শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০

সম্পাদকের কলমে





নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডের কবিতা

এ এক অদ্ভুত সময়। যখন একদিকে নিজের ঢাক নিজে না পেটালে সমাজে কল্কে পাওয়া ভার। অন্যদিকে কোন না কোন শিবিরে নিজের বিবেক বন্ধক না দিলে ব্যক্তিস্বার্থ সুরক্ষিত রাখা মুশকিল। ফলত মাঝখানে পড়ে থাকে এক বিশাল নো-ম্যান্স ল্যাণ্ড। আর ঠিক সেই সুযোগেই ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বাজিমাত করে ফেলে ধুরন্ধর বাজিকররা। তাদের ভেল্কিবাজিতে সম্মোহিত অন্ধভক্তকুলের মিছিল যত দীর্ঘ হতে থাকে, ততই যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ে মুক্তচিন্তার সব ধরণের পরিসরগুলি। প্রায় অবরুদ্ধ দমবন্ধ করা পরিবেশে সেই সময় আমরা অধিকাংশই নিজেদের ভোলানোর জন্য কবিতার কলম হাতে তুলে নিচ্ছি যেন আরও বেশি করে। মনে করছি, সময়ের কাঁটা যতই তিক্ষ্ণ হোক না কেন, আমি নিরাপদে থাকলেই হবে। ভরসা করছি নিজেরই ওপরে। যেভাবেই হোক, সামনে প্রলয় থাকলেও তা আমার ঠিকানাকে নিশ্চয় পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। তাই এই সময় ও সময়ের ভাইরাস যত সংক্রমকই হোক না কেন, তাতে আমার অন্তত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। মনে করছি চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় এড়ানো সহজ হবে।

এই সময়ের কবিতা লেখা কবিতাচর্চা সেই চোখ বন্ধ করে প্রলয় এড়ানোর মতো অদ্ভুত এক প্রয়াস। বস্তুত আত্মপ্রবঞ্চনার মজবুত একটি হাতিয়ার। অনেকটা নীরোর বেহালা বাজানোর মতোই। প্রতিদিন যত কবিতা পত্র প্রকাশিত হচ্ছে, যত কাব্যসংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, যত ধরণের সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন, বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চা দেশ কাল নিরপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। না হলে তা কখনোই কালের গণ্ডী অতিক্রম করতে পারবে না কোনদিন। অনেকেই মনে করেন কবিতার কাজ নয় বিপ্লবের গান গাওয়া। অনেকেই বিশ্বাস করেন কবিতার কাজ সাহিত্যসেবা। সমাজসেবা নয়। কবিতা ব্যক্তিগত আবেগের শৈল্পিক উদ্ভাসন মাত্র। সামাজিক অসুস্থতার আর্ত আর্তনাদ নয়। কিংবা সময়ের সংক্রমক ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক টিকা নয় কবিতা। তাই কবিতার কলম হাতে তুলে নিয়ে অনেকেই ভালো থাকার চেষ্টায় অত্মপ্রসাদ লাভে উদগ্রীব।

বিশেষ করে বিভিন্ন সোশ্যালসাইটগুলিতে উঁকি দিলেই এই চিত্রই চোখে পড়ে আরও বিপুল পরিসরে। একদিকে কবিতা একদিকে সেল্ফি। অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে সময়ের সেল্ফি। সমাজের সেল্ফি। এইসময়ের বাংলা কবিতা আবর্তিত হচ্ছে এই ঘরানায়। এবং সেটি কাঁটাতারের উভয় পারেই। এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এইটিই যে, প্রায় সকলেই যেন আহ্লাদে আটখানা। যিনি লিখছেন। যিনি প্রকাশ করছেন। যিনি পড়ছেন। সময়ের ক্যানভাসে সময়ের স্বরকে বাইপাস করে একধরণের কসমেটিক স্বর ফুটিয়ে তোলার উৎসব চলছে আমাদের বাংলা কবিতায়। যার মূল উদ্দেশ্য হয়ত একটাই। একেবারে প্রথমে যে কথাটি বলে শুরু করেছিলাম। সেই নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে একটা আত্মপরিচিতি নির্মাণ। সকলেই চলেছে সকলের মাঝে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে। আর সেই কাজে প্রায় প্রত্যেকেই নিজের ঢাকে চাঁটি মারছে সজোরে। যিনি কবিতা লিখছেন। যিনি প্রকাশ করছেন। যিনি আবৃত্তি করছেন। আর এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যখনই যিনি মোটামুটি একটা পরিচিত মুখ হয়ে উঠতে পারছেন, পা বাড়িয়ে দিচ্ছেন কোন না কোন শিবিরে শিরদাঁড়া বন্ধক রাখতে। অর্থাৎ শুধু সমাজিক কল্কে পেলেই হবে না। ব্যক্তিস্বার্থ সুরক্ষিত রাখাকে নিশ্চিত করতে হবে। হবেই। না হলেই বিপদ।

অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে যেটাকে মনে হয়েছিল চোখ বন্ধ রাখলেই বুঝি প্রলয় বন্ধ থাকবে, সেটি পুরোপুরি ঠিকও নয় ততটা। বিপদ যে একটা আছে, সেবিষয়ে অনেকেই সচেতন। তাই বিপদ এড়াতে বিপদের ডেরাকেই অনেকে নিরাপদ মনে করছেন। এবং বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দিগন্তে অনেকেই আজ সেই নিরাপত্তার লোভে লম্বা দৌড়ে সামিল। এ যেন অনেকটা, পাড়ায় চোরের উপদ্রোব বাড়লে চোরের সাথে সখ্যতাই ধনসম্পত্তি সুরক্ষিত রাখার সহজতম উপায়ের মতো বিষয়। চোখ বন্ধ করেই আমরা ঠিক সেই পথেই পা বাড়িয়ে বসে রয়েছি আজ। আসলে আমরা সকলেই কম বেশি আতঙ্কিত। তাই যেনে বুঝেই আমরা না জানার না বোঝার ভান করে চলেছি। সোজা কথায় নিজের চামড়া বাঁচাতেই। কি অদ্ভুত ব্যাপার প্রত্যেকেই একই আতঙ্কের শিকার। প্রত্যেকেই প্রায় একই উপায় অবলম্বন করতে উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। অথচ কেউই কারুর সাথে জমাট বাঁধার স্বপ্ন দেখছি না। পরস্পর বিচ্ছিন্ন জনসমাজ অনেকটা ভেড়ার পালের মতোই একই দিকে একই সাথে এগিয়ে চলেছে একই আতঙ্কে। এই আতঙ্কই এই সময়ের চালিকা শক্তি। কাঁটাতারের উভয় পারেই।

এই বিচ্ছিন্নতাই আমাদের ধর্ম। প্রকৃতি। ধরণ। আমাদের সাহিত্য আমাদের কবিতা সেই বিচ্ছিন্নতারই প্রকৃতিজাত। তাই প্রকৃত পক্ষে বাংলা সাহিত্য বলতে বাংলা ভাষার সাহিত্য ছাড়া অন্য কোন সমগ্রতা গড়ে ওঠে নি কখনো। যেভাবে ফরাসী সাহিত্য, জার্মান সাহিত্য রুশ সাহিত্য ইংল্যাণ্ডের সাহিত্য আমেরিকার সাহিত্য বা ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য এক একটি সমগ্রতায় ধরা দেয় বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায়। সেইভাবে বাংলা সাহিত্যের কোন ঐতিহ্য সত্য হয়ে ওঠে নি আজও। নানাবিধ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট সহ তা মূলত সেই বাংলা ভাষার সাহিত্যের চৌকাঠেই আটকিয়ে আছে। আর অদূর ভবিষ্যতেও চৌকাঠ পার হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।

এই মুহূর্তে আমরা তাই পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকেই নিজেদের ঢাকে চাঁটি মারতেই স্বচ্ছন্দ। আমাদের সাহিত্যচর্চা আমাদের সংস্কৃতিচর্চা আমাদের কবিতা লেখা সেই বিচ্ছিন্ন অবস্থান থেকেই সংঘটিত হয়ে চলেছে। আমাদের কবিতার কলমও সেই একই বোধকে লালন পালন করে চলছে চলবে। সেটাকে অম্লানবদনে বাঙালিত্ব বলে চালানো যায়। তাতে আর যাই হোক সত্যের অপলাপ হয় না। হবে না।

এই কারণে, বর্তমান বাংলা কবিতায় অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ভাবেই এই সময়ের অনুপস্থিতি অত্যন্ত প্রকট ভাবে ধরা পড়ছে। প্রাথমিক ভাবে সাদা চোখে সেটি আমাদের কাউকে কাউকে যতই কষ্ট দিক না কেন, এই সময়ের কবিতা আসলে আর এক দিক দিয়ে দেখলে এই সময়ের বাঙালির প্রকৃতিগত বৈশিষ্টের একটি ইতিহাসও বটে। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই সময়ের বাংলা কবিতা নিয়ে যখন চর্চা হবে, তখন এই সময়ের ক্যানভাসে এই সময়ের বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট অত্যন্ত উৎকট ভাবেই ধরা পড়ে যাবে। ধরা পড়ে যাবে এই সময়ের কবিদের আত্মপ্রবঞ্চনার আত্মঘাতী ইতিহাসও। তাতে আজকের কবিকুলের কিছু যাবে আসবে না ঠিকই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে পিছিয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী অভিঘাত কোন ভাবেই মুছে ফেলা যাবে না।

না, সুখের কথাই হোক আর দুঃখের কথাই হোক আমরা প্রায় কেউই এইসব বিষয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনায় সময় নষ্টে রাজি নই। আর যাই হোক আমাদের অধিকাংশেরই বিশ্বাস, কবিতা সুখবিলাসের নান্দনিক মাধ্যম। বিশুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম সহজ হাতিয়ার। সকলের মাঝে গ্রন্থপ্রকাশের আত্মপ্রসাদ লাভ করার একমাত্র উপায়। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা প্রবাহমান সময়ের ণত্ব ষত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যায় করবোই বা কেন? তাতে তো আর আমার নতুন বই উন্মোচনের কোন বন্দোবস্ত হবে না। ফলে আমরা চাই আর না চাই, এই সময়ের বাংলা কবিতায় আসলেই কিন্তু আমরা আমাদেরই স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে যার বিচার হবে। অবধারিত ভাবেই।

আমাদের এই ব্যক্তি স্বাক্ষর যে নো-ম্যান্স ল্যণ্ডের সৃষ্টি করে ফেলেছে, যার কথা শুরুতেই একবার উল্লেখ করা হয়েছে, সেই নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডেই বাজিকরদের তর্জনীর শাসনে ধুকপুক করছে বাংলার সংস্কৃতি। এবং এই নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডেই অবরুদ্ধ আজ বাংলা ও বাঙালি। ক্যাঁটাতারের উভয় পারেই। বাংলা কবিতাও দমবন্ধ করা হাড়হিম এই নো-ম্যান্সল্যাণ্ডে, কবির কথমত নিছক শব্দের কঙাল হয়ে প্রহর গুনছে। হয়ত সেই কারণেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মদন তাঁতির শূন্য তাঁতে মাকু চালনোর মতোই আমাদের নিয়মিত কবিতাপত্র প্রকাশের আয়োজন এখনো বন্ধ হয় নি। কিংবা আমরা হয়তো কবির ‘এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা’ আপ্তবাক্যকেই শিরোধার্য্য করে ঘুরপাক খাচ্ছি মাসিক কবিতা প্রকাশের আয়োজনের বৃত্তে। জানি কথা ছিল পথ চলা। কিন্তু পথ যখন দেখা যায় না, থেমে না গিয়ে অন্তত পথের চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকলেও, অন্তত চলতে না পারলেও চলার ছন্দটুকু ধরে রাখা যায়। আমাদের অনেকেরই সাহিত্যচর্চা আজ সেইখানে সক্রিয় রয়েছে অন্তত। পাখা বন্ধ করার থেকে যা হয়ত মন্দের ভালো।

একটানা চার বছর অতিক্রম করে গত ফাল্গুনে পাঁচে পা দেওয়া কবিতাউৎসবের মাঘ ১৪২৬ এর আয়োজন অন্তত সেই চলার ছন্দটুকু বজায় রাখার ঐকান্তিক প্রয়াস হিসাবেই স্বীকৃত হোক। এইটুকুই আমাদের দাবি। এর বাইরে দাবি করার মতোন কোন সত্যমূল্য আমাদের হাতে না থাকলেও আপাতত এইটুকু নিয়েই চলতে হবে। যতদিন সম্ভব। তাই দুই বাংলার শতাধিক কবিতার ডালি নিয়ে প্রতি সংখ্যার মতো এবারের আয়োজনেও রয়ে গেল আমাদের চলতে থাকার প্রয়াসটুকু। সকলে স্বাগত। বছর শেষের ভালোবাস। সামনে বৈশাখী নতুন বছর। আগাম শুভেচ্ছা।

৭ই চৈত্র ১৪২৬