আলম তৌহিদ
গীর্বাণ
প্রমিথিউসের মতো স্বর্গ থেকে
আনি নাই আগুন,
পাথর দীর্ণ করে ফোটায়নি
আলোর কণা,
সমুদ্রের অতলান্ত থেকে রুদ্র রোষে
তুলে আনি নাই
কালের ঘূর্ণিঝড়।
যাইনি বর্বর কবিদের অহেতুক
পৌনপুনিক কবিতার আড্ডায়।
কেবল জ্বালিয়েছি বোধেরবাতি
শব্দ-বাক্য-মন্ত্রে ছুড়েছি গীর্বাণ।
হেমলক নীল গরল
আমাকে সক্রেটিস ভেবে
তুমি দিয়ে গেলে একপাত্র গরল।
আমার ধমনীর শাখা-প্রশাখাতে
বয়ে যাচ্ছে হেমলক স্রোত।
ক্রিটো আমার কি মোরগ আছে ?
অ্যাসক্লেপিয়াসের কাছে আমার ঋণ
যদি পার দিও শোধ করে।
একটি মোহরের দামে
আমি কিনব না অন্ধ-বিশ্বাস।
আমার শব্দগুলো বিহঙ্গ হবে
আলোক বিন্দুর মতো
ছড়িয়ে যাবে সবখানে আর
আমার আত্মার অর্কেস্ট্রায়
নিরন্তর বেজে যাবে ভাঙ্গনের শব্দ।
যেভাবে নদীর স্রোত ভাঙ্গে মৃণ্ময় শরীর
জোছনা ভাঙ্গে রাতের অন্ধকার,
বিহঙ্গ ভাঙ্গে স্নিগ্ধ-সকাল,
তুখোড় সময় ভাঙ্গে কাল-মহাকাল।
হেমলক নামছে-
দ্রুত নেমে যাক এই নীল তরল
আমার শিরা-উপশিরাতে রঙধনু স্রোত
চেতনা-চৈতন্যে কীর্তিনাশা ঝড়।
আমার শোণিতে লোহিত সৌরভে
হেমলক নামছে-
দ্রুত নেমে যাক এই নীল তরল।
লোহিতাভ
সাম্পান
তক্ষশীলার
অরণ্যে থেকে সঞ্জীবনী আরক
শরীর-স্নায়ুতে
দিয়ে গেলে আরোগ্য সুবাস
নালন্দার
আহবানে আমি হই মুখোমুখি
দর্শনের
দর্পণে।
তারপর
তুমুল তর্কে তর্কে
নদীয়ার
বিদ্যাপীঠে হারিয়ে স্মৃতির জোছনা
মহেঞ্জোদারোর
নীল উপতক্যায় বসে শুনি
ভারতবর্ষের
আদি গান।
হরপ্পার
সিংহদ্বারে চাতকির মতো
বসেছিল
যে মেষবালিকা
সে কি
খুদিত পাথরে লিখেছিল
আমার নাম?
আমি তার
কিছুই জানিনা বলে
মাধুরার
ধূসর অতীতে
ইতিহাসের
দিশেহারা বাউলের মতো
হাঁটতে
হাঁটতে, নিবিড় অন্ধকারে
পার হয়ে
আসি শিব মন্দির।
দেখি পাষাণ
গম্বুজে শিবের ত্রিশূল
নক্ষত্রের
মুখোমুখি অনড় দণ্ডায়মান।
পারিনা
তাকাতে নক্ষত্রের দিকে
কেন জানি
অতিকায় নক্ষত্র
জোনাক
পোকার মতো ছোট দেখায়,
আড়াআড়ি
নেমে আসে উল্কার আগুন।
আমি তো
ভজনে বিশ্বাসী নই,
শিখিনি
অমল ভালোবাসা
আর এদিকে
অমরাবতীর কাননে
তুমি সাজিয়ে
নিলে প্রেমের নৈবেদ্য।
অকস্মাৎ
নিজেকে আবিষ্কার করি
অজন্তার
দারুণ এক জগতে।
সেখানে
নিদ্রিত বুদ্ধের পাশে নগ্ন যুবতীরা
অবিরল
গেয়ে যাচ্ছে সমর্পণের গান-
‘বুদ্ধং
শরং গচ্ছামি’।
শর্তহীন
আত্মসমর্পণে আমার বিশ্বাস নেই।
অযোধ্যায়
স্তম্বিত হয়ে থেমেছিলাম বটে,
মনে পড়ে
ইতিহাসের কৌতুক !
মন্দির
ভেঙ্গে পড়ে, মসজিদ ভেঙ্গে পড়ে, সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে,
আরও ভেঙ্গে
পড়ে আমাদের অঙ্গিকারলব্ধ ভালোবাসা।
তাই আমি
লহমায় মন্দির পেরিয়ে যাই,
পেরিয়ে
আসি বাবরি মসজিদের মিনার থেকে আজানের ধ্বনি।
হে অদৃশ্যবাদিরা
!
অপার্থিব
বাসনার সমুদ্রে আর কতকাল করে যাবে অবগাহন?
হে ক্রুশবিদ্ধ
যিশু !
বল তোমার
মৃত্যু মানে কার পরাজয়?
মাধুরার
অন্ধগলিতে মুছে গেছে কত ইতিহাস।
কীটদষ্ট
ইতিহাসের জীর্ণপাতা ঝেড়েমুছে তুলে নিই হাতে,
আমার আর
যাওয়া হয়নি অমরাবতী।
তারপর
মুছে গেছে তোমার আমার যূথবদ্ধ জীবন-অঙ্গিকার,
কেবল ভেসে
যাচ্ছে লোহিতাভ সাম্পান মানবিক নগরে।