শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

তারিক-উল ইসলাম


তারিক-উল ইসলাম

শরণার্থী সময়

কাঁদে সন্তান, মৃত মাছের আঁশের মতো ভাসে বাবার চোখ।
যেন উদ্বাস্তু জীবন আমাদের। ভয়ে কাঁদতেও পারিনা।
শুনি বন্দুকের গুলির শব্দ। বিক্ষত হৃদয়। হাঁটি শামুকের মতো।
বারুদের ধোঁয়া অন্ধকারে কুণ্ডলি পাকিয়ে আঁকে ভ্রুকুটি।
কাঁদে সন্তান, আমরা কাঁদতেও পারিনা!

যারা পারে, তারা কেবলই পারে। আমরা পারিনা।

যেন রোপওয়ের কাছে এসে ঝুলে আছি পাহাড়ের ওপর।
কাঁপছে হাত-পা। সন্ত্রস্ত চারদিক। আঙুলগুলো শূন্যে ভেসে আছে।
ঝরছে পলেস্তারা-ধুলো। তুলো ওড়া মেঘ যেন এখনই ঝরাবে বৃষ্টি।
যেন এই চরাচরে সূর্য উঠবে না আর কোনোদিন।
কাঁপছি হিম-বৃষ্টির শীতে। যেন এক শরণার্থী-সময়।

রেশনের চাল, খুদকুঁড়ো, জল ওঠা ধুলো ছড়ানো নুন
পেঁয়াজের রোয়া ওঠা খোঁসা, কম্বল। গন্তব্য নোম্যান্সল্যান্ড।
হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে আর কাঁদে আমাদের সন্তান।
আবারও মা হতে চলা স্ত্রীর ঠোঁটে ক্লান্তির লালা।
এই প্রান্তরে জ্বলে না চুলো। দূরে, জ্বলে ঝড়ে নিভু নিভু প্রদীপ।
যেন নিভবে এখনই, এক দমকায়। চমকায় বিদ্যুৎ।

যারা পারে, তাদের লাগে না পাসপোর্ট। তারা কেবলই যায়।
দাঁড়াবার নেই একটুও সময় তাদের। মঞ্চ-মাস্তুলে ওড়ে দেখি তাদেরই জয়।
আমাদের ছিন্ন পালে ওড়ে সুতো। ক্লান্ত জনপদ।
মানুষ খোঁজে অ্যাকুরিয়ামে শ্বাস, বুদবুদ জলের কাঁপন।
দাসানুদাস আমাদের পিঠে চাবুকের শব্দ, চর্চিত বিন্যাস।
আমরা এগোতেই পারি না।

শামুক তো বাঁচে অ্যাকুরিয়ামেই বেশিদিন। বাঁচে!
রক্তে কাঁপে বেদনার বল্কল। কাঁপে বুক।
ঝুলে থাকে রোপওয়ে। পাহাড় পেরোলেই আকাশ। সেইখানে আটকে থাকে চোখ।
শামুক-শরণার্থী জীবন আমাদের। পাহাড়ের কাছে এসে বসে থাকি।
এগোতেই পারি না। বাঁচি কেবলই ধুঁকে!

বন্দুকের নলের পাশে দেখি শোভাবর্ধন ফুল। দেখি মৃত পাঁপড়ি।
হত্যাকি করে হতে পারে শিল্পের স্লোগান! কাঁদে সন্তান।
মেলেনা হিসাব। ভুলি নামতা-ধরাপাত। সামনে কেবলই ভাসে রক্ত।
দেখি মৃত মাছের আঁশ। কাঁপে রোপওয়ে। এগোতে পারিনা।

আমরা কতিপয় কেবলই শুনি সন্তানের কান্না। আকাশ দেখিনা।
সব যেন বিষাদ-বিস্বাদ। ঘুমোতে পারি না।






ক্যাফেটেরিয়ার কুয়াশামাখা কাচে

কিছু ভালোলাগা আছে- ক্যাফেটেরিয়ার কুয়াশামাখা কাচে
রেখা বর্ণিল- দোয়েল না ফিঙে
শিস দিয়ে সে নাচে।


কিছু দেখা যায় কিছু ছায়া-ছায়া জোৎস্নাও দেখি ঝরে
কিছুটা সকাল কিছুটা বিকেল
ভোর-শিউলিও ওড়ে।
নিমগ্ন পাঠ শস্যের মাঠ ফুলেল সবই যে দেখি মুদু-মন্দ হাসে
বাতাসের পিঠে কলার ঝাঁকিয়ে
টগবগে হ্রেষা আসে।


কিছুটা সময় ব্যাকরণ ছাড়া রুমাল ওড়ানো খেলা
কিছুটা যেনবা পালক ছড়ানো
মৌসুমী কোনো মেলা।


জানালার গ্রিলে তারকাঁটা যদি তরু-তরুলতা- বহতা সে নদী
নৌকা তবে দাঁড়াবে কেন ঘাটে
জলের ফুলের স্রোত নিরবধি।


কাঠের পুতুল রাঙা ফিতে দুল তালপাখা হাওয়া দোলনা-দোদুল
স্বরেও কেবল বাজবে বাঁশি- রঙ-উচ্ছ্বাসে
থাকবে না কোনো ভুল।


কিছু ভালোলাগা আছে- ক্যাফেটেরিয়ার কুয়াশামাখা কাচে
রেখা বর্ণিল- দোয়েল না ফিঙে
শিস দিয়ে সে নাচে।


চায়ের কাপে ধোঁয়া-ধোঁযা চোখ দরোজা গলিয়ে সোজা
কাঁপা-কাঁপা ঠোঁট ওলোট-পালোট
চুলের বেণীতে বোঝা।


             




এই সিঁড়িটি তোমার

ডুপলেক্সের এই সিঁড়িটি তোমার।
তুমি ওপরে উঠেছো সেই কখন কিন্তু নামছো না।
শব্দহীন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে টবের ফুলগুলি।
বাড়ি আছো বলে দিচ্ছি না ডাক।

দরোজা নেই একটিও। পাপড়ি-ছোঁয়া তোমার চুলগুলি
জানালা গলিয়ে আকাশ অবধি উঠে গেছে।
মেঘের আঙুল কেটে দিচ্ছে বিলি।
মুদে আসছে চোখ। স্বপ্ন দুলছে বাতাসে পর্দার মতো।
শব্দের ফুলগুলি রয়েছে তোমারই আঁচলে।

বাইকটা রেখে এসেছি দূরে একটি গাছের নিচে।
চুরি হলেও কিছু যায় আসে না।
পালঙ্কে তোমার আজ মেঘমালা-ফুলবেলা।
রাত না বাড়তেই জোৎস্না মেতেছে উৎসবে।

কিছু ফুল রেলিং টপকে উঠে গেছে ছাদে।
কার্নিশ বেয়ে সুবাস-সখ্য এনেছে বয়ে
জোৎস্না খেলা করছে পায়ের কাছে।
আর নিঃশব্দে সিঁড়িটির কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছি তৃণা,
এই আমি, তোমারই আমি।
আর গাছেদের সব পাতা গাইছে রবীন্দ্রগান-
আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…’

ফুল-জোৎস্নায় এই আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি ফুল হাতে।






তখন ঊনিশ

তখন ঊনিশ, উছলে পড়া দিন
রোদেও জলের ঢেউ
ঘাস-শিশিরে সূর্য আনে ভোর
আড়ালে চোখ, কেউ
দেখছে জানি জোৎস্না মাখা চোখে
মহুয়া ফুল নাচে
শিরিষ পাতায় কাঁপন তোলা ছবি
কে বাঁচায় কে বাঁচে!

মিছিলে মুখ দুরন্ত সেই হাত
অফুরন্ত চলা
জামার কলার দুলতে থাকে, হাসে
কল্প-গল্প বলা।

তখন ঊনিশ, তখন তুমি দূরে
গান গাই তবু তোমার সুরে সুরে।






চড়ুই ভোরে ডাকে মেঘের পাখি

হাতের আঙুল কড়া নাড়ে- আছো ?
হল্লা যেন, মহল্লাতে- বাঁচো ।
খিড়কি দুয়ার, কপাট খুলে রাখি;
সাড়া পেলেই রঙ-তুলি নিই, আঁকি ।

তখনও চাঁদ দিচ্ছে জানান- আছি;
গাছ পেরিয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে- মাছি ।
সবুজ জলে ভৈরবী সুর ভাসে
যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে ।

দ্বৈরথে রয় মাদল আমার, জানি;
চলতে পথে ভুল করে মন, মানি ।
তবু কেন স্বপ্নডিঙা টানি !
খুনসুটি শেষ, অশেষ দিনের গ্লানি ।

চাঁদের বাড়ি জলবসতি ঘরে !
ওড়না মেঘের, বাতাস ছুঁয়ে ওড়ে।
চোখের নিদাঘ নিদাঘই রয়, পোড়ে ;
রয় দ্বৈরথ মেলার কাঁকন, ঘোরে।

তবুও মেঘ জলজ রাখী হাতে
জল হয়ে রয়, থাকে জলের সাথে ।
চড়ুই ভোরে মেঘের পাখি ডাকে
বিলীন নীলে নতুন ছবি আঁকে ।







লিখেছে সে

নদীর জলে অবুঝ সবুজ পাতা, আকাশ যেন ত্রাতা
ডাক দিয়ে মেঘ ওড়ে।
আসছে শরত নেমে, শিউলি-কাশে আসছো তুমি
মন যে কেমন করে।

বর্ষাজুড়ে ভরসা ছিল লেখা, রেখেছি সেই চিঠি
হাতটা দিও-প্রিয়।
সময় রেখো পাশে, গল্প বলা দীর্ঘ রাতের খামে
পরশটুকু নিও।







যেই রঙ বলে, আয় নিরঞ্জন

ভোরে সেতারের যেই সুরে ঘুম ভাঙে, দূরে যেই ব্যঞ্জনা ছড়ায় সূর্যটা
যেই রঙ পাখির পালক হয়ে নিজেকে ছড়ায়, বলে- আয়, নিরঞ্জন ;
সেইজন তুমি। তুমি মানে তুমি, তুমি একজনই।

মেঝে-কার্পেট আর ঘাসের জাজিমে কোনোদিনই কোনো পার্থক্য দেখি না।
সকাল, দুপুর, বিকেল-সন্ধ্যা, রাত- সবটাই নদী-নৌকা, রূপবতী;
লাভ নাকি ক্ষতি কখনও করি না হিসেব।

যেই নীল আকাশটা ধরে রাখে, সাদা মেঘে ছবি আঁকে, সাজায় কথামালা
ছন্দে-বন্ধে যেই নূপুরের শব্দ দিনভর আকুল করে রাখে;
হাত ধরে থাকে, তার সাথে লীন হয়ে থাকি।

যেই উদ্যান গাছ আর পাখিদের মিতালী গাঁথে, সবুজে আঁকে অবুঝ ছায়া
জোৎস্নায় ছড়ায় আবীর, অধীর যেই ব্যালকনি সিঁড়ি হয়ে যায়;
স্বপ্নেরা কেবলই বিস্তৃত বনভূমি, সেইজন তুমি।

দৃশ্য অদৃশ্য হলে যদিবা কখনও হারাই পথ, ভুল নয়, থাকে ফুটে ফুলগুলি
হোক ডাঙ্গুলি, কানামাছি-ধুলো, জেনো, সেখানেও থাকি;
রাখি প্রীতি-পক্ষপাত, আঁকি শুধু তোমারই ছবি।

সারাদিন-সারারাত আরাধ্যজন তুমি। স্বদেশ তুমিই, আমার প্রিয় মনোভূমি
তোমাতেই রাখি স্বপ্ন, আস্থা, নিই প্রশ্বাস, বাঁচি তোমাতেই;
তুমি মানে তুমি, তুমি একজনই। করি তোমারই বন্দনা।







যাও পাখি, যাও

যাও পাখি, যাও। রোদের সাথে যাও। বোধের সাথে যাও।
ছায়া-বৃষ্টির সাথে যাও। নদীতে নৌকার মতো যাও।
জলে যেই ইলিশরঙ রূপালি ঢেউ, পালে যেই গাঙচিল- হাওয়া,
আকাশের নীলে যেই সাদা, উড়ে উড়ে যাও। যাও মেঘ, যাও।
যাও নীল টিপ, যাও কাজলের কালো, যাও বজ্র, যাও।

মেঘের প্লাবনে নেই সভ্যতার ছল, নেই শৃঙ্খল। খোলা অর্গল।
সূর্য করে না কারও দাসত্ব। বৃক্ষ করে না কারও পরোয়া,
আরাধনাই স্বভাব তার। আরাধ্য ভূবনে যাও।

মেঘে-বৃক্ষে পল্লবিত বল্কল, ছায়ার সবুজ স্বভাব
মায়া ছাড়া জানেনা কিছুই।
খাঁচায় যেই বন্দিত্ব ভৃত্য করেছে, যেই কষ্টকাল
বহাল বহাল বলে ঘুঙুর আখ্যা দিয়ে পায়ে যেই শেকল পরিয়েছে
খাবার বলে সামনে ছড়িয়েছে খুদকুঁড়ো, তাকে উপেক্ষা করো।
ডানায় রাখো নিজস্ব স্বভাব।
বলো প্রাণ- দিগন্তই তোমার ঠিকানা।

যাও পাখি, যাও- ছায়া-বৃষ্টি মেঘ জল সূর্যের কাছে যাও।







ফিরবো না

খসে পড়া তরবারি তুলবো না
বিদ্ধ করো বুক।
জীবন-অসুখ নিরাময় হলে ফিরবো না।
ডাকে মায়ের অমল মুখ; তার কাছে যাবো
বাবার লুকানো চোখ, কান্নার পাঠে
নিমগ্ন হবো।

ঝাপসা চশমা তবু উজ্জ্বল উদ্ধার
শাড়ির আঁচল-
মা-মা বলে ডাকবো।
বাবার আঙুল ছুঁয়ে দেবে চুল
বিলিকাটা সন্ধ্যায় তারা গুণে ঘুমিয়ে পড়বো।
ফিরবেন মদনমোহন তর্কালংকার।
বলবো-
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো চলি।

যাবো স্কুলে, ফিরবো না বাড়ি।
মা কাঁদছেন আর বাবা খুঁজছেন
নাটাইয়ের সুতোয় ওড়ে ঘুড়ি।
উড়ি আকাশে, জল বাতাসে।

গেছিই তো চলে। ফিরবো না।






বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছি না

আর এক বাড়ি পেরোলেই আমাদের বাড়িটি; অথচ বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছি না। দুপুর থেকে ছাদে ঝুলছে টাঙানো তারে মেলে দেয়া মায়ের শাড়িটি। ল্যাম্পপোস্টের আধো আলো আধো অন্ধকারে হলুদ আলোয় খেলা করছেঝাঁক ধরে উড়ে আসা রাতপোকা; পাশেই গাছটিতে ডাকছে তক্ষক। একটু দূরে ডেকে ফিরছে সারমেয়; বাজছে নাইটগার্ডের বাঁশি।

সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন মা; বাবা ঘুমাচ্ছেন আবার জেগে উঠছেন। শুনছেন দেয়াল ঘড়ির শব্দ- টিক টিকটিক; ঘড়িটি দাদার আমলের। একটি কাঁসার জামবাটিও আছে সেই সময়ের; মা এটাতেই রেখেছেন
রাতের খাবার।
পেতলের গ্লাসটি টি-টেবিলে মায়ের মাথার কাছেই। ঘুমঘোরে একবার ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল গ্লাসটি;
আবার তিনি পূর্ণ করে ঢেকে রেখেছেন।

পিচঢালা পথ হয়েছে সেই কবেই; অথচ আজ দেখছি শুধুই ইট বিছানো। গাড়িচলা পথ; অথচ মনে হচ্ছে, একটাগলির মুখে দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের নিচে শব্দতোলা অনেকগুলি শুকনো পাতা; তলিয়ে যাচ্ছে আঙুল।পাতাবাহারেরসব সবুজকে মনে হচ্ছে ছোপ ছোপ অন্ধকার; কাঁপছে সব দেয়াল। কাঁপছি আমি এবং টলছি; যেন এখনই উল্টেপড়ে যাবো।

কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়ার আগেই টের পাবেন মা, আমি এসে গেছি; খুলবেন দরোজা।

সড়কনাম, মৌজা, খতিয়ান, দাগ, ম্যাপনকশা- সবই তো দেখছি ঠিক আছে। আর এক বাড়ি পেরোলেই আমাদের বাড়িটি; অথচ বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছি না। সরছে না পা; গলিমুখে দাঁড়িয়ে আমি কেবলই চিৎকার করছি-মা, আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, খুব ক্ষুধা পেয়েছে।

মাগো, আমার খুব ঘুম আসছে। ঘুম আসছে। ঘুম আসছে।...ঘুম...ঘুম...।