সম্পাদকের কলমে
সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। না আমাদের বাংলা দেশের সম্বন্ধে
এই ঐতিহাসিক উক্তি ছিল না। কিন্তু আমাদের বাংলা দেশের সম্বন্ধেই এই কথা যথোপযুক্ত।
আমাদের বাংলায়, কাঁটাতারের উভয় পারেই শুধু কবিতা লিখে কারুর গ্রাসাচ্ছাদনের সুরাহা
হয় না। হয় নি কোনদিন। হবেও না আর। শুধু তাই নয়, সমাজে কবিতা লিখিয়েদের যে খুব সম্মান
দেওয়া হয় তাও নয়। বরঞ্চ বেশ একটু কৃপাদৃষ্টিতেই দেখা হয়ে থাকে। হ্যাঁ খুব বিখ্যাত,
পুরস্কার প্রাপ্ত, প্রাতিষ্ঠানিক কবিদের সমাজে বরাবরই একটা সম্মানের জায়গা রয়ে গিয়েছে।
থাকবেও। বিশেষ করে রবি ঠাকুরের নোবেল পাওয়ার পর থেকে। সমাজ খ্যাতি ও পুরস্কারকে খুব
সমীহ করে চলে। তাই প্রখ্যাত কবিদের সমাজ কদর করুক আর নাই করুক সমীহ করে চলে। কবিতা
পড়ুক আর না পড়ুক বিখ্যাত কবিদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে রাখে। আর একবিংশ শতাব্দির তথ্য
প্রযুক্তির যুগে প্রখ্যাত কবিদের সাথে সেল্ফি তুলে রাখার বিষয়ে সমাজের তুমুল আগ্রহ
গড়ে উঠেছে। না তাই বলে যে তাঁদের কবিতার গুণগ্রাহীদের সংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে,
তা নয়। তাঁদের কবিতার থেকেও তাঁদের খ্যাতির কদর অনেক বেশি। তাই বিখ্যাত কবিদের কবিতার
বইয়ের থেকেও তাদের অটোগ্রাফের আর সেল্ফির ওজন অনেক বেশি মূল্যবান আমাদের বাঙালি সমাজে।
ফলত সেই বিখ্যাত কবিদের অধিকাংশকেই গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নানাবিধ পেশায় যুক্ত থাকতে
হয়। এটাই বাংলা সাহিত্যে কবিদের অবস্থা।
কিন্তু কবিতা লিখে প্রাতিষ্ঠানিক কবি খ্যাতি আর কজন অর্জন
করতে পারেন? মাত্র কয়েকজনের পক্ষেই সম্ভব হয় পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় নিজের নাম
সংযুক্ত করার। খুব কম কবির ভাগ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক কবিখ্যাতি জোটে। এর বাইরে যে বিপুল
সংখ্যক মানুষ নিয়মিত কবিতা লিখে থাকেন, কেউ কেউ নিজের খরচে কাব্য সংকলন প্রকাশ করে
পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেন; বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ করেন, তাঁদের
কবিতার পাঠক খুবই সীমিত। বাংলার সমাজ জীবনে এই কাব্যচর্চার কোন প্রভাব আছে বলেও মনে
হয় না। আর ঠিক এইখানেই আশ্চর্য্য হয়ে যেতে হয়, বাংলা দেশে কাঁটাতারের উভয় পারেই কবিতা
লিখিয়েদের বিপুল সংখ্যা দেখে। কি প্রবল উৎসাহে বাঙালি কবিতা লিখে থাকে। সেই কবিতা কেউ
পড়ুক আর নাই পড়ুক। যিনি কবিতা লেখেন তিনিও খুব ভালো করেই জানেন, তাঁর কবিতা বিশেষ কেউই
পড়বে না। কিন্তু সেই দুঃখজনক বাস্তবতাও তাঁর কবিতা লেখার উৎসাহে জল ঢালতে পারে না।
এখানেই বাঙালি কাব্যপ্রেমীদের বিশেষ বৈশিষ্ট। আর সেই কারণেই কাঁটাতারের উভয় পারেই কবিতার
পাঠকের থেকে কবিতার লেখকের সংখ্যা অনেক বেশি।
তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের হাত ধরে ঘরে ঘরে হাতের মুঠোয় সোশ্যাল
মিডিয়ার প্রবেশে কবিতার লেখকের সংখ্যা আরও বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও কবিতার পাঠকের
সংখ্যা কিন্তু বিশেষ বৃদ্ধি পায় নি। কার আর ভালো লাগে অন্যের লেখা কবিতা পড়তে? নিজের
লেখা অন্যকে পড়ানোর তাগিদ যত, অন্যের লেখা নিজে পড়ার তেমন তাগিদ এই একুশ শতকে এসে বাঙালির
খুব একটা নাই। সময়ের অভাব যেমন বড়ো সত্য, কাব্যপ্রেমের অভাবও তেমনই বড়ো সত্য। অধিকাংশ
শিক্ষিত বাঙালির ঘরে খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, কবিতার বই খুঁজে পাওয়াই ভার। থাকলে বড়ো
জোর একটা সঞ্চয়িতা। তাও সঞ্চয় করে রাখার বাইরে পাঠ করা হয় জীবনে দুই এক বারের বেশি
নয়। একমাত্র যারা সরাসরি লেখালেখির জগতের সাথে যুক্ত, কিংবা সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিযুক্ত,
তাদের বাড়িতে বেশ কিছু কবিতার বই ঘর আলো করে শোভা পেতে দেখা যায়। যার বেশির ভাগটাই
খ্যাতি কিংবা পদাধিকার বলে উপহার পাওয়া।
ফলে দুই বাংলার সমাজজীবনেই কবিতার বইয়ের বাজারদর খুবই কম।
আর সেই কারণেই, শুধু কবিতা নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকা খুব একটা দীর্ঘায়ু হয় না। মাথার ঘাম
পায়ে ফেলা পয়সা দিয়ে মানুষ আর যাই হোক কবিতার পত্রিকা কিনে পড়বে, এমন আশা করা কঠিন।
তবু তার ভিতর বাংলার লিটল ম্যাগাজিন জগত আজও যে টিকে রয়েছে, তার মূল কারণ একটাই। বাঙালি
কবিতা পড়ুক না পড়ুক লিখতে বড়ো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার তাগিদেই শুধু মাত্র কবিতা নিয়েই
প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকার কোন অভাব নাই। কিন্তু সেগুলির কয়টি দীর্ঘায়ু লাভ করে প্রশ্ন
কিন্তু সেইখানেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
অনেক মূল্যবান কবিতা সাময়িকীই অর্থাভাবে ও অন্যান্য কারণে অকালে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু
তাতে নতুন নতুন কবিতা পত্রিকার আত্মপ্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়নি। বাঙালির কবিতা লেখার তাগিদই
এর পিছনে আসল কারণ।
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, বাঙালির হাতে যে আলাদীনের আশ্চর্য্য
প্রদীপটি তুলে দিয়েছে, সেটি হাতে নিয়ে বাঙালির এই কবিতা লেখার তাগিদ একুশ শতকে এসে
প্রায় ভাইরাল হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে চোখ রাখলেই সেটি বোঝা যায়। আর সেই কারণেই
শুধু মাত্র কবিতার ওয়েব জার্নালের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটু ভালো করে
খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর ভিতরেও খুব বেশি কবিতার ওয়েব জার্নাল কিন্ত নিয়মিত ভাবে বছরের
পর বছর ধরে প্রকাশিতও হয় না। আমরা বলছি শুধুমাত্র কবিতা নিয়ে প্রকাশিত ওয়েব জার্নালের
কথাই। সাম্প্রতিক কালে শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও প্রকাশিত কবিতা পত্র অন্যনিষাদ
এক উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। এই ওয়েব জার্নালটি একটানা নয় বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে শ্রী
মুখোপাধ্যায়ের নিরলস পরিশ্রমের ফল হিসাবে। বলা যেতে পারে তাঁর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত
হয়েই কবিতাউৎসবের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল ঠিক চার বছর আগে ২১শে ফেব্রুয়ারী ২০১৬’তে। কবিতাউৎসবের
প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয় লিখে শ্রী মুখোপাধ্যায় আমাদের পথচলার শুরুকে গৌরবান্বিত করেছিলেন।
আর সেই শুরুই কবিতাউৎসবের নিয়মিত প্রকাশকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। বিগত চার বছরে, কবিতাউৎসবের
আটচল্লিশটি মাসিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি মাসের ২১শ তারিখে ঘড়ির কাঁটা ধরে। কবিতাউৎসবের
সম্পাদকমণ্ডলীর নবীনতম সদস্য কাকলি দাশ ব্যানার্জীর বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা প্রকাশ
করেছি আমাদের প্রথম শারদ সংখ্যা গত বছর অক্টোবরের ৯ তারিখে। সংখ্যাটি অবশ্য সাহিত্যের
বিভিন্ন শাখার লেখা নিয়েই সমৃদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবিতাউৎসবের এই ফাল্গুন সংখ্যা
দিয়েই ওয়েব জগতে কবিতাউৎসবের পঞ্চম বর্ষ শুরু হলো। একটি বিষয়ে আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ
করতে চাই এই বলে যে, শুধুমাত্র কবিতা নিয়ে প্রকাশিত একটি ওয়েব জার্নালের পক্ষে একটানা
চার বছর প্রকাশিত হয়ে পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করার মতো ঘটনাও কিন্তু খুব সহজ কথা নয়। হ্যাঁ
একথা খুবই সত্য, বাঙালির কবিতা লেখার যে তাগিদের কথা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি,
সেই তাগিদই এর নেপথ্যের প্রধান কারণ। তবু আমাদের আশা, বাংলার কবিকুলকে ছাড়িয়েও বাংলার
পাঠককুলের আনুকুল্য লাভের। সেটি না হলে একটানা বেশিদিন কোন পত্রিকার পক্ষেই প্রকাশনার
কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
৮ই ফাল্গুন ১৪২৬