কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার ফাল্গুন ১৪২৩
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। ‘কবিতা আর বাঙালি:
বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ
যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের
অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি।
আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের
শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল
প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে
এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
নাসরীন: সেই শৈশব থেকে অ আ ক খ শেখার আগেই বাঙ্গালী
পরিবারের ছেলেমেয়েরা মা খালা ঠাকুরমার কাছে ছড়া কাটতে শেখে। অ তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে বা আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের
কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। কত কত ছড়া। একটু বড় হতে আমরা বই, খবরের কাগজ ইত্যাদিতে কবিতা পড়ছি কবিতা ভালবাসছি, কবিতায় উৎসব করছি। মূলত শিশু বয়স থেকেই আমরা কবিতার যে আবহে বড় হই সেখান
থেকে কবিতার প্রতি এই ভালবাসা জন্ম নেয়। এমন কোন বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি জীবনের কোন
না কোন সময়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেননি। এখন প্রশ্ন হল আমদের চারপাশের পরিবেশ আমাদের লেখাকে
প্রভাবিত করে কিনা। অবশ্যই এর প্রভাব রয়েছে। যেমন আমরা যখন চাঁদ রাতে আকাশ দেখি তখন আবেগ তাড়িত
হই। বোধ হয় এই মুহুর্তটাকে কোন কাব্যে বেঁধে রাখি। আবার বসন্তের হুহু করা হাওয়াও
তেমনটি আবেগ তাড়িত করে আমাদেরকে কবিতায় আনে। তাই বলে পরিবেশ সবটুকু নয় বা কবিতার আবহ পুরোটা নয়। সেটা হলে সকলে কবি হতেন। নিজের মধ্যে সৃষ্টি করার ক্ষমতা
থাকতে হবে এবং মানসিকতাও থাকতে হবে। কিছু কবিতা লিখলেও আমি মূলত একজন গল্পকার। সত্যি কথা বলতে আমার লেখালেখির
ক্ষেত্রে আমার চারপাশে প্রবহমান জীবন যাত্রার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যার কারণে আমার বেশীরভাগ লেখাই জীবনঘনিষ্ঠ।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য
কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে চাইছি
জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক
হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
নাসরীন: এই হুজুগ কথাটি অনেকেই বলে
থাকেন। আমি বুঝতে পারিনা মানুষ হুজুগে পড়ে শাড়ী গয়না চটি কিনতে পারে। সিনেমা দেখতে পারে কাব্য সাধনা কিভাবে হুজুগে সম্ভব? মানলাম বন্ধু বা পড়শির কবিতা পড়ে বা কবি হিসেবে সামাজিক অবস্থান
থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ দুটো কবিতা লিখে ফেলল কিন্তু সে কি হুজুগে কবি হয়ে উঠতে পারবে?
কবি হতে গেলে কবিতার সাথে ঘুমুতে হবে খেতে হবে বেড়াতে হবে। হুজুগে সেটা সম্ভব নয়। সবথেকে বড় কথা কবিতা সৃষ্টির
জন্য শব্দের সাথে, ভাব ভাষার সাথে আত্মিক যোগাযোগ থাকতে
হবে। সেটা ব্যক্তিগত, সামাজিক নয়। কবিতা সৃষ্টি এতটাও সহজ নয় যে
যে কেউ কবি হিসেবে সামাজিক পরিচিতি পেয়ে যাবে।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা বলতে আপনি
কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে করেন কবিতারও
একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক
দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যিকের
সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? যেমন ধরা যাক একুশের চেতনা। বাংলা ভাষার স্বাধিকার বোধ। এইসব বিষয়গুলি। মুক্তিযুদ্ধের
অপূর্ণ লক্ষ্যগুলি।
নাসরীন: শুধুমাত্র শিল্প সাহিত্যের
জন্যেই কাব্যচর্চায় আমি একদম বিশ্বাসী নই। অন্যদিকে শধুমাত্র সমাজ সচেতন হয়েই
সাহিত্য চর্চা করতে হবে সেটাও ভাবি না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, আমার যে সৃষ্টি
সমাজের কোন কাজে আসবে না সেই সৃষ্টিতে আনন্দ কোথায়?
দেখুন বিশ্বের যে কোন বিপ্লব আন্দোলনের গতিপথের দিকে নজর দিলে দেখতে পাব সেখানে সাহিত্যিক
সমাজের বিশাল একটা ভূমিকা থাকে। বলা হয় অসি থেকে মসির শক্তি অনেক বেশী। এটা প্রমাণিত সত্যি। আমি মনে করি গল্প কবিতা উপন্যাস যাই বলুন তার মধ্যে সমাজের জন্য, মানুষের
জন্য কিছু মেসেজ থাকতে হবে। সমাজের ধূসর বা অন্ধকার জায়গা গুলোতে লেখার মাধ্যমে ফোকাস করা, সেই জায়গাটুকু
কিভাবে আলোকিত করা যায় তার জন্য দিক নির্দেশনা দেওয়া এগুলো আমরা খুব সহজেই করতে
পারি। একটি চরিত্র বা দু লাইন
কবিতা দিয়ে কোন বিষয়কে মানুষের সাথে পরিচিত করে দেবার সামর্থ্য শুধু কবি লেখকদেরই
রয়েছে। আমার নিজস্ব সাহিত্য চর্চার কথা যদি বলেন,আমার গল্প বা উপন্যাসে আমি এই
কাজটি করার চেষ্টা করেছি। এই যেমন ২০১৬ এর বইমেলায় প্রকাশক আমাকে বললেন আমি যেন বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত বাস্তব কোন ঘটনার উপর ভিত্তি করে একটি উপন্যাস লিখি। ‘জল ঘুঙুর’ নামে একটি উপন্যাস আমি লিখেছি যেখানে
আমাকে নানা ধরণের সত্যিকার তথ্য উপাত্ত দিয়ে কাহিনী সাজাতে হয়েছে। এতে কিন্তু পাঠক মুক্তিযুদ্ধের কথা কিছু
চরিত্রের মাধ্যমে জানতে পারছেন। সুতরাং কাব্যচর্চায় সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার নয়।
কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে
এইকথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন
করে তুলতে পারে? এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
নাসরীন: দেশপ্রেমের সাথে আমি
কোনকিছুকে গুলিয়ে ফেলতে চাই না। একটি দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম থাকাটা
জরুরী তা নাহলে সেই দেশের উন্নতি প্রগতি কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর সাহিত্যিকের বিষয়টি
তো আরও গুরুত্বপুর্ন। সাহিত্যিক তার সাহিত্যের মাধ্যমে দেশপ্রেমে মানুষকে যতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারেন
সামাজিক নানা বিষয়ে সচেতন করতে পারেন অন্যদের দ্বারা সেটি সম্ভব নয়। সাহিত্যিকের মধ্যে যদি কোন দেশপ্রেম না থাকে
তাহলে আমার মতে তার সাহিত্যকর্ম একপেশে, অসম্পুর্ন, অন্ধ। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের
সাথে আমি সাহিত্যের কোন যোগসূত্র খুঁজে পাই না। কে কোন ধরণের রাজনীতিতে বিশ্বাস
করবেন সেটা তার সম্পুর্ন ব্যক্তিগত বিষয়।
কবিতাউৎসব: আবার এই সমাজসচেতনতার
ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন? কবি জীবনানন্দ যেমন
জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
নাসরীন: কবিতা দুভাবেই লেখা সম্ভব। কখনো কবি নির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতনভাবে লেখেন, কখনো
ঘোরের মধ্যে। সচেতনতার ক্ষেত্রে ইতিহাস ঐতিহ্য আসতে পারে কিন্তু সমাজসচেতনতার
ভিত্তি সবসময় ইতিহাসবোধের উপর লিখতে যাওয়াটা আমার হিসেবে জরুরী নয়। সাহিত্য স্থান কাল মানে না। তাহলে সেটা গণ্ডীবদ্ধ হয়ে যাবে। গদ্য সাহিত্যের
ক্ষেত্রেও তাই। কালের কথা বলতে গেলে বলতে হয় আমরা যখন যে কালে বাস করছি সাহিত্যে
সে কালের দাগ থেকেই যায়। কিন্তু কালের উর্ধে গিয়ে কবি কিন্তু
অন্য জগতে অন্য সময়ে বসেও কবিতা রচনা করার ক্ষমতা রাখেন। কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতাতেও কি কালের বাইরের
কোন কবিতা নেই?
কবিতাউৎসব:: এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ
করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু
সেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার
স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে? বিষয়টিকে
আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের
আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি
কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
নাসরীন: দেখুন সাহিত্যের কোন বেড়া নেই, স্থান নেই, কাল নেই বলেই আমি মনে করি। আমি আমার পরিবেশে থেকে, আমার সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বাস করে কোন কাব্য বা উপন্যাস যদি রচনা
করি তাহলে সেটা কি পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলে বা কোন পরিমণ্ডলে গ্রহণ যোগ্য হবে না?
কাফকার মেটামরফোসিস বা রূপান্তর গল্পটির কথা ধরুন। অনেকের কাছে এটি তাঁর কালোত্তীর্ণ
সৃষ্টি। কিন্তু সেটি থেকে কি আমরা বিদেশী হিসবে তৃপ্তি পাচ্ছি না? সাহিত্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে বিশ্ববোধ জরুরী
আছে বলে আমি একদমই মনে করি না।
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে
বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের
চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা
পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা
লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের
দরবারে হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে
চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ
কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
নাসরীন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি
খুবই এক্টিভ একজন মানুষ। প্রায়ই দেখি এসব অন্তর্জালে বিশেষ করে ফেসবুকে লেখালেখি
নিয়ে অনেকেই হায় হায় রব তোলেন। গেলরে গেলরে সাহিত্যের জাত গেল, নষ্টদের অধিকারে চলে গেল। বিষয়টা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত
মনে হয়। আরে বাবা, তাঁরা কবিতা লিখছেন, গল্প
লিখছেন মানুষ খুন করছেন না। একটি লেখা পোস্ট করলে সেখানে হাজার হাজার মানুষ সেটা
দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন। এই সুযোগ আজকাল কয়টি পত্রিকা
বা ছোট কাগজ এনে দিতে পারে? ঠিক আছে একশ জন খুব বাজে কবিতা লিখছেন দুজন ভাল লিখছেন। ওই দুজনই তো সাহিত্যের আকাশে
তারা হিসেবে টিকে যেতে পারেন। সেটাই বা কম কিসে? লিটল ম্যাগ বলেন বা সাহিত্যের কোন পাতার কথা বলেন এগুলো কিন্তু অন্তর্জাল থেকে
উৎসাহ পেয়ে আরও বেশী বেশী সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া পাঠক এত বোকা নন যে একটি
ভাল কবিতাকে অকবিতার স্তুপে নীচে ফেলে দেবেন। সুতরাং
আমি অন্তর্জাল বিষয়টিকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছি।
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক
বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে
তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা
আন্দোলন, এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক;
বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো
বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী
ধরে ধরে হত্যা, রাজনীতি
ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার
বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে
পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি? বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে
মনে করনে আপনি?
নাসরীন: আমরা সমাজবদ্ধ প্রাণী যখন
তখন সমাজের কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতেই হবে। একজন কবি হবার আগে তিনি একজন মানুষ। সুতরাং মানুষ হিসেবে পরিবার, সমাজ, দেশ
সবখানেই নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলা করেই তাঁকে সাহিত্য চর্চা করতে হয়। এসব সমস্যা তাঁর কবিতায় একবারেই প্রভাব ফেলে না
সেটা নয়। তাই বলে সমাজে অস্থিরতা
আছে বলে তিনি কবিতা বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন সেটিও ঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধ
ভাষা আন্দোলন একেবারেই অন্য বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতার সাথে এই বিষয়টিকে আমি তুলনা করতে চাইছি না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিততে কেউ অস্ত্র
হাতে যুদ্ধ করেছেন কেউ কলম হাতে যুদ্ধ করেছেন। সাহিত্যিক গণ তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে সবসময় সত্য
বা ন্যায়ের পথে থাকতে চান। সেভাবে বিচার করতে গেলে সামজিক অস্থিরতা এক ধরণের কাব্যিক সত্ত্বা জাগিয়ে
তোলে ফলে সাহিত্য চর্চার কোন কোন ক্ষেত্র প্রসারিত হয় বটে।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন
সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক
অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের
জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে, কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম।
কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয়
কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে
বলে মনে করেন?
নাসরীন: সকল সাহিত্যিক একইমাপ
কাঠির তৈরি নন। কেউ দেশপ্রেমকে অনুভব করেন
এবং সেটি প্রকাশ করতে পারেন। কেউ হয়ত অনুভব করেও সেটি কাব্যে প্রকাশ করতে পারেন
না। আবার অন্যদিকে অনেক সাহিত্যিক দেশপ্রেমিক না হয়েও দেশ, সমাজ নিয়ে দুর্দান্ত সব
কবিতা লিখে ফেললেন। তাহলে আপনি বিচার করবেন কিভাবে? এমন
প্রেমিক কবি তো রয়েছেন যার কবিতায় দ্রোহ নেই, সামাজিক বঞ্চনার যন্ত্রণা নেই আছে
শুধু ছন্দ সুরের অনুপম যুগল বন্দী, প্রেম পিয়াস। তাই বলে কি সেসব কবিতার যুগল পাঠকও নেই? নিশ্চয় আছেন। সেসব প্রেমীদের কাছে তিনি বিশ্বস্ত কবি।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের।
আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার
দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে। আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের
অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।
নাসরীন: শ্লীলতার বিষয়টি আসলে
আপেক্ষিক। পোশাকের বিষয়টিই ধরুন, কারো কাছে খুব ক্ষুদ্র পোশাকের নারী অশ্লীল, কেউ ভাবেন এটা তাঁর স্বাধীনতা শ্লীলতার প্রশ্ন আসছে কেন? কবিতা লেখাটাও আমার কাছে তেমনই স্বাধীনতা মনে হয়। কবি নারী পুরুষ বা তাঁদের যৌথ সম্পর্ক নিয়ে
নানাকিছু লিখতে পারেন। এখন তিনি বিষয়টিকে খোলাখুলি উপস্থাপন করবেন,
না কি একটু রেখেঢেকে রূপকের আশ্রয় নেবেন সেটি তাঁর নিজস্ব ধ্যান ধারণার ওপর নির্ভর
করে। তবে হ্যাঁ শ্লীল অশ্লীল বিষয়ে নারী পুরুষ সাহিত্যিকদের মধ্যে বৈষম্য দেখেছি
আমি। সমাজ স্বীকৃত অশ্লীল কোন শব্দ যখন পুরুষ সাহিত্যিক উচ্চারণ করছেন,
লিখছেন তখন সেটির বিষয়ে শ্লীল অশ্লীল প্রশ্ন আসছে না। কিন্তু যখনই কোন নারী সাহিত্যিক লিখছেন তখনই প্রশ্ন আসছে এই অশ্লীল শব্দটি তিনি নারী হয়ে কিভাবে ব্যবহার করলেন ? আমি নিজের কয়েকটি গল্পের ক্ষেত্রেও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডীত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক
সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের
একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে
আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে
গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?
নাসরীন: আমি আগেও বলেছি
সাহিত্যের মাঝে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই।
একসময় ছিল এপার বাংলার কোন বই ওপার বাংলায় যেতে নানা বাঁধা বিঘ্ন পার হতে হত বা ওপার
বাংলার কোন বই এপারে আসতেও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। গুটিকয় যেসব সাহিত্যকর্ম আদনপ্রদান হত সেগুলো
হাতে গোণা। কিন্তু সেইদিন এখন আর নেই। এই সময়ে এসে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির
কল্যাণে এপারে বসে ওপারের সাধারণ থেকে অসাধারণ সব লেখা, অখ্যাত থেকে বিখ্যাত
মানুষের সাহিত্যকর্ম মুহুর্তের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছি। তেমনি ভাবে এপারের সাহিত্য
মুহুর্তে ওপারে চলে যাচ্ছে যে কোন পাঠকের কাছে। মতামত বিনিময় করছি। আমার ধারণা এই ধারা অব্যাহত
থাকলে খুব দ্রুত দুই বাংলার সাহিত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব।
কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের
লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে
প্রয়াসী আপনি?
নাসরীন: যে কোন লেখকই পাঠকের কাছে
একটি স্বতন্ত্র ইমেজ নিয়ে হাজির হতে চান। আমিও চাই পাঠক আমাকে লেখক ম্যারিনা নাসরীন হিসেবে চিনুক। যার লেখার একটি নিজস্ব ধারা
থাকবে এবং যেটি ধার করা নয়।
কবিতাউৎসব: আপনার সাহিত্যচর্চার আজীবন সাধনার বিভিন্ন পর্ব পেড়িয়ে
এসে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা তৃপ্ত আপনি? আর কতটা আক্ষেপ রয়ে গেল? ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?
নাসরীন: খুব বেশীদিন হয়নি আমি
লেখালেখির সাথে যুক্ত হয়েছি। সুতরাং পাওয়া না পাওয়ার হিসেব আপাতত তুলে রেখেছি। একজন সাহিত্যিক কখনই নিজের সৃষ্টি নিয়ে
সম্পুর্ন তৃপ্ত হতে পারেন না। আমি যতটুকু সৃষ্টি করেছি ততটুকুতে তৃপ্ত নই আবার
তেমন আক্ষেপও নেই। সাহিত্যের কিছু কাজ আমি
ভেবে রেখেছি সেগুলো যদি সফল ভাবে শেষ করতে পারি তাহলেই হয়ত কিছুটা তৃপ্ত হব। কবিতা উৎসবকে অশেষ ধন্যবাদ।
ম্যারিনা
নাসরীন
জন্ম
– ১৬ আগস্ট
স্থান
– সাগরদাঁড়ি, যশোর, বাংলাদেশ।
পেশা
– অধ্যাপনা
প্রকাশিত
গ্রন্থ সংখ্যা – ৬টি
উপন্যাস
২টি, ৪ টি গল্পগ্রন্থ।