রেজওয়ান
তানিম
সকালগুলো
অসমাপ্ত
এক
আমার চোখের ভেতর লেখা আছে এক পৃথিবীর অসমাপ্ত আর্তনাদ!
আর্তনাদগুলো কেমন ঝাঁক বেঁধে চলে, বাসা
বাঁধে শহরের শেষ কানাগলিতে।
অপরিশোধিত বিলাপেরা কান্না শেষ করার আগেই নরকদ্বারে উপস্থিত হয়ে
দেখতে পায়, সেখানে এখন কক্ষ বরাদ্দ চলছে।
সকালগুলো স্থবির, নির্জীব।
নেশাগ্রস্থের মত নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে নিঃস্ব হতে এসেছে। অনির্বচনীয়
আতঙ্ক
ও অনিশ্চয়তা সারারাত ওদের উপর্যুপরি ধর্ষণ করতে থাকলেও টের পাওয়া যায়,
তৃষ্ণার তাড়নায় ওরা প্রাণপণ ডানা ঝাঁপটাচ্ছে
অভিশাপের অম্লজানে স্নান করবে বলে।
ওরা ডানা ঝাঁপটায় আর দেখতে পায় চারপাশ বদ্ধ এক খাঁচার উপরটা শুধু
খোলা।
খাঁচার ভেতরে অদ্ভুত সাম্যবাদী শাসন চলছে, তাকে নির্ভাবনার নরক নাম দিয়ে খুব
আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে পালক ছাড়া কয়েকটি বিবর্ণ দোয়েল!
ওরা জানেনা, খুব কুৎসিত লাগে দেখতে,
একটা পালক ছাড়া দোয়েল!
দুই
নরকে নারকীয় বিষয়াদি ঘটতে থাকে নিতান্তই ভাবলেশহীন ভাবে।
ফুলের বাগান দলে যাওয়া পিশাচেরা একটু পরেই ফিরে এসে মায়াকান্নার
প্রদর্শনী তোলে।
বিশুদ্ধ প্রেমের তৃষ্ণায় চুম্বনরত তরুণ তরুণী দগ্ধ হওয়ার অব্যবহিত পরে
শুনতে পায়,
এ আগুন আসলে পাপ। পাপের শাস্তি, অভিশাপ।
বোধ হয় আসলেই তাই, এখানে
হাজার বছর ধরে মূর্খ সৈনিকের তলোয়ার
পরপারে চালান করে আসছে ঋষিতুল্য আর্কিমিডিসদের।
নরকে থরে থরে সাজানো থাকে বিষাদ!
সুখের মোড়কে ওরা বিক্রি হতে থাকে। অযাচিত ছাড়ের মৌসুম চলছে বলে মূল্য
খুবই কম, ফালি ফালি করা কয়েক টুকরো
অসুখ মাত্র।
আমাদের তাবৎ সকালগুলো অসমাপ্ত!
আর অসমাপ্ত যে কোন কিছুই এখন সম্ভবত
ম্যারিনেট করা মরা মুরগীর মত অসুস্থ।
তিন
সকালগুলো এত বর্ণিল কেন?
অন্ধকারকে প্রশ্ন করতেই ও হতবাক হয়ে যায়!
নিরবচ্ছিন্ন নিমগ্নতায় ডুব দেই একটা অন্ধকার সকালের খোঁজে।
দূরবর্তী বাতিঘরটা যখন থেমে থেমে লাল সংকেত দিতে থাকে, কেমন যেন
মাতালের মত মনে হয় নিজেকে আমার। মনে হয়, নগ্ন হয়ে আছি আমি!
আমার নগ্নতা দেখে হাসছে অবিশ্বাসী চাঁদ।
ঈশ্বর আমার কানের কাছে পারাতো বখাটের মত শিষ দেয়, বোবা পাথর জিহ্বাগ্র
বের করে দেয় ভেংচির ইমো, মনে
হয় অর্থহীন এ জীবনযজ্ঞ!
লেলিহান অগ্নিশিখায় নেমে পুড়তে থাকি অদৃষ্টের সাথে।
হায়, অদৃষ্টও আজ আমাকে ফেলে
গেছে সমাজসিদ্ধ অসুখের কারখানায়। আজকাল
ছবিরা আগুন দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর দ্যায়, আর কর্তব্যরত জলেরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে তা
দেখতে থাকে।
সকাল বেলায় আগুন, নগ্ন
বিবেকে ছাইয়ের প্রলেপ মেখে দ্যায়! আমরা ওতেই
স্বস্তিতে লজ্জা নিবারণ করি।
চার
নরক থেকে বার্তা এসেছে, আমার
মৃত্যু নিজস্ব নৌপথে!
আমি জানি, আমার হাতের উপর
স্রোতস্বিনী শঙ্খ ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে।
পথক্রম লিখে রেখে গেছে অনাহূত অদৃষ্ট! স্রোতের তোড়ে ভেসে চলছে শাদা
কয়েকটা
গুণটানা কাগজের নৌকো।
নৌকোর তলায় মোম লাগাবার কথা,
অথচ কেন যেন লাগানো হয়না, আসলে
মনে থাকে না।
একুশ বছর ধরে ক্ষয়ে যাচ্ছে একা একা স্মৃতির সিন্যাপ্স।
শুকিয়ে যাওয়া স্নায়ু ভুলে যাচ্ছে জীবনের শিশুপাঠ গুলো।
পৃথিবীর কোথাও এখন মোম লাগাতে ভুলে যাওয়া কোন এক বেভুল যুবকের জন্য,
আর কাঁদে না বেহুলারা। এখন তারা বাসর রাতে ঘুমুতে শুরু করে বিচূর্ণ
আর্তনাদ,
অলংকৃত অন্ধকারে দু’পায়ে
দলে।
বিষের ছোবলে নীল লখাইদের নিস্তেজ চোখের তারায়
শুধুই বেদনা ও বিস্ময়!
পাঁচ
শহরের অন্দরে আসন গেড়েছে নরকের নিজস্ব দূত।
সর্বত্র এখন সাপের বন্যা,
শহর বেঁচে আছে শতপদীদের গতির পিঠে ভর করে।
চোখের কোণে ঈর্ষা আমার, অভিব্যক্তিতে
বিস্ময় আর ঠোঁটের কোণে আলতো বিদ্রূপ।
মর্মর সমাধি গড়ে শূন্যতার অন্ধজীবন সুরক্ষিত ও জমকপূর্ণ করে গেছে
ঈশ্বরের সমান
মানবেরা। তারাই আজ পূজো করছে স্বর্গচ্যুতির বাহনকে।
ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়ছে দেবালয় অথচ পেট ভর্তি মানুষ নিয়ে দুলে দুলে
ভেসে
বেড়াচ্ছে-পথে ও প্রান্তরে নানা রঙের সাপ!
নরকে বিস্ময়ের ধ্বনি জাগে!
ভীষণ ব্যস্ততায় সকাল, দুপুর,
রাত-ওরা চলাচল করে, সময়কে বন্য কুকুরের মত
লেলিয়ে দিয়ে। পাঁজরে আঁচড় কাটে পুরাণের পাখি,
সাপের পিছে পিছে নাচতে থাকে আট কোটি পৃথিবী!
ছয়
সাপের চেয়েও নিজেকে ঢের অসহায় মনে হয়
এখন আমার!
যে সাপকে আমরা সাদা, লাল,
হলুদে সাজিয়েছিলাম নিজেদের প্রয়োজনে,
সে এখন ঢের সুখে আছে গতির উঠোনে। উল্টো আমরাই বন্দি নিজস্ব নরকের
কানাগলিতে।
এখন ভাবতে থাকি প্রায়ই, সাপ
হয়ে যাই আমিও!
ঢুকে পড়ি নিস্তব্ধ গোরে, শীতনিদ্রা
কেমন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। গত বছর চিঠি পাঠিয়েছিলাম গোররক্ষকের কাছে, মৃত্যুর আগে নো এন্ট্রি বলে ভিসা রিজেক্ট করেছে বানচোত অফিসার।
ওর জানা নেই, আমি আর মানুষ নই-এখন আমি
সাপের মতই শীতল।
আমার পায়ের কাছে খেলা করা সকালগুলো
আগুনে পুড়তে থাকার সময়েও নির্বাক। দেখতে থাকে
কেমন করে জ্বলে যাচ্ছে ইডেনের সুখ!
সাপেরা আগুন ভালবাসে বোধ হয়, তাই
শুরতেই
পছন্দ করে নিয়েছে নরক।
সাত
পরাজিত পৃথিবীতে সূর্য থাকে না, যেমন
নরকে নেই!
সূর্যটাকে আজকাল কেমন যেন একটা বড় আয়নার মত মনে হয়!
যে ভুল করে নরকে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
সে আয়না আবার একইসাথে আতশ কাঁচ। উন্মুক্ত করে দেখায়, কেমন করে পুড়ে
যাচ্ছে ভিতরটা, চাপ চাপ মাংস গ্রিল হয়ে
গন্ধ ছড়ায় আমার শারীরিক অন্দরে।
সূর্যের চোখে চেয়ে আমি পড়তে চেয়েছি
আগামী শীতের শিলালিপি।
নরকে আর জ্বলবে না অগ্নিশিখা, জমে
যাবে নগ্ন জলাশয়, কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে
থাকা সারি সারি ওক, তোমাকে
দেখে নেচে উঠবে বেদনার নূপুর খুলে!
এবারের শীতের শুষ্কতায় শরীরে নুনের ঘাটতি দেখা গেলে,
করুণা করে হলেও মেখে দিও এক মুঠো সৈন্ধব।
জন্মান্ধ বিশ্বাস অপেক্ষার অন্ধ প্রহর ডুবে যাক বর্ণময় ফেনিলতায়।
নোনা গন্ধে হারিয়ে গিয়ে মেঘেরা জাল বুনতে থাকুক
অসমাপ্ত সকালগুলোয়।