শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

সম্পাদকের কলমে





কবিতাউৎসব সম্পাদকীয় পৌষ ১৪২৫

খড়কুটো

বাংলার সাহিত্য জগতে কবি সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে সাহিত্যিকের কলমের জোর বেশি প্রয়োজনীয় নাকি, সাহিত্য জগতের রথীমহারথীদের আশীর্বাদের হাত মাথার উপর থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরী? বর্ষীয়ান কবিদের আশীর্বাদের হাত মাথার উপর না থাকলে, একজন তরুণ  সাহিত্যিক কি খড়কুটোর মতোই উড়ে যেতে পারেন? সত্যই কি তরুণ সাহিত্যিকদের সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে প্রভাবশালী সাহিত্যিকের নেক নজরে থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরী? এই নিয়ে স্বভাবতঃই কোন বিতর্কের অবকাশ থাকার কথা নয় যে, প্রতিটি প্রজন্মের কবি সাহিত্যিক তাঁর পূর্ববর্তী প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকদের কাছে ঋণী থাকেন। সেই ঋণ স্বীকারের ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেটি অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু কেউ যদি দ্ব্যর্থহীন ভাবে মনে করেন যে বিশেষ বিশেষ প্রভাবশালী সাহিত্যিকের আশীর্বাদের হাত মাথার উপর না থাকলে তরুণ কবিরা খড়কুটোর মতোন উড়ে যেতে পারেন, তখন কিন্তু সেই ধারণা আমাদের সত্যই নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আমরাও নড়েচড়ে উঠি। সত্যই কি একজন কবি সাহিত্যিকের সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিশেষ কোন গোষ্ঠী বা সাহিত্যিকের আশীর্বাদের হাত এতটাই জরুরী যে, সেটি না হলে তরুণ কবি সাহিত্যিকরা খড়কুটোর মতোন উড়ে যাবেন? তরুণ কবির কলমের প্রতিভাও তাঁকে রক্ষা করতে পারবে না? অর্থাৎ সাহিত্যিকের কলমের থেকেও বড়ো তাঁর সামাজিক খুঁটির জোর। প্রশ্ন এখানেই। বিতর্ক এই নিয়েই।


আমরা জানি, সাহিত্য সমাজ নির্ভর একটি সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া। সমাজ সাহিত্য নির্ভর নয়। তাই সমাজ ও সমকালের প্রভাবেই আবর্তিত ও বিবর্তিত হতে থাকে সাহিত্য ও সাহিত্য জগৎ। একবিংশ শতকের প্রথম ভাগে দাঁড়িয়ে বাংলার আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে কোন কাজেই খুঁটির জোর যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেকথা আমরা সকলেই জানি। আমরা জানি বিপদে আপদে এমনকি সম্পদ গড়ে তুলতে গেলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক খুঁটির জোর ছাড়া কোন কাজই সহজে সম্পন্ন হয় না। আমরা একথাও জানি প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য পেতে গেলেও প্রভাবশালী মানুষের সাথে বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ঠিক মতো করে ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে। না পারলেই উড়ে যেতে হয় খড়কুটোর মতো। এই যে সামাজিক বাস্তবতা, স্বভাবতঃই সাহিত্য সংস্কৃতির জগতও এর বাইরে নয়। স্বীকার করি আর নাই করি, এই কথা কে না জানি আমরা। জীবনের চলা পথে প্রতিপদেই এই বাস্তবতার ভিতরেই চলাচল আমাদের। তাই যে কোন বিষয়েই প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে হৃদ্যতা সখ্যতা আমাদের কাছে প্রায় আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের মতোই কার্যকরী।

সেই প্রদীপের আলো যার মাথার উপর থাকে তাকে আর পায় কে। যার থাকে না, তাকে তো উড়ে যেতেই হয় খড়কুটোর মতো। কিন্তু এই যে অবস্থা, তা কতটা কাম্য? আর কতটা ভয়ঙ্কর ভেবে দেখি কি আমরা আদৌ? আমরা বরং যে যার ক্ষমতা মতো সেই ভয়ঙ্কর অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলার বিষয়েই অধিকতর সচেতন, ব্যগ্র ও ব্যস্ত। অত সময় কোথায় আমাদের ঔচিত্য নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে সময় নষ্ট করার? আমরা কি ভেবে দেখি, এই প্রবণতা আমাদের সমাজকে কোন পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে? সেই পথে জাতির ভবিষ্যৎই বা কি? জাতির মেরুদণ্ডের উপর এই পথের প্রভাবই বা ঠিক কি রকম? না সত্যই অতশত ভাবনা চিন্তার সময় নয় এটা। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাই আমরা সকলেই ছুঠতে চাই সকলের আগে। আর সেই দৌড়ে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির আশীর্বাদের হাত মাথার উপর জোটানো কতটা কার্যকরি সেটি আমাদের কারুরই অজানা নয়।

জীবনের অন্যান্য দিকের মতোই সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনেও এই অবস্থা আজ প্রায় চীনের প্রাচীরের মতোই অটল ও স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া বন্ধ দরজাগুলি খোলা যে কি পরিমানের অসাধ্য কাজ সেটা ভুক্তভোগী মানুষ মাত্রেই জানেন। আবার ভাগ্যবান মাত্রেই জানেন কত স্বল্প মেধা নিয়েও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের স্নেহধন্য হতে পারলেই আলোকিত মঞ্চের উপর কত সহজেই রাজত্ব কায়েম করা যায়। এইখানেই আমাদের সমাজে রাজনীতিতে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের গুরুত্ব আজ সীমাহীন। সেই গুরুত্ব যে শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সমান ভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে সেকথা তো বলাই বাহুল্য। তাই তরুণ সাহিত্যিকদের কাছে প্রভাবশালী সাহিত্যিকের আশীর্বাদের গুরুত্ব ও ব্যপ্তি ও সেই আশীর্বাদের প্রভাব ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। থাকে না বলেই নড়েচড়ে উঠতে হয় আমাদের। আমরা নড়েচড়ে উঠি, কোন বিশেষ কবি বা সাহিত্যিকের জন্য নয়, নড়েচড়ে উঠি সমাগ্রিক সাহিত্য জগত সম্বন্ধেই। নড়েচড়ে উঠি আমাদের সমাজবাস্তবতার সামগ্রিক পরিণতির কারণেই।

কিন্তু কেন এই পরিণিতি? কেন কলমের জোরই শেষ কথা বলবে না। কেন কলমের জোরকেও নির্ভর করতে হবে প্রভাবশালী খুঁটির জোরের উপর? একটু যদি পিছনের দিকে ফিরে তাকাই, দেখতে পাবো একদিনেই এই পরিণতি ঘটে নি। ঘটেছে দিনে দিনে। পিছনের দরজা দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতার অভিশাপে দ্বিখন্ডিত জাতিসত্ত্বার এই পরিণতি ভবিতব্যই ছিল বা হয়তো। স্বাধীনতার ফাঁকিটা যারা ধরতে পেরেছিলেন, কাঁটাতারের দুইপারেই তাদেরকে সচেতন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ একটি যুগপর্বে। এইপারে নকশাল আন্দোলনের সামূহিক ব্যর্থতায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অক্ষ অত্যন্ত সচেতন ভাবে একটি মেধাবী প্রজন্মকে একেবারে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল সত্তরের দশকেই। ওপারে মুল্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবী নিধন যজ্ঞে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে উজ্জ্বল মেধাগুলিকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছিল নারকীয় ভাবে। ফলশ্রুতিতে কাঁটাতারের দুইপারেই বাংলাকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার সামগ্রিক চক্রান্ত এমন ভাবেই সফল হয়েছিল যে আজকে দুই পারেই এক মেধাশূন্য সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী বলয়ের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এই বলয়ই সমাজের পৌরহিত্যে এগিয়ে আসায় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছে দুই বাংলাতেই। যেখানে কলমের জোর থেকেও অধিকতর শক্তিশালী খুঁটির জোরের। সেই খুঁটির জোর জোগার না করতে পারলেই উড়ে যেতে হয় খরকুটোর মতোই। এটাই আজ বাস্তবতা কাঁটাতারের দুই পারেই। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনও এই বাস্তবতার বাইরে নয়। সে সত্য কেউ স্বীকার করি আর নাই করি।

দুর্ভাগ্য আমাদের, এই বাস্তবতার ভিতরে চলাচল করতে করতে এটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে অভ্যস্ত আমরা প্রায় সকলেই। ফলে এক মেধাহীন নেতৃত্বের অধীনে আজকের সমাজ ও রাজনীতি। মানুষের ভুত ভভিষ্যৎ বর্তমান। মেধশূন্যতার এই দিগন্তে জনপ্রিয়তাই প্রতিভার একমাত্র মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আর সেই জনপ্রিয়তা নির্ভরশীল খুঁটির জোরের উপরেই। যে খুঁটির জোর না থাকলে জনপ্রিয়তার আলোকিত মঞ্চের বহুদূর দিয়েই খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে থাকে জাতির ভবিষ্যৎ উৎকর্ষতা। ঠিক এই কারণেই আজ কাঁটাতারের দুই পারেই প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের আশীর্বাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় আর কিছুই। যদি সমাজে লাইমলাইটে আসতে হয়। যদি জনপ্রিতার সিঁড়িতে পা রাখতে হয়। যদি করেকম্মে খেতে হয়। যদি গুছিয়ে নিতে হয়। সবখানেই তাই প্রভাবশালীদেরই রমরমা। চলছে চলবে। সময় থাকতে বুঝতে পারলে ভালো না হলে উড়ে যেতে হবে খড়কুটোর মতো।

ঠিক সেই উড়ো খড়কুটোদের জন্যেই কিন্তু কবিতাউৎসব। আমরা জনপ্রিয় বিখ্যাতদের জন্য অপেক্ষা করি না। আমরা কলমের জোরের পদধ্বনি শোনার আসায় উৎকর্ণ থাকি প্রতিটি মাস। আমাদের আশা ইনটারনেট যে অনন্ত সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, সেটিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবের বাইরেও সদর্থক সৃষ্টিশীল কাজকর্ম করে যাওয়া সম্ভব। আর সেই আশাতে ভর করেই কবিতাউৎসবের পথচলা। সেটি বর্তমানে হামাগুড়ি দিলেও ক্ষতি নাই, যদি লক্ষ্য ও প্রত্যয় থাকে স্থির। সেই প্রত্যয়েই কবিতাউৎসবের পৌষ সংখ্যায় আয়োজন। এবারের আয়োজনের বিশেষত্ব এই সংখ্যাটি আমন্ত্রণমূলক সংখ্যা। কবিতাউৎসব তাই সেই কলমের জোরের কাছেই নতজানু থেকে এই সংখ্যার আয়োজন নিয়ে হাজির হয়েছে পাঠকের দরবারে।