শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

রাজশ্রী ব্যানার্জী


রাজশ্রী ব্যানার্জী

দিন যাপন
(১)
এক একটা সকাল নরম কুয়াশা মেখে ,
আহ্লাদে আরমোরা ভাঙ্গে ৷

গত রাতের স্বরলিপি লেখা থাকে বাসী শরীরে ,
ঝিলমিলের ফাঁক দিয়ে আসা কাঁচা মিঠে রোদ-
আলপনা এঁকে দেয় বিছানায় ৷
চাঁদের মৌতাতে লেখা কবিতারা ,
রাখা থাকে বালিশের নীচে ৷
আঁল ধরে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পরে ,
শালিকের দল খুঁটে খায় সকালের রূপকথা ৷


(২)

এক একটা নির্জন দুপুর তার ঘ্রাণ নিয়ে শুয়ে থাকে ,
আমার শিয়রের কাছটাতে ৷

নয়ানজুলির বাঁকে বাঁকে ডাহুকের পিপাসা ,
শ্লথ নেমে আসে নিস্তব্ধতার উদ্বায়ী মুহূর্ত ,
অগোছালো নিঃশ্বাস ভারী হয়ে বসে ৷

যে তরী উজানে দিয়েছে পারি-
তার ঘরে ফেরা বড়ই অনিশ্চিত ,
নাব্যতা মাপি ,ডুব দিই  ,সাঁতরে যাই
পার বরাবর ৷
নখ দিয়ে খুঁটে চলি জমা হওয়া স্মৃতি ,
জল দিই , সার দিই
পরিচর্যায় বাঁচিয়ে রাখি তাকে ৷৷



(৩)

এক একটা পড়ন্ত বিকেল যেন
অপরাহ্নের নীরবতাকে ঘরমুখো করে ৷

এলোমেলো মুহূর্তগুলো দিয়ে একেবনা সাজিয়ে ,
ছুঁতে চাওয়া কামরাঙা ইচ্ছেগুলোকে ৷
ফেরার শব্দ শোনার অছিলায় নিস্তব্ধ ব্যালকনি ,
কৃষ্ণচূড়ার লাল ঘিরে আদুরে শিশির সন্ধ্যা ৷

প্রতীক্ষার অবসান হলে -
অজন্তা ইলোরা আঁকা হবে উপোসী ঠোঁটে ৷৷


(৪)

এক একটা রাত যেন নিবিড় সরণি বেয়ে-
অনাড়ম্বর আমন্ত্রণ ৷

আপোশের সংশ্রবে গড়িয়ে পরে বন্ধনহীন স্রোত,
নিমগ্ন অন্ধকারে আকূত আবেগ বীজের মত ছড়িয়ে ,
বিচ্ছিন্ন পল্লবের মত খসে পড়ে আভরণ , আবরণ ,
বানভাসি তোর্সার গহীন প্রলোভনে -
শরীরী ভাঁজে আঁকা হয় রূপকথা
রমণে মুহ্যমান রাতে-
                    পরায়ত্ত ঠোঁটে এঁকে দেয় অনুচ্চারিত কাব্য ৷



            


অন্য বসন্তের গল্প

সে এক অন্য বসন্তের গল্প ,
কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা হলুদ স্বাক্ষীরা |
           বেপরোয়া বয়স-সন্ধি
                   বেহিসাবি  প্রেম |
স্বযত্নে তুলে রাখা নীল জামটা
                 আজও তোমার পুরুষালী গন্ধ মেখে |
আচ্ছন্ন বিকেলগুলোর পলাশ রঙা আবেশ
                               ছুঁয়ে যেত ওষ্ঠ ,নিতম্ব |
বসন্তের হাওয়া বড় বেয়ারা ,
         উড়িয়ে নিয়ে যেত ,উত্তাল সমুদ্রের মাঝ বরাবর |
ফেনাগুলো আমার শরীর ছুঁয়ে
                       ভেঙ্গে যেত ,ছড়িয়ে যেত |
অজান্তে তোমার ঠোঁট স্পর্শ ,
                                আমার অঙ্গ ,উপাঙ্গ ৷
ছোট ছোট পাহাড়ি ঝর্ণা ,
               কখন যেন জলপ্রপাত হয়ে উঠত ৷
সময় যেন বয়ে চলা নদী ,
            অসতিত্ব ভেসে যেত একাত্মতার স্রোতে ৷
মুহুর্তেরা জলছবি হয়ে ,
                 অপলক চেয়ে থাকত ৷
তোমার আঙ্গুল ছুঁয়ে বেজে চলত ,
                            আমার শরীর জুড়ে ইমনকল্যান ৷
চাঁদের আলোয় মিশে যেত সিডাকটিভ নেশা ,
                      জন্ম নিত ভালোবাসার অনাড়ম্বর গল্পেরা ৷


আজও সে পথ দিয়ে যেতে ,
                         চোখ চলে যায় তোমার ঝুল বারান্দায় ৷
রেলিংয়ের গায়ে তেমনি বেড়ে চলেছে মানিপ্ল্যান্ট ,
 ঘোরানো সিঁড়িটা তেমনি উঠে গেছে তোমার দোতলার ঘরে ৷
হয়ত সেই মস্ত পিয়ানোটা
                   এখনও তোমার হাতের ছোঁয়ায় আবেশ ছড়ায় ৷
শুধু আমি নেই
                     তোমার গল্পের পাতায়
                       পলাশের আবেশে
                         বাসন্তের হাওয়ায়
                          জলছবি মুহুর্তে
                                    কিংবা
                                                   ইমন কল্যাণে  ৷৷






মিথ্যা প্রয়াস

নদীটা গিলছে তারই দুই পার ,
যেমন নিয়তি গিলে খায় মানুষের ললাট ৷

সাঁকোটা দুলছে অবিষহ্য সন্দিগ্ধ নিঃশ্বাসে ,

ঝরের সাথে পাল্লা দেয় গাংচিলের শ্লথ হয়ে আসা ডানা ,

আমাদেরও সংগ্রাম প্রতিদিন , প্রতিনিয়ত , প্রতিক্ষণ ৷

কথা থাক বা না থাক ,শেষ হয় সম্পর্ক নানা অছিলায় ,

মৃত্যু কিংবা হত্যা অথবা প্রতারণায় ৷

তুমি তো চেয়েছিলে গাত্র-আবরণ হয়ে

সম্পর্ককে জড়িয়ে রাখতে ,

তবু পিলসুজ ঘিরে চিরকাল অন্ধকার ৷

নিরবলম্ব হয়ে বাঁচার প্রয়াস বারবার ,

তবে সংক্ষোভ জাগে অন্তর মহলে ,

পুনর্বার ফিরে যাই সাকোঁটার কাছে ,

হয়ত সন্নিবদ্ধ করার মিথ্যে প্রয়াসে ৷৷





অগ্নিকন্যা

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছিল মেয়েটা
মধ্যবিত্ত স্বপ্নগুলো যেমন সীমিত ,মুষ্টিবদ্ধ
একদম তেমন কার্পণ্য ছিলনা তার স্বপ্নে |
আকাশ ছিল তার সীমা
হরিণ শিশুর উচ্ছ্বলতায়
তার স্বভাব টগবগিয়ে বাঁধনহারা |
বুকের ভিতর আগুনটা জ্বলছিল ধিক ধিক করে
সেই আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তার বাবা |
সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন জয়ী |
"রূপং দেহী ,জয়ং দেহী ,জশো দেহী ,দ্বিষো জহি" |
বাবা বলতেন -
"মাথা উঁচু করে বাঁচবি মা -
নিজেকে বেচবি না ,
নিজের মধ্যে আগুন জ্বালা
সেই আগুন ছরিয়ে দে সবার মধ্যে
আর নিজে পুড়ে খাঁটি সোনা হোস |"
সে যখন অষ্টম শ্রেণীতে পরে
বাবা তখন মৃত্যু শয্যায়
একদিন শেষবারের মত 'জয়ী' বলে ডাকলেন
শেষবারের মত ওর হাতদুটো
নিজের শীর্ণ হাতে চেপে ধরলেন
শেষ বারের মত বলে উঠলেন ,
"আগুনটা জ্বালিয়ে রাখিস মা ,
          আগুনটা জ্বালিয়ে রাখিস |"

তারপর সব চুপচাপ
বাইরে বৃষ্টির শব্দ
  ঝিল্লির ডাক
মায়ের কান্নায় চেতনা ফিরেছিল জয়ীর
তবু সে কাঁদেনি ,
সেদিন থেকেই ঐ আগুন তার সঙ্গী
দারিদ্রতা নিষ্ক্রীয় হয়েছে
অসাহায়তা হেরে গেছে ,ঐ আগুনের কাছে
আগুন শুধু ধিকি ধিকি করে বেড়েছে
স্কুল ,কলেজ ,ইউনিভার্সিটি
একে একে পেরিয়েছে এক একটা আগুনের পথ
জ্বলেছে ,পুড়েছে
অবশেষে আজ সে খাঁটি সোনা
আজ সে অগ্নিকন্যা
তার আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে
আরো কত জয়ীরা
বাবার দেওয়া আগুন বুকে করে
বাঁচবে জয়ী |
জয় করবে অক্ষমতাকে
             কলুষতাকে
               সংকীর্ণতাকে |
আজও সে একান্তে শুনতে পায়
আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখিস মা
আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখিস |
আর বাবার উচ্চারিত সেই স্ত্রোত্র -
"অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানান্ঞ্জন শলাকয়া-
চক্ষুস উন্মিলিতং যেন তস্মৈই শ্রী গুরুবে নমঃ "।