তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়
শব্দহীন
দু'দিন ধরে সারা মন তোলপাড় করে
খুঁজেছি। সবক'টা তাক, আলমারি
তোশকের তলা - তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
পাইনি। কিচ্ছু পাইনি।
আমার ঘরে একটা শব্দও নেই...
সজ্ঞানে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করছি।
আত্মসমর্পণও বলা যেতে পারে একে।
কিন্তু এটাই সত্যি, আপাতত, আমি অক্ষম।
আপনারা, দয়া করে, কয়েকটা শব্দ
ধার দিন আমাকে,যা নিয়ে সান্ত্বনার হবিষ্যি
তুলে দিতে পারি সন্তান হারানো মা'র হাতে;
অথবা সেই স্ত্রীর হাতে, যার ভালোবাসা
সতীর দেহের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে
হিংসার রাজপথে...
নইলে আমি মুখ দেখাব কেমন করে!
আচ্ছা,ওরা যদি বলে হত্যাকারীর মৃত্যু না-হলে
শেষ হবে না কালাশৌচ;নিয়মভঙ্গ হবে না;
হবে না মৎসমুখ
আমি কী করব?
যদি আমার মনে পড়ে যায় নৃশংস
হত্যাকারীর অসহায় মা'র মুখ?
ওরা যদি বলে প্রতিশোধ চাই - হত্যা করো;
খুনের বদলে খুন
আগুন দিয়ে নেভানো যায় আগুন?
ভিক্ষা চাইছি;
আমাকে কিছু শব্দ দান করুন।
বাবা
আমি মোটেই এই রুটিনবাঁধা জীবন চাইনি;
শিল্পী হতে চেয়েছিলাম।
বুঝি না-বুঝি কবিতা নিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম
দু'টো ভাত তো জুটে যাবে। যাওয়াই উচিৎ।
বাবরের বাবার নাম,
দ্রাঘিমা-অক্ষাংশ কিংবা মধ্যপদলোপী কর্মধারয়-
আমার পোষাত না একেবারে
এক-একটা কবিতা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল,
অথবা প্রেমিক। এই তো ভাষা। আদর্শসম্ভার
কবিতা ছিল যুগের ইস্তেহার।
কিন্তু এসব কিছুই হয়নি। বাবা হতে দেননি।
বাবাকে আমার শ্রেণীশত্রু মনে হত তখন।
মনে হত সারা পৃথিবীর রুক্ষতা বাবার চোখে।
অথচ চারপাশটা কতো রঙিন।
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।
আমি চাকর হয়েছি।
শ্রম বেচে ভাত খাই আমি।
মাঝেমধ্যে কবিতা আসে।লিখি।
তাতে কী? মোটেই কবি নই ।
শিল্পী নই। নই সুশীল সমাজের কোনো কেউ।
ভাগ্যিস!
এই সমাজে এখন আলু-পটলের মতো বিক্রি হয়ে যায়
হাজার হাজার শিল্পী কবি বুদ্ধিজীবীদল।
আমি চাকর হয়েছি। শ্রম বেচি।
কিন্তু নিজেকে বেচার দুর্দিন দেখতে হয়নি এখনও।
তাই মাঝেমাঝে কবিতারা আসে।
লিখি। নিজের কথা লিখি।
সত্যি কথা লিখি। লিখতে পারি।
আমার কোনো রঙিন দায় নেই।
বাবারা বোধহয় বুঝতে পারে অনেকটা আগেই।
শুধুই বাবা ছিল বলে বখে যায়নি একটি কবিতাপ্রেমিক।
শুধু বাবা ছিল বলে নিজের দিকে তাকাতে পারি আজও।
বাবা ছিল বলে, এই জীবনটা বেঁচার জন্য নয়।
এটাই আমার পিতৃপরিচয়।
এটাই আমার বাবার কাছে ঋণ
অবিক্রিত আমার প্রতিটা দিন।
প্রজাতান্ত্রিক প্রার্থনা
যে-আমি নিজের পরিবারের পাশে
দাঁড়াতে পারিনি,
সেই আমি কী করে বলব গোটা দেশ
আমার পরিবার!
আমি কী করে আশা করব, এর পরেও,
রাজার মুখে বাবার চোখ
আমি নেহাত আহাম্মক
আমি তবে আহাম্মক
সেই হাফপ্যান্টের যুগ থেকে শুনে আসছি,
"যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ"
কিন্তু...
যতদিন যাচ্ছে আরও খটখটে হচ্ছে
মৃত্যুমুখী
মাঘ
আমার সারাটা মনে হিংসার দাগ
একটা দেশের হাজার ভাগ
কী সর্বনেশে যুদ্ধ; লাগাতার
ওগো মন, তুমি শুধুই কাঁটাতার
শান্তি নাই শান্তি নাই শান্তি নাই
এবার একটা প্রলয়কারী বৃষ্টি চাই
হে বিদ্বেষ, আমিও ভালোবাসতে চাই।