অভিজিৎ পাল
আত্মহননের আগে - ১
রতিপত্র মেলে ধরি। বিছানাময় ছড়িয়ে রাখি
স্বপ্নের এলোমেলো দাগ। ক্যাম্পাসে ভরে রাখি আমার চাওয়া আর পাওয়ার মাঝ বরাবর জমে
থাকা দূরত্ব বিষয়ক পাঠমালাকে। নেমে আসছে গোধূলি রঙ। বিষাদগুলো ছুঁরে মারি
ক্যানভাসে। বিষাদরঙা ছবি সেজে ওঠে দুঃস্বপ্নের স্বরলিপি হাতে নিয়ে। আরও অনেক পা
হাঁটতে চাইতাম। দ্বৈতজীবন আর দ্বৈতমৃত্যুর স্বপ্ন আঁকতাম হাতে হাত দিয়ে। ক্যানভাস
ছুঁয়ে বাঁচতে চাই। সব রঙগুলো কেমন যেন বিষবর্ণ নীল হয়ে আসছে..
আত্মহননের আগে - ২
ক্ষয়ে যাচ্ছি তো দিনে দিনে। বাবার মতো মেরুদন্ডী
হতে পারি নি কখনই। পেলব অমেরুদন্ডী হয়ে অবলম্বন বেঁধে বেঁধে কাটিয়েছি আমার
উচ্চশিক্ষিত বেড়ে ওঠাকে। রাজনৈতিক পতাকার কাছে বন্ধকী হয়ে পড়ছি। আজানুলম্বিত এক
মৃত্যুবাসনা জমাট হয়ে আসছে। আয়না থেকে সরিয়ে নিচ্ছি মুখ। মুছে গেছে নিজের চোখের
উপর চোখ রাখার অদম্য সাহস। ফ্যাশব্যাকে নড়ে ওঠে বিজয়কেতন। যান্ত্রিকভাবে ফিরে
তাকাই দু'হাতে আকাঙ্ক্ষিত পুরস্কারগুলোর ধূলো মাখতে
মাখতে..
আত্মহননের আগে - ৩
মেঘের 'পরে মেঘ জমছে জানলার
শার্সিতে। ছোটবেলায় এই জানলায় ঠোঁটের বাষ্পে দিয়েই বুঝেছিলাম পাহাড় আঁকা কত সোজা।
একটা বহুদিনের মন খারাপ এসে লাগছে ধূমল ক্যানভাসে। ছবিটা বড় বেশি চেনা। বড় বেশি
আমার। ঐকান্তিক একাযাপনে মেনে নিচ্ছি ক্রমশ। বিকৃত গবেষণার পাঠ শিখেছি। প্রয়োজনীয়
শর্তাবলী মানতে না মানতেই বুঝেছি, সব নিয়ম কখনই আমি অতিক্রম
করতে পারিনি। আমার পা এখনও শিকলকেই ভালোবাসতে পারে। সেখানে কোনো নতুন জীবনভয় নেই..
আত্মহননের আগে - ৪
মেনে নিতে শিখি প্রতিবন্ধকদের। জীবন বিষয়ক
পাঠমালা থেকে সরে আসি। যন্নেহাস্তি শ্লোকের শব্দব্রাউজ হয় জট পেকে আসা মাথার ভিতর।
ডানা ঝাঁপটায় সোনালী ডানার চিল। শঙ্খ চিল ঘুমিয়ে পরে আনমনে। বিষণ্নরেখায় এঁকে
দিচ্ছি আমার যাপনগুলো। আমার পাশে এসে বসে ভুসুকুপাদ। হাতে তুলে দেয় এক পেয়ালা
পানযোগ্য বিষ। তুলে ধরি হাতে একটা অপরাধবোধ নড়ে ওঠে বিজয়কেতনের ছিঁড়ে পড়া দেখে।
জীবনের মানেটা আমার কখনই সঠিক শেখা হয়নি..
আত্মহননের আগে - ৫
পুরাধুনিক পাঠের পর আমার কাছে এসে দাঁড়ায়
কালকেতু। হাতে তার বিষের বাণ চকচক করে ওঠে। শিকার সেজে ঘুরে বেড়াই। আর্কষণ করি
ব্যাধের চোখ। একটু একটু করে আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাই। মঙ্গলকাব্যের রেখা ধরে চলি
একা একা। মধ্যযুগের ভাষ্যেই অজুহাত দিয়ে প্রবোধ দিতে শিখি নিজেকে। আমোদর নদের পাশে
দাঁড়িয়ে আছে শব্দরা। এখনও সময় আছে। আমার কাছে এসে দাঁড়ায় নি একটাও হাসিহীন
সাদামুখ। কবন্ধের সাথে মিশতে পারি নি এখনও। বিচারপন্থী মহামান্য জানিয়েছেন, আমার মতো টিউশনজীবির মৃতদেহের সরকারী পরিসংখ্যান কখনই সঠিক
দেওয়া চলে না
আত্মহননের আগে - ৬
কাগজের ভাঁজে জমিয়ে রেখেছি ইচ্ছেদের। উপার্জন
কমে এলে মানুষেরও দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। দরজার কাছে মুখোমুখি দেখা হলে সর্বানী
তাকিয়ে হাসে মাঝে মাঝে। মুখে ওর বিষাদরঙা হাসি। আমার মানুষঘর নেই। ছিলও না হয়তো
কখনও। মেপে নিতে পারছি ডিজিট্যাল দূরত্ব। কম্পিউটার থেকে চোখ সরাই। সিলিং ফ্যান
চেয়ে চেয়ে হাসে এক ব্যঙ্গাত্মক ক্রূর হাসি। সস্তা হয়ে ওঠা আমার ভাবনারা জোয়ার
তুলতে চেয়েছিল কোনো এক আদিম সময়। ভুলে যাই। আশ্রয় খুঁজতে চাই চিরন্তনী সেই
অন্ধকারে..