সম্পাদকীয়
রত্নদীপা
দে ঘোষ
আশার শিশির আর আহ্লাদের কুয়াশা।
ঋতুর কবিসমগ্রে লেখা শুরু হল হেমন্তের অট্টালিকা। জোরকদমে চলছে গহন-কুসুম সংকলনের
কাজ। মুহূর্ত-আরতির রূপ ভারি চমৎকার। যেন দিক বসনা অরণ্যের ললনা। যেন তরুণ-রাখাল
বাঁশীটি ঠোঁটে,
হঠাৎ লিখে ফেলছে চারু বাকের কাব্য-পুস্প। যেন মেঘ-সমীপে অখণ্ড
জলধারা নদীটির পোষাঝাউ, বনাঞ্জলীর ঢেউ কুড়িয়ে নিতে নিতে বয়ে
গেছে কখন মলাটলেখার পালা...
চারদিকে টলটল করছে নতুন লেখবন্ধের
শব্দসিরিজ। গভীরে নুড়ি জড়ির নতুন কোন প্রকল্প। সেজে উঠছে স্রোতের অশ্বিনীকুমারী।
মহারূপ হ্যারিকেনের সৌন্দর্যে যে অপার রোদ তাকে ছেনেই তৈরি হতে লেগেছে দীপাবলির
অন্তরঙ্গ প্রতিমা। রূপসী-বাংলার চাইতেও মোহময় এক আশ্চর্য নূপুরপরা আলোকবর্তিকা।
অন্ধকারের বটুয়া চিরে বেরিয়ে আসছে পরাগে-মিলনে মথিত উৎসবের সূর্যমুখ।
তোরণখানি যার মণিমুক্তো আর
হীরেপান্নার। শালিকফুলের শালুক বৃতিটিও তুমুল আল্পনার।
কল্পনার বাতাস-শরীর, মননে
মাখা আলোবাসার চারদুয়ার। ঈশ্বরের নিজের হাতে বানানো সৃষ্টির আল। আমরা সাধারন
মধ্যবিত্ত পাখি। মানুষরাত্রির জানালার বাইরে তাখিয়ে থাকি দিনমান।
অপরূপ শ্যামজ মা- মুরতি। পরনে
প্রাতঃভ্রমণ। গরনে হাজার লাখো অলকানন্দার সুগন্ধি সেতুরেখা। আমাদের ডাকে ওরা।
হাতছানির পাশে ফুটে ওঠে নুতুন স্বরের গোলোকধাম। আমরা উড়তে ভুলে যাই ... আমাদের
পাখাগুলি,
দানার অক্ষরে নীহারিকার.. আমরা নিজেদের পাখিসমাজটিকে ভুলে যাই ...
ভুলে যাই আমাদের চোখের কলমদুটি
দেবালয়ের আকুতিতে গড়া। আমাদের চেতনায়
হোমের প্রজাপতি। আমাদের দোটানায় স্পষ্ট একতারা। বাউলগাছের পাপড়ি। এই ইমনে জের কাছে
পৌঁছনটাই খুব জরুরী। তাই ছড়িয়ে দিই কুশলসংবাদের নবান্ন। ঘ্রাণ ফসলের রান্নাঘর।
বোধনের যজ্ঞে জন্ম নিক জুঁই জগতের আকর্ষ। চাই, বোধনের আগে হৃদয়ের পোশাক
বদলে নিক দুঃখবেলার রাতজামা।
অজস্র ধন্যবাদের পুঁতি গাথা করি।
বজ্র নির্ভর শ্লোকগুলিকে আঁকা করি, কিছু কথাবার্তা
প্রস্ফুটিত হোক তিনমাত্রার ধ্যানে। প্রতিটি দৃশ্য রঙ থেকে রঙিন হোক, রঙ্গন হোক বেদশ্রুতির আতস। গড়ে উঠুক হাজার বছর পুরনো আতপের শিখা, আগুনের পলাশ, বকুলমৃদু বালিকা। ঝি ঝি ফোঁটার
চলচিত্রে গড়ে উঠুক চিদানন্দার সাধনমেরু।
পিঙ্গলার সাজে সাজুক নীহারিকার
ব্রজবুলি। ভায়োলিনের পটভূমিতে অরুণ কথোপকথন, দূরআকারের শুকতারার
বিবাহবার্তা এসে পৌঁছক পঙক্তির রচনায়। গদ্যের সেতার আর দৃঢ় হোক। পরবর্তী গ্রন্থের
জন্য উদগ্রীব থাকুক মরুবেলার মাধুরী। শুনতে পাই যেন অমর-চেতনার মাধুকরী।
সেও কিন্তু একটি হেমন্তপ্রভাতের
দুয়ার। শঙ্খ। ছাপা অক্ষরের শাঁখ। যদি বেজে ওঠে তাহলে বুঝি। উত্তাল জাগরণের হাল
ধরেছেন লেখকঋষি। জোয়ারে গড়া রূপালী দূরবীন। পৃষ্ঠার মালাবারে অচিনদেউলের অক্ষয়
মাল্বেরি। প্রত্যহ যা আমরা শুনি, শিশুর রামধনুতে। যা কিছু লেখা হয়
অন্তরের ব্যাল্কনিতে, যা কিছু গুছিয়ে রাখা আলাদিনের আলমারিতে,
কিছুই তার ফ্যালা যায় না। সব, সবখানি লুকোনো
থাকে আত্মার ভূগোলে, বৃষ্টিসখার খামারঘরে। এইসব সুরঙ্গমা
দৃশ্যাবলী গুছিয়ে রেখেছেন কে?
একজনই মাত্র সমুদ্র-প্রকাশক আছেন
আমাদের অন্তরে। আমরা সেই অমেয়ধারার
প্রতিধ্বনি। কেউ আমাদের শোনে। কেউ আবার দেখেও না দ্যাখার ভান করে। তবু আমাদের
চারণভুমি জুড়ে অগণিত চারুকলার বিভাসমগ্র। আমাদের সম্রাট, আমাদের
লেখা সকল রাজাধিরাজের মর্মকথা। চেতনার পান্নায় গঠিত খানা ক্যানভাস। একভাগ যার
সোনার দিগন্তফ্রেম। অন্যদূরটি কাছের অমলতাস।
অনুভব করি জ্যামিতির পিক্সেল। মেগাওয়াটের
বিদ্যুতে কেঁপে ওঠে প্রাকৃতিক রুটম্যাপ। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনে, পৌঁছব
কোথায়? কোথায় সেই মুক্তাঞ্চল, কার
সিঁথির আঁচল, বুকের কিচিরমিচির ... আমরা বুঝে উঠতে পারি না
...
তারপর, খুব
দোলনার পরে, অমোঘ দর্পণে জ্বলে ওঠে সাত তিমিরের
অন্তরজ্যোতি। নিভে যায় অন্ধকারের রোঁয়া।
আলোকজিষ্ণুর কোয়ায় বেজে ওঠে গানাঞ্চলের সদ্য দ্রাঘিমা। ঘুম থাকে না চোখে। হরিণ
বদলের আনন্দে সমস্ত নীরবতাগুলি কানকো উঁচিয়ে ছোটে ঘোড়া-রথের দিকে। অইদিকে তখন কী
প্রচণ্ড চন্দ্রমা, কী দারুন অভিষেকের দীপ্তি। আমাদের আর ঘুম
আসে না। আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরি, যেমন জ্বরে একজন দেবতা
জড়িয়ে ধরেন একজন দেবিপক্ষকে, দান করেন চুম্বনের প্রদীপ।
হিল্লোল হাল্কা হলে, সাত
আর সতেরটি পূর্ণিমা জড়ো হয় জড়োয়া আধারে। গতিচিহ্ন বদলে যায় আহ্নিক-পাথরের। আকাশের
দরজা খুলে যায়। শুরু হয় উতল ডায়েরীর পবন। এই ঋতু অলঙ্কারের গহনা। এই গহনা অতলান্ত
প্রাচীন যার রেফসংগীত আমাদের প্রিয় ঝর্ণার পরিক্রমা।
আকাশলম্ফের বাতিতে জন্ম নিচ্ছে
বিরলরঙের তীর্থ। আমরা আমাদের মেধা দিয়ে কিছুতেই মাপ্তে পারছি না ত্রিলোকের
ভাষাভঙ্গীবদল। চিকুর জুড়ে গ্রামোফোনের আয়না...
এমন আশ্চর্য তার ঠুমরীঘর, উচ্চাঙ্গগানের
গেহ, পদাবলীতে ডুব। স্নান নিই গভীর আলাপনে। স্নান করি
তুরপুনের পল্লীগীতি। আমরা ভেসে উঠি চমৎকার এক উপপাদ্যের পরিমিতিতে। জাগতিক এবং
পরাজাগতিক কুন্দন-বর্ণন আমাদের বপনে রোপণ করে নবতর এক তারাজগত। প্রাচীনতম তপোবনের
সমৃদ্ধি বার্তা নিয়ে আসে সুপবনের। মৌ আর মৌচাকের দূরত্ব যায় মুছে। জোনাকির চুড়ায়
নাচে কাঁসাক্ষত, বর্ষণযোগ্য মর্মরবীথি। স্বপ্নে দ্যাখা
পাহাড়ি মেয়েরা, পাহাড়ের গায়ে মাথায় চাষ করে নিভৃতঝুমের
রেকাবি...
আমাদের মগজে টুকরো টুকরো মহাকাশ, কাশফুলের
কেয়ারি করা মহাদীপালোক। উল্লাসের জানায় ভর দিয়ে দেখি, স্থির
চরণে দাঁড়িয়ে আছেন মহানৃত্য এক। কপালে ত্রিশূলের তরবারি। বাঁদিকের আলাপচারিতায়
সুমঙ্গল ওড়নারঙ। ডানতিথিতে তোড়িবৃক্ষের অনুরণন। আনন্দের স্নায়ুঘোর টপকে বেরিয়ে আসে
কবিতার তিন ফোঁড়। যেন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃত এক সেলাইকল। ইতি আর নেতির
দ্বন্দ্ব ঘোচানো কবিতার কথকতা। আমরা মেতে উঠি উৎসবে, দোরগোড়ায়
বেজে ওঠে কবিতার আঁতুড় ...
নাগরিক রোদ্দুরের পথে ঘাটে
ফুলঝুরির ম ম ঘন্ধ। উচাটনের কলম। তৈলচিত্র ঘিরে ফর্সা-কালো শব্দের বন্ধুতা। কবিতায়
নৌকোসাধা,
কবিতার দাঁড় টানা। অপত্যগুলি নিসর্গের ধূপছায়া। চত্ত্বরে সোচ্চার হয়
কবির আত্মজীবনী, ব্যর্থতার জৌলুস ফুটে ওঠে আবডালের আড়ালে...
কবি ক্ষণিকের। কবিতা তো চিরদীপকের।
কবি পথহারা বৃষ্টিমুখো মেঘলা সমান্তরাল। কবিতা বহতা উন্মাদনা, কালের
নিসর্গ-কান্তার। কবির আওয়াজ ক্রমে ফিকে হোয়ে যায়। কবিতার নেপথ্যে অচেনা
হারমোনিয়ামও দিনে দিনে প্রবল হয়। কবি ঋতুনির্ভর এক ক্যামেরাওয়ালা। কবিতা ক্যামেরার
আলগোছে চূড়ান্ত অভ্রবাতিদান, তুমুল মোমবাতিওয়ালা।
কবি মাইক মঞ্চ পুরষ্কার। কবিতা
পাহাড় আকাশ সমুদ্র।
কবি কৌরব পাণ্ডব কুরুক্ষেত্র।
কবিতা শাস প্রশ্বাস অবগাহন।
কবি মোহনার গা ঘেঁষে চূর্ণজল, কবিতা
চরকায় ঘুরতে থাকা ভ্রমরের আলিঙ্গন।
কবি জাহাজের চাইতেও বড় রম্যরচনা।
কবিতা বোহেমিয়ান আবহাওয়ার দোলন।
কবি খোদ গ্রীষ্মকুমার, কবিতা
অবিরল শান্তিপ্রিয় বর্ষাপিয়ানো।
আসুন, এই
দীপাবলির রত্নপ্রভাতে কবি-কবিতার উৎসবে যোগ দিই। কবিতার গায়ে মাথায় আছড়ে পড়ি এমন
সুরে, যেন কবিতাই শ্রেষ্ঠ গান, বিদ্যুৎ-বিপন্ন
মৃত্যু,
কবিতা মেঘাময় গুপ্তযন্ত্রণা, সনাতনে
মিশে যাওয়া মহর্ষি ধ্রুবতারা... কবিতাই একমাত্র গণিতশুদ্ধ হাহাকার, মহাতারার কণ্ঠস্বরে বর্ণীত লালনের বাদ্যযন্ত্র।
আসুন, কবিতাকে
এমনভাবে বুকে রাখি, যেন সে-ই আমাদের সন্তানসম
পুস্পপত্র-দেবাঞ্জলী।