ নেই--
শুধু একটা খাপছাড়া আদর নিয়ে হরেন দোকানি পড়ে
আছে--
আমি তোমার কাছে যাব পুতুল,
তোমার কাছে যাব!
বেলুনওলা বুড়োর কাছে,
বাতাস ধার নিয়ে,
রঙবেরঙের ইচ্ছেবেলুন চেপে,
আমি তোমার কাছে যাব!
একদিন ঠিক তোমার কাছে যাব!
ভালবাসা ভালবাসি
******************
তোমার হাতের ওপর আমার আকুল দু'হাত রাখতে দিও-
লাবণ্যহীন রুক্ষ চুলে,
তোমার স্পর্শ মাখতে দিও।
ঝড়ভোলানো অরণ্যগান, শুকনো ঠোঁটে আঙুল-আদর,
তোমার বুকে রাখলে মাথা, আমার চোখে শাওন-ভাদর--
বকুলবাসর না-ই বা থাকুক, ফুল বিছোনো চাঁদ-চরাচর,
একটি চুমুর জন্য আমি ভাঙতে পারি লক্ষ পাথর!
হৃদয়ছেঁড়া সর্বনামে, একটু শুধু ডাকতে দিও,
আঁচলঘেরা দীপের মতো,
অন্ধরাতের তারার মতো,
তোমায় ভালবাসতে দিও,
একটু ভালবাসতে দিও।
আই সি ইউ, ডিসেম্বর, ২০১৬
***************************
যান্ত্রিক শীতঘুম, অবিরাম সাপলুডো খেলা
মনিটরে জিংগল বেল বাজে,বয়ে যায় বেলা।
ঠান্ডা বিছানা আর মুখোশের হাওয়া-রা তো জানে,
জীবনের অঙ্কের চুলচেরা হিসেব এখানে।
ক্লান্তি ফেলেছে ভাঁজ, ছটফটে সাদা অ্যাপ্রনে,
মেয়াদ ফুরোনো শ্বাস বাড়তি সময় বৃথা গোনে।
সঞ্জীবনীর এই কস্তুরী গন্ধের লোভে,
জিয়নকাঠির ফেরিওলা ভাবে আঁধার ডিঙোবে---
কোষ থেকে কোষে শুধু জীবাণুরা বিলি করে ক্ষয়,
ড্রিপের তরল জানে, এ লড়াই ছেলেখেলা নয়।
বৃত্তেরা ছোট হয়, শমন পায়ের ছাপ আঁকে--
যুদ্ধ থামে না তবু, বাঁশের কেল্লা খাড়া থাকে।
তলোয়ারে শান দেয় পরাজিত সেনাপতি, রোজ-
অসহায় উটপাখি, বালিয়াড়ি করে চলে খোঁজ।
ফিনিক্স
*******
হিমঠান্ডা লোহার টেবিলে,
কিছু মুহূর্তরা অপেক্ষায় আছে--
মাথার ওপর জ্বলা উজ্জ্বল বাতিটা সাক্ষী।
বাতি? না কি ঈশ্বরের চোখ?
হ্যাঁ, ঈশ্বর অমনই একচক্ষু বটে!
অনাদিকালের সেই ভূমিকম্পে
কেঁপে ওঠে প্রসূতি পৃথিবী,
পিচ্ছিল, রক্তিম এক দমবন্ধ অন্ধকার
পথ,
একলা পেরোয় প্রাণ---
পরিচিত গহ্বর থেকে, উঁকি মারে অচেনা উঠোনে,
ঈশ্বরের চোখে,
তার অনাবিল চোখ রাখবে বলে।
''অ্যাই মেয়ে, চেয়ে দেখো, কি হয়েছে বলো?''
চেয়ে দেখে,
কচিদেহে খোদাই রয়েছে,
ভবিষ্যৎ কামনার ডাকবাক্স,
বিধাতা(পুরুষের?) সে চিঠিটির নির্ভুল স্বাক্ষর।
কেঁদে ওঠে অকারণ--
''কান্না কেন?'' বারোয়ারি লিপিকার প্রশ্ন করে,
খেরোর খাতাটি হাতে নিয়ে--
''যে কষ্ট আমি পেয়েছি, সে যন্ত্রণা মেয়েও পাবে তো একদিন!''
নির্বোধ মানবী তবু বোঝে না,
সে ঈশ্বরী আজ--
জলভরা দু'চোখের কোলে তার
জমা হয় আগামীর ঋণ।
প্রেম, কাম, নিষেকের চাকা ঘোরে,
বোবা ইতিহাস--
জরতী ধরিত্রীর যোনিমুখে,
শস্যলোভী কর্ষকের অর্থহীন আদিম উল্লাস।
সময়
*****
চোখের ওপর হাতের বারান্দা রেখে
আকাশ দেখে লোকটা ----
রোদের
রঙ দেখে মাথা নাড়ে,
এক্ষুণি ঝমঝম করে বেরিয়ে যাবে
আটটা সাতাশের ট্রেন----
ওর হাতে
ঘড়ি নেই, তবু,
ও জানে
।
ছায়ারা আরেকটু লম্বা হলে
বুকের কাছে বাহারি ব্যাগ ধরে
এক ঝাঁক সবুজ টিয়ার মতো,
বেরিয়ে আসবে সরলা ইস্কুলের মেয়ের দল ---
ও ছুটির
ঘন্টা শোনেনি, তবু,
ও জানে।
ফুটপাথি চায়ের দোকানে, কালো কেটলিটা থেকে,
ময়লা কাঁচের গ্লাসে ঝপঝপ চা ছাঁকে কালু---
ঠিক আর পনের মিনিট বাদে,
ওর ভিতরে কি যেন একটা টিকটিক করে বলবে,
ওর খিদে পেয়েছে ----
দুটো পোড়া রুটি, ওবেলার বাসি তরকারি
আর এক কাপ চায়ের একঘেয়ে খিদে ।
ও টাইম দেখতে পারে না, তবু,
ও জানে ।
অনেক তারার মাঝে সন্ধ্যাতারাটি হারিয়ে যাবার
পরে,
রাত গাঢ় হবে।
শব্দ করে গুমটিতে ঢুকে যাবে লাস্ট বাস ---
ঠিক তক্ষুণি, দরমার বেড়া ঠেলে,
বুকের আঁচল খসা মালতী দাঁড়াবে এসে,
ধ্যাবড়ানো কাজল আর শুকনো পানের রসে
কামনা ফুটিয়ে ---
ও মুখ ফিরিয়ে নেবে হাবলার মতো,
যেমন রোজ নেয়,
ওর শরীরে যে কোনো বাজনা বাজে না আর,
ও জানে।
পার্টি অফিসের দালানটা কেমন ঘেরা,
শোবার সুখ আছে খুব ---
মাঝরাতে অনেক পায়ের শব্দ, হুটোপাটি, গোলমাল,
বোমা ফেলল কারা যেন --
একটা, দুটো, তিনটে ---
তীব্র হুইসল, গাড়ির আওয়াজ, আর--
গুলির শব্দ!
ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল ও,
হঠাৎ, গরম সীসের মতো কি একটা ঢুকল
পাঁজর ঘেঁষে।
অন্ধকার, যন্ত্রণা, অন্ধকার ---ব্যস!
ও জানল না, শেষটা কেমন হয়।
আধপোড়া পতাকা আর টলটলে রক্তের মাঝে,
হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে,
ও জানতেই পারল না,
ও নিজেই সময় হয়ে গেছে ।