বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে



সম্পাদকের কলমে

আবারও হেমন্ত নেমেছে বাংলায়। আকাশে নীল ধরছে নীলে। বাতাসে মিষ্টি বাঁশির ডাক। শরীরে নরম রোদের আদর। সদ্য শেষ হয়েছে উৎসবের ঘনঘটা। সামনে শীতের হাতছানি। শিশিরে শিশিরে বাংলার সবুজ আরও যেন ঘন হয়ে আসে। প্রকৃতির শান্ত হাসিমুখ দেখে কলমের কালির হৃদয়ও উসখুস করে। ছন্দে ছন্দে পথ চলার আনন্দকে অনুভব করতে। এই যে পথ চলার আনন্দ, এটিই বড়ো কথা। এই আনন্দের ভিতরেই আমাদের যাবতীয় সাফল্য ও অর্জন। সার্থকতা ও সমৃদ্ধি। আমরা এই আনন্দেরই ভাগ পেতে চাই। তখনই তো মনে হবে জীবন সার্থক। “সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে”। শোনা যায়, তাঁর লেখা এই অনন্য বাক্যটিই নাকি শেষ জীবনে কেটে দিতে চেয়েছিলেন কবিগুরু। প্রান্তসীমার রবীন্দ্রনাথের সাথে এক সাক্ষাতে প্রশ্ন করেছিলেন সাহিত্যিক যাযাবর। তাঁর প্রথম জীবনের লেখা এই গানটি শেষ জীবনে লিখতে গেলে কিভাবে লিখতেন কবি? আর তখনই কবি বলেছিলেন, সার্থক কথাটি কেটে দিতাম। ভাবলে আশ্চর্য্য হয়ে যেতে হয়। তিরিশের দশকের বাংলায়, রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করছেন, এই দেশে জন্ম নেওয়ায় আর সার্থকতা নাই! বলছেন সেই রবীন্দ্রনাথ। যাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছে আধুনিক বঙ্গসংস্কৃতি! কবির সাথে সাহিত্যিক যাযাবরের সেই সাক্ষাতের পরে কেটে গিয়েছে প্রায় এক শতাব্দী। সেই বাংলাও আর নেই। সেই সময়ও আর নেই। একাধিক টুকরোয় বিভক্ত বাংলার ভুখণ্ড। বাংলার অনেক জনপদই আজ আর বাংলার মানচিত্রে নাই। অন্যান্য জাতির ভৌগলিক মানচিত্রে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে। ঢুকে গিয়েছে আসাম, বিহার ঝাড়খণ্ডের ভিতর। পূর্ব বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমেই অবাঙালিদের আধিপত্য ও ক্ষমতার বিস্তার ও বৃদ্ধি ঘটছে। বাংলাভাষা ক্রমেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। সঙ্কুচিত হচ্ছে বাঙালি ও বাংলার সংস্কৃতি। হয়তো কবি এই পরিণতিও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। যার বিষবৃক্ষের চারাগাছ সেই তিরিশের দশকেই মাথাচাড়া দিয়ে জানান দিচ্ছিল কবির দূরদৃষ্টির সংবেদনে।

বহু টুকরোয় বিচ্ছিন্ন বাংলার অখণ্ডতা। বহু সংস্কৃতির প্রভাবে বদলাচ্ছে বাঙলার নিজস্ব সংস্কৃতির রূপরেখা। সময়ের সাথে যেন একটু দ্রুতই পাল্টিয়ে যাচ্ছে চারপাশ। কালের নিয়মে কোন কিছুই স্থির নয়। অটল নয়। অভ্রান্ত নয়। এতো শাশ্বত নিয়ম। তবু তার ভিতরেও কথা থেকে যায়। নিজস্ব শিকড়ের সাথে সংলগ্নতার বিষয়টি দেশ কাল নিরপেক্ষ ভাবেই সমান প্রাসঙ্গিক। সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে আমাদের হয়তো এইখানেই মূল পার্থক্য। কালের সাথে দিনবদলের ধারাতেও নিজস্ব শিকড়ের সাথে সংলগ্নতা ছিন্ন করে না প্রায় কেউই। অন্তত প্রথম বিশ্বের উন্নত জাতিগোষ্ঠী সমূহ। ব্যাতিক্রম শুধু আমরা বাঙালিরাই। সেখানেই আমাদের অনন্যতা। সেখানেই আমাদের পতন। সেখানেই আমরা ব্যাতিক্রমী। আমরা বাঙালিরা। তাই আমাদের কর্ম আমাদের ধর্ম বহু কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও অখণ্ড বাঙালিয়ানার সাথে সম্পর্কহীন। বস্তুত অখণ্ড বাঙালিয়ানা একটি কষ্টকল্পিত বিষয়। এইখানেই হয়তো আমরা আমাদের শিকড়ের সাথে সংলগ্ন নই আর কোনভাবেই। বিশেষ করে নাগরিক বাঙালি তো নয়ই। শিক্ষিত বাঙালিমাত্রেই সকলেই প্রায় তাই বিশ্বনাগরিক মনে করে নিজেদের। আর সেইখান থেকেই রূপ নিতে থাকে নাগরিক সংস্কৃতি। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে শ্লাঘা বোধ করতে থাকেন। এমনটাই তো হওয়া উচিত। হওয়ার কথা। কবি নিজেই না বলে গিয়েছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নি’। তাই শিক্ষিত নাগরিক বাঙালির একটি বড়ো অংশেরই ধারণা, বাঙালি হয়ে থাকাই মানুষ হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা। আর সেই কারণেই প্রথমেই সেই বাধাটা কাটিয়ে ওঠার জন্যেই আমাদের এত তৎপরতা। তাই আমরা কেউ বিশ্বনাগরিক। কেউ বিভিন্ন বৈদেশিক রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করায় গর্বিত। কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান। কেউ ভারতীয় কেউ বাংলাদেশী। কিন্তু কেউই কি আর আমরা বাঙালি? ফরাসীদের মতোন, বৃটিশদের মতোন। জার্মান, রাশিয়ান চৈনিক জাপানী মার্কিনদের মতো?  হায় কবি কি বলতে চেয়েছিলেন, আর আমরা কি বুঝলাম।

তাই আজকের বাংলা ও বাঙালির অবস্থান কবির আশা আকাঙ্খা অনুরাগের থেকে অনেক দূরবর্তী। হয়তো কেন, নিশ্চিত ভাবেই অনুমান করা চলে কবি সেকথা অনুমান করেই গিয়েছিলেন। নয়ত কেনই বা বলবেন, বাঙালি তার সবকিছুকেই অস্বীকার করলেও তার গানকে অস্বীকার করতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি, এই একজন মানুষ বাঙালিকে হাড়ে হাড়ে চিনতে পেরেছিলেন। তাই বাঙালি আর বাঙালি থাকতে রাজি নয়, সে বিশ্বনাগরিক হওয়ার আকাঙ্খায় দৌড়াচ্ছে উর্দ্ধশ্বাসে। সে জানে বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। আর সেই ভিলেজের ভাষা ইংরেজি আর ডলার। বাঙালি তাই তার সন্তানকে প্রথমেই ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছে। উঠে যাচ্ছে দিনে দিনে বাংলা ভাষায় পঠনপাঠন। বাংলামাধ্যম স্কুলের সংখ্যা কমছে দিনে দিনে। এরপর এমন একটি শিক্ষিত প্রজন্ম আসবে, যে প্রজন্ম আর বাংলা পড়তে ও লিখতে পারবে না। এমন অশিক্ষিত পরিস্থিতি আগে কোন জাতির জীবনেই আসেনি। কিন্তু বাঙালির জীবনে আসবে। সেই অশনিসংকেতই দেখা যাচ্ছে চারিদিকে। ভাষাই যদি হারিয়ে ফেলি, তবে সংস্কৃতি রক্ষা করবো কি দিয়ে? সংস্কৃতিই যদি রক্ষা করতে না পারি, তবে আত্মপরিচয় গড়ে উঠবে কোন পথে? আর আত্মপরিচয়হীন জাতির অস্তিত্বই তো থাকে না।

তাই বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে তার নিজস্ব সংস্কৃতির নিরন্তর চর্চা জারি রাখা জরুরী। সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে গেলে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন পথ নাই। আর এই কারণেই আমাদেরকে আরও বেশি সচেতন ভাবে বাংলাভাষার চর্চার প্রতি, বাংলা ভাষার বিস্তারের বিষয়ে উদ্যমী হতে হবে। সেটি একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা আমাদের নিজস্ব শিকড়ের সাথে সংলগ্ন হতে পারবো। নিজের শিকড়ের সাথে এই সংলগ্নতা তখনই সম্ভব কেউ যখন আপন জাতিসত্বার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে, ও জাতিসত্বায় গর্বিত হতে পারে। আপন জাতিসত্বায় গর্বিত হতে পারলেই অন্যান্য জাতিসমূহের সাথে আমাদের সম্পর্ক যথাযথ মর্য্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। আর তা নাহলে আমাদের কেবলই অনুকরণ আর নকল করে যেতে হবে আজকের মতোন। সর্বদাই বাঙালিত্বের পরিচয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে আমাদের। সেই রকম হীনমন্যতায় আক্রান্ত কোন জাতির পক্ষেই সাহিত্য সংস্কৃতিতে বিশ্বকে দিয়ে যাওয়ার মতো কোন রসদ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। আর তা না হলে বিশ্বসভার এককোণেই পড়ে থাকতে হয় জড়সড় হয়ে।

আমাদের কবিতা লেখা কবিতা প্রকাশ কাব্যচর্চার দিগন্ত এই বোধে জেগে না উঠলে, সেই কাব্যচর্চা নেহাতই শব্দের কঙ্কাল সাজিয়ে তোলা মাত্র। আমাদের সাহিত্যচর্চা যে ভাষাতে, সেই ভাষার সাথে যুক্ত সেই ভাষার ভাব সেই ভুখণ্ডের লৌকিক সংস্কৃতির আবহমান উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারকে পাশ কাটিয়ে অস্বীকার করে আর যাই হোক সেই ভাষায় নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। নকল করা যাবে। অনুকরণ করা যাবে। কিন্তু মৌলিক সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই কারণেই নিজস্ব শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতা এত বেশি প্রাসঙ্গিক। দুঃখের বিষয়, আজকের সাহিত্যে সেই দায়বদ্ধতার বেশ একটা অভাব দেখা যাচ্ছে। কেন দেখা যাচ্ছে, সেই কথাই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে পূর্বেই। ফলে নিরালম্ব সাহিত্যসাধনা নয়, করতে হবে আত্মপরিচয়ের উদ্বোধনের ভিতর দিয়ে আবহমান বাংলার উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে আধুনিক মননজাত সাহিত্যচর্চার অভ্যাস। নিরন্তর ভাবে। আর সেই আত্মপরিচয়ের উদ্বোধনের পথ জাতিসত্বার উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই সম্ভব। এই বোধটুকুই আজকের এই সময়ে অত্যন্ত বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক আরও এই কারণে যে, সেই বোধেরই আকাল আজ সবচেয়ে বেশি।

অগ্রহায়ণ ১৪২৬