সম্পাদকের কলমে
বর্তমানে জীবিত প্রজন্মসমূহের ভিতর, মহামারীর আবহে শারদীয়া
উৎসবের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। অর্থাৎ আট থেকে আশি এবারেই প্রথম এই রকম এক আতঙ্কিত পরিবেশে
শারদোৎসবের মুখোমুখি। মুখে মাস্ক। হাতে গ্লাভস। মনে ভয়। চিন্তায় সামাজিক দূরত্ব। এই
অবস্থায় দুর্গাপুজা। এই অবস্থায় উৎসব। একদিকে মৃত্যু মিছিল। এক দিকে উৎসবের আকর্ষণ।
কি করবে বাঙালি? প্রায় গোটা বছরই আমরা গৃহবন্দী থাকলাম। এই নীল ঘন নীল শরতের আকাশ।
হাতছানি দেয় মনের উঠানে। ভালোবাসার বারান্দায় মানুষের সাথে মিলনের ডাক। সেখানেই আসল
উৎসব। আর সেখানেই মৃত্যুর আতঙ্ক। যমের সাথে সম্মুখ সমরের ভিতর এসে গেল শারদোৎসব। মৃত্যু
আর জীবনের দ্বৈরথ। মৃত্যুর শক্তিও যেমন আমোঘ। জীবনের সঞ্জীবনী শক্তিও তেমনই অপরিমেয়।
অপরিমেয় বলেই শতাব্দীর পর শতাব্দী এমন এমন কালান্তক মহামারী পেরিয়েও মানুষের সমাজ ও
সভ্যতার জয় পতাকা আজও উড়ছে পতপত করে। নয়তো কবেই এই বিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার
কথা ছিল মানব প্রজাতির। প্রবল শক্তিধর ডাইনোসর প্রজাতির মতো মনুষ্য প্রজাতি কিন্তু
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। আজও। অন্তত প্রাকৃতিক কোন শক্তিই আমাদেরকে মুছে ফেলে দিতে পারে
নি। যদি না আমরা বোমা মেরে মেরে গোটা বিশ্বকেই হিরোশিমা নাগাসাকি বানিয়ে দিই। তবে নিশ্চিৎ,
মানুষ টিকে থাকবে আরও অনেক অনেক কাল। পার করে দেবে আরও বেশ অনেকগুলি সহস্রাব্দ।
সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আমাদের এই বিশ্বাস টলে যায়
নি আজও। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পড়তেও আমরা জানি, রয়ে গেল আমাদেরই সন্তান সন্ততি। এই
বিশ্বাস করোনাও ছিনিয়ে নিতে পারে নি এখনো। পারবেও না। মানুষই পারবে, এই ভয়ঙ্কর যমদূতকে
প্রতিহত করার প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। তখন, আর অমুকের করোনা হয়েছে শুনে তমুকের আতঙ্কিত
হওয়ার মতো কারণ থাকবে না। এই ভাবেই এক একটি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করতে করতে এগিয়ে
চলেছি আমরা। এক কালের ভয়াবহ রোগ পরবর্তীতে পরাস্ত হয়েছে মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনার
কাছে। এইখানেই মনুষের বিশেষত্ব। তাই আশা করতে কোন অসুবিধা নাই। এই বছরের শারদোৎসবের
নিরানন্দ আমরা পূরণ করে নেবো আগামী বছরেই। কিন্তু যে মানুষগুলি, আত্মীয় পরিজন প্রিয়
বন্ধুবান্ধব, যাঁরা হারিয়ে গেলেন চিরতরে। তাঁদের অভাব নিশ্চয় অনুভুত হবে। তবুও জীবন
থেমে থাকে না কারুর জন্যেই। সেখানেই জীবনের নোঙর। সেটাই জীবনের ধর্ম।
সেই ধর্মের কাছেই বাঁধা পড়ে আমরা সকলে। তাই, প্রতিমাসের মতো
এই কার্তিকের প্রারম্ভেই কবিতাউৎসব উপস্থিত দুই বাংলার শতাধিক কবিতার ডালি নিয়ে। মাসিক
কবিতাউৎসবের পঞ্চম বর্ষের নবম সংখ্যা। কার্তিক ১৪২৭। সবকিছুই সবসময় আমাদের পরিকল্পনা
মতো হবে। তেমনটা হয়ে ওঠে না অনেক সময়েই। তাই গত বছরের বৃহদাকায় বিশেষ শারদসম্ভারের
মতো এবার কোন শাদরসংখ্যা প্রকাশ করতে পারলাম না আমরা। তার জন্য কবিতাউৎসবের পাঠকবর্গের
কাছে আমরা আন্তরিক দুঃখিত। আসলে একটি বৃহদাকায় বিপুল শারদসম্ভার উপহার দেওয়ার পিছনে
অনেকের সক্রিয় সহযোগিতা অনেক পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় লাগে। এবারে এই করোনা আবহে, আমদের
সম্পাদকমণ্ডলীর প্রত্যেকের জীবনেই স্বাভাবিক একটা ঢেউ এসে লেগেছে। সকলেই নানান ভাবে
ব্যস্ত এবং সঙ্কিত। একটা চাপা অথচ অমোঘ আতঙ্করে ভিতরেই দিন কাটাতে হচ্ছে প্রত্যেককেই।
ফলে এইরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গত বছরের মতো একটি সর্বাঙ্গসুন্দর বিপুল শারদসম্ভারের
জন্য কোন রকম প্রস্তুতি নিতে পারি নি আমরা। অবশ্যই সেটি আমাদের ব্যর্থতা একপ্রকারে।
তবু আমরা কোনরকমে একটি শারদসম্ভার দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলাম না। ইচ্ছে করলে
সেটি করা অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু গত বছরের শারদসম্ভার উৎকর্ষতার যে মান বেঁধে দিয়েছে,
আমরা তার থেকে নামতে রাজি ছিলাম না কিছুতেই। ফলে দুঃখজনক হলেও আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে
হয়েছে, এবারে শারদসংখ্যা প্রকাশ না করার। হয়তো সামনের বছরে আমাদের এই আক্ষেপ কাটিয়ে
উঠতে সমর্থ হবো আমরা সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে। লেখক ও পাঠক বন্ধুদের উৎসাহ ও আগ্রহে।
উৎসাহ ও আগ্রহের প্রসঙ্গেই আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাতের
সময় এসেছে মনে হয়। করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত জনজীবনে নতুন নতুন কয়েকটি দিগন্তের উন্মোচোন
হচ্ছে। তেমনই ঘটনা ঘটেছে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও। মাসিক কবিতাউৎসবের সাথে যাঁরা প্রথমাবধি
জড়িত, তাঁরা জানেন। মাসিক কবিতাউৎসবের পরিচালনায় বছর দেড়েক একটানা, মাসের ১৬ ও ৩০ তারিখ,
আমরা কবিতাউৎসব লাইভ নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। বর্তমানে বহুল পরিচিত জুম
প্ল্যাটফর্মে প্রতিমাসের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে, বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে
আমরা কয়েকজন সমবেত হতাম কবিতাপাঠ ও সাহিত্য আলোচনাকে কেন্দ্র করেই। আমরা বিশেষ ভাবে
উপলব্ধি করেছিলাম। প্রযুক্তির হাত ধরে দিনে দিনে দ্রুত যে সকল বাধার পাঁচিল গুলি ধ্বসে
যাচ্ছে, সেই সকল পাঁচিলগুলিকে ডিঙিয়ে নতুন নতুন দিগন্তের উদ্বোধন খুবই জরুরী। হল ভাড়া
করে সাহিত্যসন্ধ্যা আয়োজনের প্রচলিত ধারণার সীমাবদ্ধতাই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রযুক্তির
সহায়তা নিয়ে চার দেওয়ালের সীমা অতিক্রম করে উন্মুক্ত বিশ্বপ্রাঙ্গনে পৌঁছানোর। আমাদের
সেই প্রয়াসের অন্যতম কারিগর ও কাণ্ডারী ছিলেন আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম, কানাডা
নিবাসী কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মৌ মধুবন্তী। এই বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ও কর্মোদ্যগ
ছাড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কবিতাউৎসব লাইভ শুরু করার।
কিন্তু সব কিছুরই যেমন পথিকৃত থাকে একজন বা কয়েকজন। তেমনই
সবকিছুই নির্ভর করে উপযুক্ত সময়ের। ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে বিশ্বের নানান প্রান্ত
থেকে নির্দিষ্ট সময়ে সমবেত হয়ে লাইভ সাহিত্যানুষ্ঠানের বিষয়ে মাসিক কবিতাউৎসব একটা
যুগান্তকারী সূচনা করেছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু সময় আমাদের অনুকূলে ছিল না। অধিকাংশের
কাছেই তখন ডিজিট্যাল মিডিয়া হিসাবে জুম ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। অধিকাংশের কাছেই নিজ
বাড়ি থেকে লাইভে বিশ্বসভায় হাজির হওয়ার বিষয়টিও ছিল অস্বস্তির। অধিকাংশের কাছেই টেকনিক্যাল
খুঁটিনাটিগুলি ছিল জটিল এক প্রক্রিয়া। এবং অধিকাংশের কাছে, সান্ধ্য অবসরে ফেসবুকের
অমোঘ টান এড়িয়ে অন্য একটি প্ল্যাটফর্মে সরাসরি উপস্থিত হয়ে ঘন্টা দুই তিন সময় ব্যায়
করাও ছিল অনভিপ্রেত। ফলে ইচ্ছে থাকলেও মাসিক কবিতাউৎসবের পক্ষে মাসে মাসে নির্দিষ্ট
দিনে কবিতাউৎসব লাইভের অনুষ্ঠানটি আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বছর দেড়েক চালানোর
পরেই বন্ধ করে দিতে হয়।
কিন্তু যে কথা বলছিলাম। সময়ের আনুকূল্যের বিষয়টি। যেটি সেদিন
আমাদের পক্ষে ছিল না। আজ করোনা আবহে, সেটিই বিশ্বব্যাপী বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে। ফলে
ডিজিট্যাল মিডিয়া ব্যবহারের বিষয়ে মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। এবং এখন ফেসবুকেই
লাইভ অনুষ্ঠানের প্ল্যাটফর্মটি দাঁড়িয়ে যাওয়ায়, ফেসবুক ছেড়ে না গিয়েও হাজির থাকা যাচ্ছে
বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে গালগপ্প করতে করতেও দেখে নেওয়া যাচ্ছে
কোন না কোন লাইভ অনুষ্ঠানের ভিডিও। ফলে করোনা এসে একটা প্রবল ধাক্কা দিয়েছে আমাদের
সকলকেই। সেই ধাক্কায়, সবচেয়ে বড়ো একটা পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা এখন। মাসে মাসে
প্রকাশিত ওয়েব পত্রিকায় গিয়ে কবিতা পড়ার করার থেকেও, ওয়ালে ওয়ালে ফেসবুক লাইভে কবিতাপাঠ
শোনা অনেক সহজ। আবার সারা মাসে একবার একটি ওয়েব পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়ে অপেক্ষা করার
থেকে, ঘনঘন ফেসবুক লাইভে স্বরচিত কবিতা পাঠের ভিতর দিয়ে শ্রোতাবন্ধুদের সাথে যোগাযোগ
অনেক বেশি সদর্থক ভুমিকা রাখে। ফলে আমাদের ধারণা। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিট্যাল ওয়েব পত্রিকার
থেকেও এই ডিজিট্যাল মিডিয়ায় লাইভ সাহিত্যের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগ্রহই কবি ও শ্রোতাদের
মধ্যে অনেক বেশি দেখা যাবে। কবিতাউৎসব লাইভ বছর চারেক আগে যে পথে প্রথম পা রেখেছিল।
আজ গোটা বিশ্বই প্রায় সেই পথে ছুটতে চলেছে। এটি অবশ্যম্ভাবিই ছিল। হয়তো আরও কিছুদিন
বাদে ঘটত। কিন্তু করোনা এসে এক ধাক্কায় সকলকে ঠেলে দিয়েছে এই অঙ্গনে।
এখন ভবিষ্যতই বলবে মানুষের আগ্রহ লাইভে কবিতা শুনতে গিয়ে
কবিতা পড়ার থেকে দূরে সরে যাবে কিনা। নাকি মানুষ দুটিকেই সমান আগ্রহে ধরে রাখবে। তার
উপরেই নির্ভর করছে পরবর্তী সময়ের সাহিত্যচর্চার ডিজিট্যাল সংস্করণের গতিপ্রকৃতি। পাঠক
না শ্রোতা। লেখক না কথক। কার দিকে আগ্রহের পাল্লা বেশি করে ঝুঁকবে। সময়ই বলবে সেকথা।
আপাতত কবিতাউৎসবের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে মাসিক কবিতাউৎসবের সকল লেখক ও পাঠককে শারদশুভেচ্ছা।
পড়ে দেখুন কবিতাউৎসব। সাথে থাকুন কবিতাউৎসবের। বিশ্বজনীন জীবনের শাশ্বত উদ্বোধন কবিতাউৎসব
সবসময় আপনাদের সাথে রয়েছে।