আলোপৃথিবী
বেশ। আবারও একটা নতুন দিনের ভোর হলো। পুব দিকে নরম সূর্য,
আর পশ্চিমে বাকি দিনের হাতছানি। ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম বেঁচে আছি। বালাই ষাট বেঁচে থাকবো
নাই বা কেন? কি আর এমন বয়স হলো? মধ্য পঞ্চাশে কারই বা হঠাৎ দুম করে চলে যেতে সাধ হয়!
এখনো নারীর মানে ভালোবাসা। আদরের নীল জ্যোৎস্না। এখনো, এখনো শরীর জুড়ে ফুল ফুটুক না
ফুটুক আজ বসন্ত বলে মনে হয়। এই সময় কে আর চলে যেতে চায়? তাই পুবদিকের নরম সূর্যের আরাম
মেখে গায়ে গাত্রত্থান করা।
কবি বলেছিলেন, ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছেন পৃথিবীভরা আলো।
স্বীকার করেছিলেন, তারপরেও গ্লানিভরা মানুষের ইতিহাসের কথা। রোমে ট্রয়ে। কুরুক্ষেত্রে।
দুঃখ পেয়েছিলেন এই বুঝে যে, আমাদের উত্তরাধিকারে পাপের ঐতিহ্য ক্রমেই ভারী হয়ে ওঠে।
হয়তো সেইটিই ইতিহাসের বিধান। কিন্তু কেন এই বিধান? এই যে সোনালী সূর্যের আম্লান প্রভাতের
আলেকিত রোদ, সেই রোদ গায়ে মেখে কেন নিরন্তর ম্লান করি নিজেদের পাপের মলিনতায়? শুধু
কবি কেন, সকল সুস্থ সবল মানুষই আশা করে মানুষ ও মনীষীরা এসে এই পাপ এই পাপের গরল থেকে
উদ্ধার করবে আমাদের। সেই আশা নিয়েই তো ভোর হয় আমাদের। নাকি? কিন্তু আমাদের নিজেদেরও
কি কোন দায় নাই? আছে বই কি। সেই দায়ের কথাই কবি স্মরণ করিয়ে দেন এই বলে যে, পরস্পরকে
ভালোবেসই স্পষ্ট হতে পারে আমাদের হৃদয়। তাহলে এই একটি চমৎকার মন্ত্র! পরস্পরকে ভালোবাসা!
কিন্তু কি করে সম্ভব হবে এই পরস্পরকে ভালোবাসা্ যেখানে সকাল
থেকে রাত কেবলই পরস্পপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার নিরন্তর লড়াই? মনের ভিতরেই তো আমাদের বিষের
ভাঁড়ার। কবি তবু আশাবাদী, কন্ঠে বিষ রেখেও স্পষ্ট হতে পারে মনবতার হৃদয় পরস্পরকে ভালোবেসে।
কেননা কবি জানেন ভালোবাসার মৃতসঞ্জীবনী শক্তির কথা। তাই তাঁর আশা, ভালোবাসার পথেই বিষদাঁত
ভোঁতা হতে থাকবে। ক্রমেই ফুরাবে বিষের ভাঁড়ার। আর তখনই বিজয়ী হবে মানবতা। কবির ধারণা
অবিনশ্বর আলোড়নের ঠিকানা আছে কোথাও না কোথাও। এবং তা আছে এই মাটির কোলেই। অন্য কোন
পথে পৌঁছানো যাবে না সেখানে। কবি নিশ্চিত এই বিষয়ে। যে পথে কবিরই কথায় ‘মৃত্যুর আগে
হয় না মরণ’
আমাদের এই অপরূপ পৃথিবীতে প্রতিদিন এটাই একটা বড়ো অসুখ। মৃত্যুর
আগেই ঝরে যায় জীবন। প্রেম থেকে, আশা থেকে, ভরসা থেকে, সংকল্প থেকে, স্বপ্ন থেকে নিরন্তর
ঝরা পাতার মতোন ঝরতে থাকে আমাদের সাধনা। মৃত্যুর অনেক আগেই মমি হয়ে পড়ে থাকে আমাদের
হৃদয়। এই অসুখ, শুধু আজকের নয়। এটাই এই বনঝিরি জলঝিরি নদী হিজল বাতাবী নিম বাবলার পৃথিবীর
একান্নবর্তী ইতিহাস। দেশ কাল সময় নিরপেক্ষ। সর্বত্র পরিব্যাপ্ত এক মারণব্যাধি।
কবি ধন্বন্তরী চিকিৎসকের মতোই ধরতে পেরেছেন, এই মারণব্যাধির
মূল কারণ। সেই কারণ আর কিছুই নয়, মানুষেরই ‘ফেনিল বুদ্ধির দৌড়’, কবির ভাষায়। আমাদের
এই অতিরিক্ত বুদ্ধি, কবি যাকে ফেনিয়ে ওঠা বুদ্ধিই বলতে চাইছেন, সেই বুদ্ধির দৌড়েই সভ্যতায়
এত গ্লানি জমে উঠেছে। পরস্পরকে ভালোবাসার যে মন্ত্রের হদিশ দিচ্ছেন কবি, সেই মন্ত্রোচ্চারণে
প্রধান প্রতিবন্ধকই হলো এই ফেনিল বুদ্ধির দৌড়। কবি কল্পনা করতে চাইছেন, মাটি পৃথিবীর
কোলে আরও এক অনন্ত পৃথিবীর হদিশ, যেখানে এই ফেনিল বুদ্ধির দৌড় হৃদয়কে অবহেলা করবে না
আর। বরং মানুষকে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় আলোর সন্ধন দিতে পারবে।
মানুষের একাকীত্ব যদি সেই পথেই অগ্রসর হতে চায় তাহলে এই গ্লানিভরা দিনপঞ্জীতেই আলোকিত
সূর্যের শপথ ঝলকানোর আশা করছেন কবি।
কবির দৃঢ় বিশ্বাস বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরেই রয়েছে সেই আলোকিত
দিনের হদিশ। মানুষ একবার যদি তাঁর বুদ্ধির অহমিকা থেকে মুক্ত হয়ে সেই প্রকৃতির পথে
আপন হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারে, তবেই রণ রক্ত সফলতার পারে অশ্রু রক্ত নিস্ফলতার খন্ড
খন্ড গ্লানির চৌকাঠ পেরিয়ে জীবনের কল্যণময় স্বরূপকে অবশ্যই ছুঁতে পারবে। জীবনের নব
নব জলধারা প্রষ্ফূটিত হবে উজ্জ্বল জগতে।
জীবনানন্দ কবিতাটির নাম এইকারণেই রেখেছেন আলোপৃথিবী। সেই
আলোপৃথিবীর পথেই তিনি তাঁর পাঠককে হাতছানি দিচ্ছেন। আমরা আমাদের প্রতিদিনের ক্ষুদ্র
স্বার্থের প্রলোভন থেকে মুক্ত হতে পারি না বলেই পরস্পরকে সত্য অর্থে শর্তহীন ভাবে ভালোবাসার
শক্তি অর্জন করতে পারিনা। এই সারসত্যটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন অত্যন্ত সুস্পষ্ট
ভাবেই। আর আমাদের সেই অক্ষমতার কারণ আর কিছুই নয়, আমাদেরই বুদ্ধির অহমিকা। যে অহমিকায়
আমরা নিজেদেরকে বিশ্বজগতের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে গর্ব করে থাকি, আর প্রতিনিয়ত অস্বীকার
করতে থাকি, সেই বিশ্বজগতকেই। কবি আমাদেরকে সেই অহমিকা থেকে মুক্ত করে বিশ্বজগতের কেন্দ্রে
ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রত্যয়ই। তাই তিনি এমন কিছু গালভরা স্বর্গসুখের ফানুস দেখাচ্ছেন
না। একথা বলছেন না, তাঁর সেই আলোপৃথিবী সমস্ত গ্লানির থেকে মুক্ত, বলছেন সেই পৃথিবীতে
গ্লানি থাকলেও তার সাথে গ্লানিবোধের বেদনাও থাকবে। সেই বেদনায় শুদ্ধ হয়েই মানুষ হবে
কল্যাণী।
আমাদের রোজকার ভোর কি সত্যিই আমাদেরকে গ্লানির অন্ধকার থেকে
আলোয় মুক্তির সন্ধান দিতে পারছে? যদি পারতো তবে প্রতিদিনের মানুষের মুখশ্রীর ঔজ্জ্বল্যে
কি অন্ধকার এইভাবে উঁকি দিতে পারতো কখনো, যেমনটা দিতে থাকে আমাদেরই ব্যক্তিগত জীবনের
পরতে পরতে? যেমনটা দিয়ে গেছে কবিকথিত রোমে ট্রয়ে কুরুক্ষেত্রে? মানুষের ইতিহাসের পাতা
যত উল্টাতে থাকি, ততই তো জমা হতে থাকে জমাট অন্ধকারের গ্লানির স্তুপ। যার তলায় চাপা
পড়ে থাকে বিদ্ধস্ত বিপর্যস্ত মানবতার প্রতিদিনের হাহাকার।
জীবনানন্দ তাঁর মহাকালিক প্রজ্ঞায় সেই সত্য থেকেই পরিত্রাণের
পথরেখা আঁকার প্রয়াসী হয়েছেন। হয়েছেন মাটিতে পা রেখেই। কল্পসুখের ফানুস উড়িয়ে দিবাস্বপ্ন
দেখাতে বসেননি কবি। এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব। এইখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা যুগের ও কালের
সাময়িক বৈশিষ্টের উর্দ্ধে উঠে।
তাই আজও যখন ভোরের ঘুম ভাঙার সাথে অনুভব করি, আজও বেঁচে আছি,
মনে বলে, তবে এসো বেঁচেই যখন আছি এখনো, তবে পরস্পর ভালোবেসেই বাঁচি। স্মরণে যতই থাকুক,
জীবনানন্দই বলে গিয়েছেন, ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় দ্বেষ’; তবুও এই বিদ্বেষ বিষ নাশ
করে পরস্পরকে ভালোবাসার মন্ত্রই হয়তো পারে আমাদেরকে মৃত্যুর আগে মরণের হাত থেকে রক্ষা
করতে। নয়তো আর পাঁচজনের মতোই প্রতিদিনের মমি হয়েই আমাদেরকেও জীবন্ত মুখোশ পড়ে প্রমাণ
করতে হবে বেঁচে আছি। আর ‘ফেনিল বুদ্ধির দৌড়ে’ উচ্চকন্ঠে কোলাহল করে যেতে হবে এই বলে
যে, ‘এই বেশ ভালো আছি’।