সমরেন্দ্র বিশ্বাস
দীর্ঘশ্বাসের কবিতা
সকাল
সারা রাত্রি বৃষ্টি ঝরেছিল
সারা রাত্রি কেউই ঘুমোতে পারি নি।
মেঘ কেটে গেলে রামধনু উঠেছিল।
তখনই তোমাকে দেখলাম, চুপিচুপি দেখলাম
তোমার দু’চোখে অরণ্যের সকাল,
ঠোঁটে হাসিটুকু যেন প্রত্নগুহার চিঠি।
বিকেল
সারা দুপুর কলম পিষেছি, কাজ করেছি;
সারা দুপুর রক্তে তুমি রিনরিন বেজেছ।
হঠাৎ বিকেলে আজ কি এমন হল
দেখেও না দেখার মতো
তুমি চলে গেলে সম্ভাষণহীন।
রাত্রি
একে একে তোমার ঘরের লাইটগুলো নিভে গেল।
জানালার সরু ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল তীব্র নিঃশ্বাস।
লম্পটের মতো আমি সারারাত্রি কালভার্টে বসে রইলাম,
একটা রাতপাখি সারারাত্তির ডেকে চলল যন্ত্রণাকে।
উপসংহার
ঘুরতে ফিরতে যে স্বপ্নগুলো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
তার সবটুকু জমা করেছিলাম তোমারই হাতে,
জানতাম, তোমার দু’হাতেই এসব মানায়।
মাঝে শুধু কতগুলো দিন,
তোমার হাতে সেসব স্বপ্ন আজ নুড়ি পাথরের ঢেলা!
প্রেম
পৃথিবীর যত টিয়া চলে গেলে গৃহস্থালি কাজে
অনন্ত দুপুরে আমি হিসেবের খাতা নিয়ে বসি।
সেই মুখ খুঁজে নিতে আমি চলে যেতে পারি
দারু বনানীর ধারে
যেখানে সমস্ত সভ্যতা নিঃসাড়ে ঘুমায়,
তার সঙ্গে দুদন্ড কাটাতে আমি ভেসে যেতে পারি
তোলপাড় জলস্রোতে
একা একা স্মৃতির ভেলায়।
স্বর্গ মর্ত্য চরাচর ছিন্নভিন্ন করে এসে দেখি
বাসন্তী মেঘের কোলে তানপুরা হাতে তুমি
আনমনে গান গাও, ঠিক যেন আমার কবিতা!
এত কাছাকাছি আছি, তবুও জানি না
তোমার গোপন কথা।
তুমি কি জেনেছ কতখানি আগুনেরা ধিকিধিকি
আমাকে পোড়ালে
আমি নষ্ট হতে পারি?
বান্ধবীর অকাল মৃত্যুতে
শিরস্ত্রাণ নিয়ে তুমি যুদ্ধে চলে গেলে
কেউ যেন বলে গেলো, ‘যাই’!
একাকী অরণ্যে দাঁত নিয়ে থাবা নিয়ে
সেই রাতে জেগেছিল খর অন্ধকার ।
নগরে বন্দরে ঝড়ে ঝড়ে বেসামাল নিশানের ফলা,
রক্তস্রোতে ভেসেছিল এই দিনকাল,
শ্রেণীদ্বন্দ্ব ঘিরে ছিল সমূহ সময়।
ইত্যাকার দ্বন্দ্ব সব ঘুচে গেলে, ঠিক ছিলো,
প্রকৃতির বিপরীতে জোরদার সমবেত হব মুখোমুখি।
অথচ তখনি
তোমার বিকল ঘড়ি জুড়ে ওৎ পেতে বসেছিল যুদ্ধের আহ্বান,
দুর্বিনীত ধনুকের ছিলা ছুঁয়ে
সাহসী তীরের মতো ক্ষেপণের অপেক্ষায় তোমার শরীর।
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে
তোমাকেই তাই চলে যেতে হলো একা একা –
বড় অসময়ে।
বিচ্ছেদ
কচি রোদ্দুরের বুকে ফলিডল ছড়িয়ে তুমি হেঁটে গেলে। অপেক্ষার
সবুজ ঘাসে আমি বসে রইলাম। আমাকে গ্রাস করলো সায়ানাইড-রোদ্দুর, আমার বেবশ শরীরে বাজতে
থাকলো স্মৃতিময় তোমার মূর্ছনা।
মহাজাগতিক হাওয়ায় ভেসে গেছে আমাদের প্রেমপত্র, বিধ্বস্ত নভঃযানের
মতো আজ সে অদৃশ্য নক্ষত্রের মৃত আলো! ও হলুদ বসন্তের মেয়ে, তোলপাড় সমুদ্র মন্থনের শেষে
আমায় কেন তুলে দিলে হলাহল? তীব্র বিষ!