সুলতানা শিরীন
সাজি
তবু ঠিকানাতো
ছিল
কেউ বলে পাতারা ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কেউ বলে জমে যাওয়া শীত আসছে আবারো।
কেউ বলে অনেকদিন হয় যাওয়া হয়নি দেশে।
কেউ বলে রেঁধেছি কেচকী শুটকী আর
চিংড়ী কচুর মাখামাখা ঝোল।
পরানের ভিতর কোন পাখি ডাকে!
জানালা দিয়ে ডেকে যায় কৈশোর,
তারুণ্যের ঝলমলে দিন।
কেউ উলের কাটায় বোনে
সোজা উল্টা প্যাটার্ণ এর সোয়েটার।
কেউ কারো বুকের খুব কাছে দাঁড়াবে বলে
নিজেকে সাজায়।
এরই মাঝে একটা ৩০ অক্টোবর খুব সকালে,
কেউ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়,
আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথে পশ্চিম থেকে পূর্বে মিলায়।
জীবনের কিছু গল্প,কিছু কথা অর্বাচীন মনে হয় ।
অথচ কিছু কথোপকথন এ থাকে
নিজস্ব কারুকাজময় আয়না।
সেখানে যার ছায়া পড়ে সেই জানে,
কিছু কথা থাকে , বললে মনেহয় কবিতা।
কিছু কবিতা থাকে শুনলে মনেহয় জীবন।
এই জীবনের অদ্ভুত কিছু
প্রশ্নবোধক ঘুরে বেড়ায় বাতাসে।
কিছু গুঞ্জন, কিছু শব্দের গুটি হয়ে
খেলে বেড়ায় এখানে ওখানে।
নরম রোদের ওপারে খেলা করে কাঠবিড়ালী।
পাতাদের ফিসফাস এ শুধু গান গায় সুবীর সেন।
কোথাও সেই কুড়িগ্রাম এ,
ক্যারামের আড্ডায় কেউ গান গেয়ে ওঠে জোরে,
"যারা
ডাকে তারা ভুলে যায় ,
আমি নেইতো এখানে আর।
যেখানে ঠিকানা ছিলো ,
শুধু নাম হয়ে গেছে আজ"
তবু ঠিকানাতো ছিল একদিন!
তুমি, আমি এবং
পাখিরা
তোমাকে আমার কতকথা বলতে ইচ্ছে করে জানো?
সারাদিন কানের গাছে অবিরত গান গেয়ে যায় যেই পাখি।
ভীষন আদর আহ্লাদে লুটোপুটি অবিরাম !
ইচ্ছে করে বলি, আসো
এই নীলাক্ত পৃথিবীর শেষ সীমানায়।
অন্ধকার হয়ে আসে যখন,
টুংটাং উইন্ডচাইমের ডাক শুনে যদি আসো,
তাই অপেক্ষার আঙুল গুনি।
পথভোলা পাখি দানা ঝাপটে চলে যায় দূরে।
অভিলাষী অন্তরে শুধু মাছরাঙা পাখির ডাক।
খুব ইচ্ছে করে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শুধু তোমারই নাম ধরে ডাকি!
ঘন অন্ধকারে চোখ মেলে রাখি।
একসময় অন্ধকারের ভিতর ডুবে যেতে যেতে ট্রেনের হুইসেল শুনি।
রাতের শেষ ট্রেন চলে গেলে অপেক্ষা বৃষ্টি হয়ে নামে চোখের নদীতে।
খুব ইচ্ছে করে একটা বিরাট বাজপাখীর মত উড়িয়ে নিয়ে যাও আমাকে।
অথবা তোমার মুঠোর ভিতর ছোট্ট জোনাক করে ফেলো আব্রাকাডাব্রা বলে!
খুব ইচ্ছা করে ,অজস্র জোনাকীর ভীড়ে হারিয়ে যাই অনেকদূর!
যেখানে গেলে শুধু তুমি ,আমি
এবং পাখিরা !
চোখ
তুমি আমার চোখ এর দিকে তাকিয়ে থাকো যখন,
একটা রেলগাড়ি ঝমঝমিয়ে আসে।
ঝরঝর বৃষ্টির মত কথারা হাসে।
তুমি বলেছো , কি অস্থির অপেক্ষার মধ্যে যে আছো,
যেনো ছুটে আসা কাঠবিড়ালী।
বলেছো, দেখা না হলে মনেহয়
ক্যালেন্ডারের পাতারা সরছেনা দেয়াল থেকে।
বলেছো, ঠোঁটের লাল তিলের কাছে
জমা আছে অজস্র সুখের কাঁপন।
চোখে চোখে কথা বললেই শুধু
বুকের ভিতর জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস গলতে শুরু করে।
মনেহয় ভিতরের তোলপাড় হতে হতে একদিন
পম্পেই নগরীর কাঠ খন্ড এবং মানুষের মত স্থিরচিত্র
হয়ে যাবো ।
চোখে চোখে এভাবেই নদী বয়ে গেলে
একদিন সমুদ্রকে খুঁজে পাবো।
চোখে চোখে কথা বলে
এভাবে বয়ে যাবে অজস্র বছরের সাধ!
রোদ চুমকীর এই অন্তর বন্দরে
কতকাল ধরে আমি আছি
,আছো তুমি ।
হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে রোদের মত গলে পড়ো বুকে।
চখাচখির এই অপূর্ব প্রেমময়তার কাছে
কার না আসতে ইচ্ছে হয় বলো?
স্বপ্ন এবং
শীতকাল
রোদেরও হাহাকার থাকে।
রাতঘুমে যেমন জড়িয়ে থাকে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ইন্দ্রজাল।
সারারাত মৌ মৌ গন্ধভরা বসন্তকাল ছিল কাল ।
রেডিওতে শো শো আওয়াজভরা আকাশবাণী ছিল।
আর কত কিযে ছিল ঘুমের ওপারে !
মন খারাপের সবগুলো কথা বলে আসি সেখানেই।
চোখের ভিতর মহাশূন্যর মত ধূধূ প্রান্তরে ছুটে বেড়াতে বেড়াতেই
এলার্মটা বেজে ওঠে।
এত মিউজিক্যাল,মনেহয় ঘুমাই আবার।
আর, স্বপ্নজুড়ে কেবল উল্লসিত আনন্দর হাট!
চোখ মেলে দেখি রোদের মিছিলে বরফেরা ক্লান্ত ঝিমায়।
নীল আকাশটাতে কোন পাখি নেই আর,
চেনা কাঠবিড়ালীগুলো চলে গেছে শীতঘুমে।
এমন শীতার্তদিনে ইচ্ছেঘুম এর মধ্যে ঘুরে বেড়াই।
রেডিওতে এখন ও সেই গান শুনি
"কেটেছে
একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম-চয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে।"
গান শেষ হলেও সারাদিন শুধু গুনগুন ,
শান্তিনিকেতন এ যেতে ইচ্ছে করে খুব
,
সেই যে ছাতিম গাছের তলায়!
অক্টোপাস ভালোবাসা
আংটিটা খুলে রাখি প্রিয় কৌটায়।
যেখানে জমানো আছে তিনশো তিপ্পান্নটা বিকেলের মেহগনী রঙ।
বিশ্বাস হলোনাতো?
তাহলে ?
কৌটায় জমা রাখি, তোমার চোখের অথই নদী,
আর?
আর রাখি, বেড়ালের তুলতুলে গায়ের মত,
তোমার দেয়া নরম শিফন এর স্কার্ফ।
আরো কত কিযে জমা হতে থাকে রুপালী ওই বাক্সে!
তোমার শার্ট এর পকেট থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম
তোমার গন্ধমাখা সাদা রুমাল।
যতবার খুলি, ভুরভুর করে শুধু তুমি আর তুমি।
এত তুমি শুধু ওই রুমালটায়?
তোমাকে গোপনে লুকিয়ে রাখতে চাইলেই
তুমি চাঁদের মত উদ্ভাসিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ো।
তোমাকে বুকের গহীনে লুকিয়ে রাখার সেই মন্ত্রটা
প্রতিদিন শিখি আর প্রতিদিন ভুলে যাই।
আরে বাবা, একি গুগলের ইমেইল আইডি?
যে ভুলে গেছি বলে আবার খুঁজে পাবো অন্য কোনখানে?
আর একবার চাবি হারিয়ে গেলে
আর কি খোলা যায় গোপন সিন্দুক?
স্বপ্নচারী আমি?
সেকথা বলে বলে যত দোষ ত্রুটি দিয়ে বেড়াও না কেনো,
আমাকে অপরাধী করলে কিছু অপরাধ
তোমারো গায়ে লাগে বুঝলে দেবদাস?
আমাকে পারু বা চন্দ্রমুখী যতকিছুই বলো কিংবা নাই বলো,
অন্ধকারের দাঁড়িয়ে আমাকে যে তোমার খুব মনে পড়ে,
সেকথা আমার চেয়ে কেউ জানেনা জানো?
অন্ধকার হলেই ছাদের চিলেকোঠার ঘরে
একটা জলচৌকিতে বসে তুমি গীটারে টুংটাং বাজাও।
আর আমি অন্ধকার ছাপিয়ে বহুবার
তোমার কাছে যেতে চেয়েছি ঠিক তখনই!
কি আশ্চর্য্য জানো, থামতে হয়েছে!
আকাশ জুড়ে অন্ধকার।
অথচ তোমার ছাদের উপরে তারাদের হাট বসেছে।
আর তুমি তারাদের টুপটাপ নামিয়ে আনছো
তোমার হাতের অদ্ভুত কারুকাজ এ।
আমি মুগ্ধ হয়ে কতদিন তোমার হাঁটুর কাছে বসে থেকেছি।
তোমার গভীর মগ্নতার কাছে আমি নিঃস্ব ভিখারী যেনো এক!
আমি একদিন না দুদিন না,
অজস্র মালা গাঁথা দিন এ তোমাকে,
শুধু তোমাকে, কতবার রেখে দিয়েছি
নিজের গভীর গোপন প্রণয় এর মত চুপিসারে
নিজেরই ভিতর।
ন্যাপথোলিন এর সুঘ্রান এর মত
তুমি শুধু রুমালের ফুল আঁকা নাম তো নয়,
তুমি হলে আমার অতীত,বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
আমি তোমার চোখ এর হাসি দেখতে পাচ্ছি।
আমি তোমার হাতের মুঠোর অজস্র জোনাকী দেখতে পাচ্ছি.........
এতো রুপালী গয়নার বাক্স না যে বন্ধ করলেই সব লুকানো যাবে।
এ হলো অযুত নিযুত ভালোবাসা গো,ভালোবাসা।
অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরে যা !
এর থেকে তোমার ,আমার, কারোরই রেহাই নেই।
নেইতো!