কবিতা ও সাহিত্যে নারীর অবস্থান
নিজেকেই জাগতে হবে সবার আগে , ভাঙ্গতে নিষেধ দরজার তালা।
নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে নারীর
স্বজাতীয় জাগরণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার “মায়ামুকুর” কবিতায়
লিখেছেন, ভাঙ্গো ভাঙ্গো এই ক্ষুদ্রগন্ডি এই অজ্ঞান ভালো তোমাতে জাগেন যে মহামানব, তাহারে
জাগায়ে তোলো। জাগানোর এই গুরু দায়িত্ব নারীর নিজে। যেমন করে নারী একদিন যুদ্ধক্ষেত্র
ছেড়ে আটকে পড়েছে সংসার নামক এক ক্ষুদ্র গন্ডির ভেতর। তেমনি আজ যখন শ্বাসরোধ হয়ে আসছে
অবস্থা তখন নারীকেই ফুঁসে উঠে গন্ডি ভেংগে বেরিয়ে পড়তে হবে পথে প্রান্তরে কবিতায়, গদ্যে,সাহিত্যে,সমাজে।
পুরুষ কেন উজ্জীবিত করবে নারীকে? কেনই-বা পেম্পারিং করে পোষমানা বিড়াল, পুসি ক্যাট
করে রাখবে তার ক্ষমতার ছায়াতলে? নারী চাইলেই পারে তার বিস্তৃত পরিধির সীমানা আরো বৃহত্তর
করতে।
নারীরা যতই নিজেদেরকে কবি,সাহিত্যিক, লেখক ইত্যাদি হিসাবে
তুলে ধরতে চেয়েছে, কিন্তু সীলগালার মত তার আগে 'নারী'- শব্দটি সেঁটে লাগিয়ে রাখে। সমকালীন
সময়ে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই কথা বলতে বাধ্য করে। কিন্তু কেন?
আমার একটাই কথা। কেউ বাধ্য করতে পারে না যদি নারীরা সুসংগঠিত
হয়। নারীদের মর্যাদা নারীরাই যদি নির্ধারণ করতে এগিয়ে আসে, তবে মানদন্ডে বিচার করে
শব্দ ভিক্ষা দিতে কারো সাহস হবে না। বলতে পারি, সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তাকালে
লিঙ্গের দিকে তাকানো উচিত না’। তাতো বললাম বটে, কয়জন নারী কবিত্বের জগতে পা রেখে চুলার
আগুন থেকে দূরে থাকতে পেরেছে? তাকে ঘরদোর, সমাজ সংসার, সন্তান, শ্বশুর শাশুড়ী সামাল
দিয়ে গভীর রাতে স্বল্প আলোতে কবিতার জগতে নিজেকে সঁপে দিতে পারে। কিন্তু সৃষ্টি কি
এমন বাঁধা ধরা নিয়মে চলে? চলে না। আর চলে না বলেই তো পুরুষ কবিরা দলবেঁধে কিংবা একাই
হাওয়া বদলের জন্য ছুটে যায়। আবিষ্কার করে নতুন নতুন চিত্রকল্প আর অভিজ্ঞতার ভান্ডার।
কিন্তু নারীর সেই সুযোগ নেই আর নেই বলেই সংসারের খুটিনাটির কলকাঠি নেড়ে নেড়ে কবিত্বের
ঘরে আলো জ্বালায়। কিন্তু এই বিভেদ বা বৈষম্য যদি না থাকতো, তবে নারীদের অবস্থা কোন
উচ্চস্তরে থাকত তা ভাবাই দুষ্কর। তবু নারী লড়াই করে করে কবিতাকে চুলার আলো থেকে বারান্দার
আলোয় টেনে এনেছে বলে মনে করি। তবু নারী সীমিত বলয় নিয়েই লেখে। ওদিকে পুরুষেরা আজো নারীর
স্তন, জংঘা, নিতম্ব ইত্যাদির বর্ননায় কোন আদর্শবান উপমা খুঁজে পেতে চরম ব্যর্থ। বুকের
মধ্যে আত্মপ্রকাশের ঘোড়াটার গলায় লাগাম দিয়ে কি ছবি আঁকবে নারী তার কবিতায়। কেবলই সেবা
কর, সেবা কর। কেউ কি বুঝতে চায় এই নারী কেবল কবিতারই সেবা করতে চায়। তাই মনসামংগলের
দিকে নজর ঘুরাই একটু । বাংলা সাহিত্যে 'স্বর্ণযুগ' বলে বিবেচিত ষোল শতকে সাহিত্যের
বিষয় হিসেবে নারীরা আলোচিত হয়। কিন্তু নারীরা কবি হয় না ।
একজন নারী সাহিত্যিককে তাঁর লেখার মান নিয়ে সন্তোষজনক পর্যায়ে
পৌঁছাতে যত কাঠখড় পোড়াতে হয়, পুরুষ সাহিত্যিককে ততটা নয়। নারীকে আবার শিল্পের চেয়ে
ঘটনার শিকার হতে হয় অধিক রকমের। একবার এক নারী সাহিত্যিক পুরুষ সাহিত্যিকদের আয়োজিত
আড্ডায় রাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটাকে তথাকথিত উদারপন্থীরা স্বাগত জানালেও যাঁরা নীচতার
মনোজগৎ থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁরা সেই নারীকে ঘিরে মনগড়া অশালীন কাহিনীর অবতারণা করলেন।
বলা হয়, শিল্প-সাহিত্যের জগতে নারীর অবাধ পদচারণের বয়স পুরুষের হাঁটুর বয়সী। ভাষাটাকে
আরেকটু অন্যরকম করে সৌজন্যমুলকভাবে বলা কি উচিৎ নয়? তুলনাতেই বুঝা যায় নারীর অবস্থান
কোথায়? এরপর কি নারী চুপ করে থাকবে? নারী ঘাপটি মেরে থাকবে রাতের একচিলতে আলোর জন্য?
কিছু কিছু নারী অকুতোভয় হয়েছেন বলেই না আজ তারা নমস্য। কিন্তু
বৃহত্তর অবস্থার দাবী এখন গনগনে আগুনের মুখে, তখন কি করে গুটি কয় নমস্য হয়? আবার বলা
হয়, অবশ্য অনেকের অনুকূল পরিবেশ ও অনুপ্রেরণাদায়ী সঙ্গীর অবস্থান চলার পথকে আরও মসৃণ
করে। হা নারী সেই রামরতন সেন। সেই পাসপোর্ট পদ্ধতি। নারীর কারো সাপোর্ট লাগে না। নারীর
স্নায়ু শক্তি যেমন প্রখর, তেমনি, শরীর সাপোর্টও শক্তিশালী। ওদিকে কারো কারো রয়েছে কিন্তু
ভয়ার্ত শৈশব, অব্যক্ত কৈশোর, বৈষম্যের যৌবন, অতৃপ্তির দাম্পত্য, সামাজিক নিষ্পেষণ যে
বিষয়বৈচিত্র্য হাজির করে তা কেন সাহসের অভাবে নারী সাহিত্যিককে গণ্ডিবদ্ধের অপবাদে
কলঙ্কিত করবে?
বাংলা সাহিত্যে নারীদের বিচরণ উলেখযোগ্য ভাবে লক্ষ্য করা
যায় উনিশ শতাব্দী থেকে এবং বিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে নারী লেখক তাদের সমকালীন
পুরুষ লেখকদের পেছনে ফেলে সাহিত্যে নিজেরদের অবস্থান তৈরী ... মল্লিকা সেন গুপ্তের
কবিতা এখনো রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ...মল্লিকা তার পুরো কর্ম জীবন
সমাজের নারী ও পুরুষের সম অধিকার অর্জন বিষয়ে গবেষণা করে কাটিয়েছে।
অতি সম্প্রতিকালের ওডিসি আন্তর্জাতিক কবিতা ফ্যাস্টিভালে
উপস্থিত কবিদের সংখ্যায় লিংগ বিচারে নারী কবির আধক্যই দেখা গেছে। তবুও সেখানে চামচাগিরি
দেখা গেছে। হাতাহাতির ব্যাপার না থাকলেও নারীকে ভোগের জন্য লেলিয়ে দিতে কেউ কেউ বেপরোয়াও
ছিল, যা খুবই অসন্মানজনক ও অনাবশ্যক ছিল। এটা কবিতার জন্য নয়। ব্যক্তি চরিত্রের দুর্বলতাই
বলতে পারি। অন্ধকার ধুয়ে ধুয়ে কি আলোর ঝিল্লিরশ্মি পাওয়া যায়? ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি এসোসিয়েশান
ও ওডিসি আন্তর্জাতিক কবিতা ফ্যাস্টিভালের দুরন্ত আয়োজনে নারীরাই সক্রিয় ভূমিকায় ছিল।
তারা পুরুষ কবিদের প্রতি যথারীতি সদয়, সৌহার্দপূর্ণ, ও শ্রদ্ধাশীল ছিল। কবিতার আলোচনায়
কখনোই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন বা শীর্ষস্থানীয় বলে উল্লেখ করা হয়নি। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে
উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম ছিল।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে কবিতায় নারীদের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে
এখন বিশ্ববিস্তারের যুগের শুরু হয়েছে। নারী কবিতায় বিষয়ে সমাজ, সংসার,প্রেম -প্রকৃতির
বাইরে এখন সমকামীতা, স্বদেহের অনুভূতি,ক্ষুধা ও ধারালো রাজনৈতিক বিষয়ে উচ্চস্বরে শব্দ
চয়ন করে কবিতার নতুন বীজ বপন করতে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমার ভেতরে যে যুদ্ধ প্রতিনিয়ত
আমাকে অবনী বাড়ি আছো বলে সচকিত করে তুলছিল, সেই আমাকে আমি বিশ্বের সমান্তরাল মাঠে উদবোধন
করতে পেরেছি। বিজেতার ভূমিকা নয়, খামখেয়ালীর হাত ছেড়ে নিরুংকুশ নিরীক্ষার মাঠে অবাধ
বিচরণ করবার জন্য দরজার কড়া নাড়া শুনে শুনে মহাশুন্যে দরজা খুলে দিতে পেরেছি।
এই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কবিতা এই শতকেই নারীর হৃদয় উজাড়
করা শব্দ ব্যঞ্জনা নিয়ে মংগলগ্রহে পাড়ি জমাতে পারবে। সেই সুদিন সমাগত। ইউরোপীয় পটভূমিতে
দাঁড়িয়ে এ কথা বলছি বললে ভুল হবে, পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশেও এই জাগরণ এখন মশাল হাতে
মিছিল করছে। আঁকছে দৃপ্ত পদক্ষেপ,এর জন্য নারীকে ছাড়তে হচ্ছে সংসারের বিধিনিষেধ, কিংবা
পুরো সংসারের জংগল। পুরুষ কবিদের জংগলাকীর্ণ সমাজব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে আসার আরেক
নাম সমাজে নারীর অবস্থান ও কবিতা বা সাহিত্যে নারীর অবস্থান। জয় হোক কবিতার। জয় হোক
কবিদের সহাবস্থান।
মৌ মধুবন্তী