কাজী
রুনালায়লা খানম
অনাম্নী মেয়ের
ইচ্ছাপত্র
মাননীয় বিচারক মহোদয়,
সম্পূর্ণ সুস্থ
শরীরে সুস্থ মনে লেখা
আমার সদ্য সমাপ্ত
ইচ্ছাপত্রটি
আজ আপনার দরবারে
আইনী শীলমোহরের
অপেক্ষায়।
এতোকাল ধরে যা লিখে
রেখেছি গোপন দেরাজে।
আমার মৃত্যুর পর
আমার নশ্বর শরীরের দায়ভার
থাকবেনা কোনো
স্বজনের কাঁধের ওপর।
আমি ছেড়ে যাচ্ছি
আমার চোখের অতলে
তিল তিল করে জমিয়ে রাখা সমস্ত আলোকবিন্দু
চা বাগানের কুলি
লাইনের স্যাঁতসেঁতে কোয়ার্টারে,
রেলবস্তীর ঝুপরিতে
যে আধন্যাংটো মেয়েরা
বেড়ে উঠছে অক্ষর পরিচয়হীন,তাদের জন্য ।
সেইসব বিষন্ন রমণীর
জন্য
আমি ছেড়ে যাচ্ছি
আমার আত্মবিশ্বাস,
মৃত্যুর আগে যারা
মরে গেছে অজস্রবার।
প্রতিটি বয়স্ক
বালিকার জন্য রেখে যাচ্ছি
আদিগন্ত আত্মম্ভর এক
মাঠ
যারা প্রিয়তম
পুরুষের বিশ্বাসভঙ্গের দায় নিয়ে
বিকিয়ে গেছে চোরাপথে,
আলোবাতাসহীন অন্ধকার
কুঠুরিতে
যাদের শরীর খুবলে
খায় কামুক পুরুষ।
প্লাটফর্মের
বেঞ্চিতে,
বাসস্টপে,
খোলা আকাশের নীচে
রাত গুজরান করা
পথশিশুটির শূন্য
সানকির জন্য
রেখে যাচ্ছি ভাতগন্ধ, শীতকাঁথাখানি।
বৃদ্ধাশ্রমের
প্রতিটি বৃদ্ধবৃদ্ধার অশক্ত শরীরের জন্য
রেখে যাচ্ছি বলিষ্ঠ
হাত
যে হাতে লেগে আছে
বিশ্বাসের,
ভালোবাসার
অতল সুঘ্রাণ।
বিবাহচিহ্নের মূল্যে
যে মেয়েটি প্রতিরাতে ধর্ষিতা হয়,
তার অনিচ্ছুক শরীরের
জন্য রেখে যাচ্ছি সুদৃঢ় প্রত্যাখ্যান
স্বল্পবয়স্কা সদ্যবিধবার
জন্য রেখে যাচ্ছি
এয়োস্ত্রীর সমস্ত
আবরণ ও আভরণ
অন্তহীন প্রতীক্ষায়
রেখে
যে প্রেমিক দূরত্বে
গেছে
তার পথের দুপাশে
রেখে যাচ্ছি
শুভেচ্ছার
লালগোলাপ
অন্তর্গত বিষাদজলে
ফুটে থাকা
একশো আট নীলপদ্ম আর
অমর্ত্য আখরে লেখা 'না পাঠানো চিঠি'
পঁচিশ বছর পর
অতঃপর আমি তার দিকে
তাকিয়ে থাকলাম স্থির
ঐশ্বর্যবান পথ ধরে
যে মানুষ দূর থেকে
দূরে গেছে ভেসে
একাকী সন্ন্যাসে।
দীর্ঘ দিন মাস বছর কাল পথ হতে পথের ভিতর
চোখ হতে তার একে একে খসে গেছে
কংসাবতীর ঢেউ, ডিঙি নৌকোর বিষন্ন
বয়া,
ডাংগুলি খেলার মাঠ, ছৌ এর আসর, ঝুমুর গান ,
মায়ের চোখের আলো, মায়াময় শব্দের
খিলান।
তবে কী মানুষের বুক
হতে সব চিহ্ন মুছে যায় ?
মুছে যায় মৃত্তিকার
তিলকের ঘ্রাণ?
দীর্ঘভ্রমণে প্রকৃতই
থাকেনা কোথাও আর। কোনোও পিছুটান!
চলে যাবো বললেই তো
আর চলে যাওয়া যায় না
আমি তার চোখে চোখ
রাখি,চোখ রাখি মনের গহীনে
দেখি তার অতলান্ত জুড়ে জেগে আছে
ম ম মাটির গন্ধ,শিকড়ের মায়াময় টান,
আনন্দবেদনার এক
টলটলে দীঘি
সমস্তের শেষে
কংসাবতী জেগে আছে
সমূহ সন্ন্যাসে
কংসাবতী জেগে থাকে অমর্ত্য বিশ্বাসে।
এই দ্রোহকাল
এই যে মুখে আগুন
নিয়ে বসে আছি
তবু সেভাবে জ্বলে
উঠতে পারলাম কই
হামুখো অন্ধকার এসে
জুড়ে বসে আখোলা দাওয়ায়
অথচ কোথাও কোনো
পাঁচিল তুলিনি
চোখের সামনে একটু
একটু নিভে যাচ্ছে মানুষের অন্তর্গত আলো
আমাদের ভূখন্ডজুড়ে দৃশ্য অদৃশ্য হাজার ব্যারিকেড
উধাও হয়েছে আজ
মানুষের বুকজোড়া ছায়া
মৃত্যুদৃশ্য ফিরি হয়
সোশালমিডিয়ায়।
হানাদারী হত্যাদৃশ্যে ভরে ওঠে সীমান্তপ্রদেশ
যেখান আঙুলেরা জুড়ে
গিয়ে শক্ত মুঠো
হতো
বুকের রক্তে লেখা
হতো "এই মাটি আমার স্বদেশ!"
সেসবই বিকিয়ে যায় তক্ষকের
চতুর হাসিতে।
ভেজা বারুদের মতো আজ কবির কলমও
বিচারের বয়ান হয়
বালখিল্য ভাষায়
তুমিই বলো মুখ
ফিরিয়ে থাকার এ সময়?
এ দ্রোহকালে দূরত্বে
নয়
বেঁধে বেঁধে থাকাটাই
শ্রেয়।
একথা সবাই জানে
আলো পেতে হলে জ্বালাতে হয় প্রকৃত আগুন
বাঁশিওয়ালা, এসো জন্ম দিই দু একটি আগ্নেয়
পংক্তির।