কবিতাউৎসব
সাক্ষাৎকার ১৪২৫
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই
থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি।
আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই
আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা
বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে
ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
দেবযানী বসু: বাংলাসাহিত্য নিয়ে
পড়াশোনা করার ফলে চিরকাল মনে সাহিত্য অনুরাগ ছিল। খুব সাধারণ গৃহবধূর জীবন আমার। অসম্ভব অন্তর্মুখী। নতুন ফ্ল্যাটে
এসে ঐ দুর্গাপুজো উৎসব নিয়েই আবাসনের পত্রিকায় লেখালেখি থেকে কবিতা লেখার সুপ্ত
ইচ্ছা জাগে। একটুবেশি বয়সে কবিতা লিখতে এসেছি। এবং নিভৃতে কবিতা চর্চা করার পর
একেবারে বই হিসেবে কৃত্তিবাস থেকে প্রকাশিত হয় - দেবযানীর স্বীকারোক্তি (২০০৬)।
পরবর্তীকালে অবশ্য কবি ও কবিতার উৎসবে জড়িয়ে পড়ি। জানি বাংলার জনজীবনে কবিতার
প্রভাব দিগন্তবিস্তৃত। লিটল ম্যাগাজিনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় এর
নব্বই শতাংশ পত্রিকায় কবিতা কোনো না কোনো ভাবে আছে। অবশ্যই বাংলায় জন্মেছি বলে
এখানকার জলমাটি ও পঞ্চভূতে মিশে থাকা কবিতার জমি, ও তার লালন-পালন পেয়েছি। ঢাকা বা কোলকাতার জনগণ ব্যবসাবাণিজ্য
নিয়ে যতোটা না আদান-প্রদান করেন কবিতা সাহিত্য শিল্প অভিনয় খেলা ইত্যাদি
সাংস্কৃতিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান করেন বেশি। বিশেষত কবি সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর ব্যাপ্তি এপার বাংলা ওপার বাংলা জুড়ে
অবশ্যই মনের দরজা খুলে দেয়। মহাদিগন্ত পত্রিকার কবি উত্তম দাশ চিরকালই দেবে আর
নেবে মিলাবে মিলিবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। বইমেলা আরেকটি প্রেরণা পাবার স্থান।
এখন তো জেলায় জেলায় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সভায় কবিতাপাঠ করা থেকেও শক্তি
আহরণ করা যায়। কবিতা নিয়ে নানা কল্লোলিত উৎসব থেকে কলেজ স্ট্রিট ও যাদবপুরের
কফিহাউস থেকে উদ্দীপনা ও শিক্ষা গ্ৰহণ করেছি। এতদসত্ত্বেও এই জনসংযোগের ভিতর আমার
একটা মিনিম্যালজম অবস্থান আছে। এও জানি কবি কখনো থাকেন সমষ্টিতে কখনো থাকেন
ব্যষ্টিতে। আন্তর্জালে কবিতাউৎসব পত্রিকার রয়েছে জনসংযোগ করার প্রভূত ক্ষমতা। রাত্রির
ভিডিও কনফারেন্সে কবিতা পড়া ও আলোচনার বিষয়গুলো বিশাল উৎসাহ সঞ্চার করে।
পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের অনেক কবি এতে অংশ গ্ৰহণ করেন। আমিও কবি অনিন্দ্য , রত্মদীপা, রাহুল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবাশিস এদেরকে পেয়ে
আনন্দিত হলাম হই। পত্রিকায় কোনো না কোনো কবিকে মর্যাদা দেওয়া হয়।এটা অত্যন্ত
কার্যকর ব্যবস্থা। কবিতাউৎসব পত্রিকার এই কর্মকান্ড
চিরদিন এরকম থাকুক এটাই আশা করব।
কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা
সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব
আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে
মনে হয় আপনার।
দেবযানী বসু: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে এ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে
আমার একশো আশি ডিগ্ৰি পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবং হয়তো আরো পরিবর্তন হবে। কৃত্তিবাস
থেকে দেবযানীর স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হবার পর সহযাত্রী ও প্রতিভাস থেকে চটি বই
প্রকাশিত হয়। আমি এ পর্যন্ত ধারাবাহিক কবিতানুসারী ছিলাম। একান্তর, পোয়েট্রি রিভিউ, কবিতা পাক্ষিক, সুইনহো স্ট্রিট , ইসক্রা ইত্যাদি নানা
পত্রিকায় লিখছিলাম। ক্রমশ ভিন্নমুখ ও কবিতা ক্যাম্পাস কবি সম্মেলনে কবিতা লেখা
শুরু করি। আশির দশকের ব্যতিক্রমী কবিদের প্রভাবে কবিতাশৈলী পাল্টে গেল। 'নতুন কবিতা'ধর্মী কবিতা লিখতে শুরু করি। একই সঙ্গে পোস্ট মডার্ন কবি
মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীর ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় হয়। এবং অলোক
বিশ্বাসের কবিতা ক্যাম্পাস থেকে আইভরি খাতা , নোনামিঠে জলচিহ্ন, রেডিও অ্যাকটিভ মিনারেল বৃষ্টি নামে ৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ছোটো কবিতা বা
অনুকবিতা নিয়ে সঞ্জয় ঋষির সুতরাং প্রকাশনা থেকে চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা নাম
নিয়ে একটি বই তৈরি হল। এই সব মিলিয়ে আমি শূন্য দশকের কবি হয়ে আছি। আপনার কবিতাউৎসব
পত্রিকায় যা কবিতা লিখেছি তা ঐ ইউ - টার্ন নেওয়া কবিতা। তবে আরো একটু পরিবর্তিত আগের থেকে।
কবিতায় নতুন শব্দ তৈরি করা ও বিশৃঙ্খল অলংকার উপমা ব্যবহার করতে ভালো লাগে।
ডিসটর্টেড দৃশ্য রচনা করতে ভালো লাগে। এবং আদি ও বর্তমান পর্যন্ত হিন্দি ইংরেজি
বাংলা নানা ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার করা আমার ভালো লাগে। কবিতাউৎসব পত্রিকা আমার
কবিতা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে দেখে একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ এখানে যারা
লেখেন তাদের সিংহভাগের সঙ্গে আমার কবিতা মেলে না। যেভাবে লিখে আমি আনন্দ পাই সেই
আনন্দের সঙ্গী কেউ হয়েছেন দেখলে আরো নিষ্ঠা আসে কাজে।
দ্বিতীয়ত হুজুগসর্বস্ব ও
সাধনা সাপেক্ষ বলে ভিন্নতা সৃষ্টি করলেও হুজুগের কারণ ব্যতিরেকেও অনেকে নানা
প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে লেখা ছাড়তে বাধ্য হন। আবার সময় সুযোগ পেলে কেউ লেখালেখি
শুরু করেন। তবে শুধু হুজুগ দিয়ে কোনো সৃষ্টি বেশি দিন টানা যায় না। আবার হুজুগ
না থাকলে লেখার প্রেরণা পাওয়া যায় না। তবে কয়েক বছর পত্রিকা চালানোর পর বা
কবিতা লেখার পর কোনো মন কষাকষি থেকে সব বন্ধ করে দিলেন কেউ আর ফিরলেন না। আঙুর ফল
টক বলে একেবারেই সাহিত্য ত্যাগ করলেন সেটাকে হুজুগ বলা যেতে পারে। আর নিজের লেখাপড়া শিকেয়
তুলে খালি মেলায় ঘুরে বেড়ালে সঠিক কবি
হওয়া যাবে কি? সাধনা তো অবশ্যই দরকার।
এমনিতেই বারীন ঘোষালের মতে নব্বই শতাংশ কবি পার্ট টাইমার। সংসার অফিস পুরোপুরি
সামলিয়ে তবে কবিতা লেখা। আবার সাহিত্য করতে অর্থ না থাকলে আরো অনর্থ জন্মায়।
নানা রকম পত্রিকার হুজুগে পড়ে অনেকেই নিজের লেখার উন্নয়ন করেন। কবিতাকে ভালোবেসে
কবিতা লেখা সারস্বত সাধনা যাদের রক্তে মুক্ত তারা হতে আর পারেন না। সবই নিজের
কবিমনটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। নানা কিসিমের বই পড়া আরো ভালো। অনেকে বহুমুখী
প্রতিভা নিয়ে এসেছেন। তো তারা সেগুলোর চর্চা করেন। পন্ডিত তো অনেকেই হন। সাহিত্য
ইতিহাস সমাজ সম্পর্কে অঢেল জ্ঞান কিন্তু কবিতা এককলম লিখতে পারেন না। কবিতা লেখার
চর্চা খুব মনোযোগ দাবি করে। সাধনা বা লেখাপড়া করাটা ও কবি সমাজে মেলামেশা সবকিছুর
মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। অংকে ভালো না হতে পারা বা কবিতা ভালো
না লিখতে পারা ইত্যাদির জন্য আফশোস অন্যক্ষেত্রে
উজ্জ্বল অনেক নক্ষত্রসমান
ব্যক্তিদের মধ্যেও রয়ে যায়। জীবনের নিয়ম কোনো ধরা বাঁধা পথে চলে না। এতো
কিছু বলার পরেও সাধনা ও পান্ডিত্য একজন কবির কাছে আশা করা কোনো অমূলক ব্যাপার নয়।
কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত
জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক বিকাশ, কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা
করেন এই বিষয়ে।
দেবযানী বসু: আবেগ একধরনের শারীরবৃত্তীয়
প্রক্রিয়া। সাধারণত উত্তেজনা সহকারে গদগদ ভাষায় প্রকাশিত হয়। কবিতায় আবেগকে
নিয়ন্ত্রণ করতে রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসোয়ার্থ বলেছেন কবেই -- ইমোশন রিকালেক্টেড
ইনটু ট্রাঙ্কুইলিটি। কাঁচা লেখায় সাধারণত আবেগের প্রসার থাকে। অবশ্য এখনকার তরুণ
দীক্ষিত শিক্ষিত যারা কবিতা লিখতে আসছেন। সুন্দর ও আপ টু ডেট কবিতা লিখছেন।
স্মার্ট কবিতা বলে তাকে উপহাস করাও ভালো কাজ নয়। আবেগ যাদের আছে বা বেশি তাদের কি
অভিজ্ঞতা নেই জীবন সম্পর্কে? আছে কিন্তু তার নান্দনিক
প্রকাশ করতে গেলে ভাষা ও শব্দের উপর জোর দখলদারি থাকা চাই। তার জন্য শব্দ নিয়ে
ঘষামাজা করতে হবে। যে উৎস ঘটনা আবেগ পরিস্থিতি মনে প্রেরণা জোগাল তার শব্দরূপ
প্রাথমিকভাবে খাতায় লিখে ফেললাম আর সেটা কবিতা হয়ে গেল উচ্চদরের এ হতে পারে না।
সেই উৎসটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে কাটাকাটি করে যে কবিতা শেষপর্যন্ত জন্ম নিচ্ছে
তারা জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ পরমান্নের উপযুক্ত। এনট্রপি।
রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন : poetry is when an
emotion has found its thought and the thought has found words. তবে প্রাঞ্জল এই বোধ নিয়ে শতাব্দী পেরিয়ে কবিরা
সন্তুষ্ট হতে পারছে না। আবেগ থেকে কবির ব্যক্তিত্ব বোঝা যায় , কবিতাটি লেখার পটভূমিকা এবং কবিতাটি লেখার উদ্দেশ্য
বোঝা যায়। সাধারণত গল্প বলা কবিতায় ক্লাইম্যাক্সের দরকার হয়। কারণ আধুনিক
কবিতায় একটা বৃত্ত পূর্ণ করতে হয়। কবির দ্বন্দ্ব ও দুশ্চিন্তাকে এই
ক্লাইম্যাক্সই ফুটিয়ে তুলবে। এবং পাঠক যেহেতু কবির আধেয় তাই পাঠকেরও সমানুভব
হয়। তবে তীব্র আবেগসম্পন্ন কবিরা কবিতায় আবেগাপ্লুত শব্দ কতোটা প্রয়োগ করবেন এ
সম্পর্কে আমেরিকার slam poet জ্যাক ম্যাকার্থি বলেছেন
আবেগকে এবং ক্লাইম্যাক্সকে কবিতায় সঠিক প্রয়োগ করতে গেলে অনির্দেশ্যতা ও
মেটাফরের দরকার। আর আবেগাপ্লুত প্রথম খসড়াটা কবিতা নয়। কিছু কিছু শব্দ ও দৃশ্য
যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তাদের তুলে নিয়ে অন্যত্র লিখতে হবে।
অন্যদিকে অভিজ্ঞতা
জীবনতাড়িত নানা অনুভুতির ও উপলব্ধির মাধ্যমে সঞ্চিত থাকে মনে কবিতায় যা লেখার
সময়ে ধীর শান্তভাবে রূপ দিতে হয়। কবিতা তো সূক্ষ্ম শিল্প। মোটাদাগের অভিজ্ঞতার
কথা বললেই তার স্বাস্থ্যসম্মত কবিতা হবে না বরঞ্চ তার ভরযুক্ত কবিতা হয়ে যাবে।
কোনো এক প্রাবন্ধিকের ভাষা তুলে ধরি -- ' Today colourful mixer
of forms from all periods and peoples is breaking in upon us and seems to undo
every delimitation of literary genres and every rules.' অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম ও নাটশেল
অবস্থাটাকে '
the pure elevation of ideal beauty (or ugliness) above common reality' - এর পর্যায়ে তুলে ধরা কবির
লক্ষ্য।
তাহলে দাঁড়ালো এই যে আবেগ
একটি প্রাথমিক স্তর কবিতা লেখার জন্য। আর জীবনের সব অভিজ্ঞতা আমরা কবিতায় লিখে
ফেলতে পারি না। কবিতার চাইতে জীবন অনেক বড়ো। সবসময়ই তার মহাজীবন। ঘা খেতে খেতে
অভিজ্ঞতাযুক্ত মন ব্যঙ্গাত্মক হয়ে পড়ে। সেখানে কাজ করবে স্রষ্টার স্বাধীনতা।
কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন। একবিংশ
শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা।
দেবযানী বসু: ধর্মীয় কাব্যসাহিত্যে শ্রীমদ্ভাগবতে রাসলীলা ব্রজলীলা, কবি কালিদাসের কুমাসম্ভব, জয়দেবের গীতগোবিন্দম, বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যর ঐতিহ্য বহন করে
বাংলাকাব্যের জয়যাত্রা। এর বহু অংশ পাহাড়ি পাকদন্ডীর বিপজ্জনক হেয়ার পিন
ইউটার্ন বলে দাঁড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভিক্টোরিয়ান যুগের কিছু প্রভাব
বাংলাসাহিত্যে এসে পড়াতে গোপনীয়তা রাজত্ব করতে শুরু করেছিল। সত্তর দশকের কবি
অমিতাভ মৈত্রের কথায় 'সাহিত্যে অশ্লীলতা নিয়ে
বিগত এক দেড়শো বছর প্রচুর কোলাহলের পর এখন সব শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে। ... যে সব
মুখরোচক কাগজ (বটতলার সাহিত্য) বা পত্রিকায় সাহিত্যের অশ্লীলতা নিয়ে লেখাপত্র
থাকত , এখন তারা কোথাও নেই।' তাঁর মতে ইন্টারনেট এর জন্য দায়ী। এখন পর্ন্ দৃশ্য
হাতের মুঠোয়। ইউটিউব এর বিজ্ঞাপন লাগাম ছাড়া। তথ্যে আদর করে স্থান পেয়েছে
বিখ্যাত নারী মাংসের বাজারগুলো। আমাদের হাতে এখন গ্ৰে সাহেবের ছাপ্পান্ন দুগুনে
হাজার শেডস্। হলিউডীয় যৌনতা ও চিত্রকরদের ন্যুড সিরিজ দেখতে অভ্যস্ত আমরা।
Obscenity laws are concerned with
prohibiting lewd, or disgusting words
or pictures... A comprehensive , legal definition of obscenity has been difficult to establish.-- এটাই আইনের কথা। নবোকভের
লোলিটা আজ পান্তাভাত মনে হয়। তবু শোভা দে একজন বিতর্কিত লেখিকা। খাজুরাহো , কোনার্ক মন্দিরে যা আছে বাংলা কবিতায় কি তা আছে দশ
শতাংশ ? আসলে যৌনতার রূপ রঙ রস সব
পাল্টে গেছে। বাঙালি ঘরোয়া প্রেম চায় যতোটা ততোটা যৌনতা চায় না। ভারতচন্দ্রের
বিদ্যাসুন্দর একসময় বিপজ্জনক কাব্য হিসেবে বিবেচিত হতে।
খুব বেশি অপশব্দ ব্যবহার
করলেও তা নান্দনিক অশ্লীলতা আনতে পারে না। 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কাব্যের জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পোরা
হয়েছিল। তিনি অশ্লীলতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।যুগের সমাজের পরিবর্তনের
সঙ্গে সঙ্গে সেই কাব্যের অশ্লীলতা এখন আর অশ্লীল নেই। প্রকট যৌনতায় কবিতার
রহস্যময়তা মার খায়। রহস্যময়তা বজায় রাখার দাবি মিটিয়ে অশ্লীলতা আনা খুব সহজ
কাজ নয়। ষাটের দশকের ঔপন্যাসিক সুবিমল মিশ্র, কবি অরুণেশ ঘোষ, আশির দশকের ঔপন্যাসিক অজিত রায়ের
লেখায় রগরগে যৌনতা যাকে আমরা সাধারণত অশ্লীল বলে থাকি তা প্রচুর আছে। তাতে
মাখোমাখো পচা ঘিয়ের গন্ধ নেই।তা গব্যঘৃত। আজ বিবর উপন্যাস আর অশ্লীল নয়। তবে
বাংলাকবিতায় স্বাগতা দাশগুপ্তর নাম উল্লেখ করা যায়। তার কামশাস্ত্রমূলক কবিতার
বইয়ের নাম ' কুক্কুরী ও তাহার প্রেমিক'। কবি রত্মদীপা দে ঘোষের কবিতায় যৌনতার ব্যবহার আছে। কবি
অনুপম মুখোপাধ্যায়ের পর্ণমোচী উপন্যাসে তীব্র যৌনতার ব্যবহার আছে। অশ্লীলতায়
নান্দনিকতা না থাকলে সেরা সৃষ্টি হিসেবে
গ্ৰহণ করা কষ্টকর। অতএব আশা করব পরিমিত অপশব্দের ব্যবহার দ্বারা সৌন্দর্যময়
অশ্লীল সাহিত্য তৈরি হোক। সুস্থ ও স্বাস্থ্যময় যৌনতা চাই। অশ্লীলতার দৃষ্টিকোণ তার গুরুত্ব হারিয়েছে। আকর্ষণ কিন্তু
বজায় আছে।
কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য
আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য
সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে।
দেবযানী বসু: ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা পেরিয়ে
বাংলা কবিতার যাত্রা এখনও অশেষ। রবীন্দ্রনাথ , নজরুল ও জীবনানন্দকে বাংলার রেনেসাঁ যুগের কবি বলা যেতে
পারে। ইউরোপের চৈতন্যালোকে ঘরের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও
জীবনানন্দ বেশি। নজরুলের গান ও কবিতা বাংলার জলহাওয়ামিশ্রিত একান্ত বুকের ধন্য।
যুগে যুগে বাংলা কবিতার খোলনলচে পাল্টে যাচ্ছে সময়ের এক এক যুগেরও এক একরকম
ইডিওসিনক্রাসি আছে। কবি তার সাক্ষী,
সাক্ষ্য রেখে যান
কবিতায়।
পুরোনো কবিদের কবিতায় আমরা
মরচে পড়তে দিই না।তার রিমেক চলছে। রেহেল ব্লগের নাম এ বিষয়ে করা যেতে পারে।
প্রত্যেক দশকেই কিছু ব্যতিক্রমী ও প্রধান কবি থাকেন। আবার অনেক প্রকার আন্দোলন
আছে। সেই সব আন্দোলনের ভালোমন্দের ভার সব এখনকার কবিদের বহন করতে হচ্ছে। পঞ্চাশের
দশকের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষ দেশের ও দশের কথা নিয়ে কবিতায় মন্দাকিনী
তৈরি করেছিলেন। বিনয় মজুমদার ব্যতিক্রমী ছিলেন।ষাটের দশকে হাংরিজম ও পোস্ট
মডার্নিজম কলোনিয়াল সাহিত্য কাব্যের গায়ে লাগা এক পর্দা চামড়া চেঁচে তুলে
দিয়েছে। মলয় রায়চৌধুরী সমীর রায়চৌধুরী, রবীন্দু গুহ , পুষ্কর দাশগুপ্ত তাদের অন্যরকম নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। সত্তরের গর্জন থেকে প্রভূত রাজনীতি ও প্রতিবাদীমূলক কাব্যসাহিত্যের গাত্রে আরেকবার নিড়ানি
লাগিয়েছে। যদিও কবিতাকে সহজভাবে বলার প্রবণতা এ সময়েও ছিল। আবৃত্তিযোগ্য সুললিত কথোপকথনযুক্ত, ছন্দোমথিত কবিতার প্রাধান্য ছিল। ধারাচলন কবিতার যা
বৈশিষ্ট্য আর কি।বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত , অমিতাভ মৈত্র, মৃদুল ও দাশগুপ্ত,বারীনরা পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। দশক আশির কবিরা অনেকে
পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক কবিতা লেখা শুরু করেন। 'নতুন কবিতা'
বা 'ভাষাবদলের ' কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতার আঙ্গিকে ব্যাপক পরিবর্তন এনে
এবং গোলোকধাঁধা জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে এক অসাধারণ বিনির্মাণে নিয়োজিত করেছেন
নিজেদেরকে। কবিতার সাধারণ পাঠকেরা আজো তার নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন ও অভিযোগ
করছেন।
সত্তরের দশকে স্বদেশ সেন
অবশ্যই এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
উত্তরাধুনিক
কালখন্ডের চেতনা বলে পূর্ব অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে হবে। অতএব অধুনান্তিক, উত্তরাধুনিক, অতিচেতনা বা যাবতীয় ভাষা বদলের নতুন তথাকথিত অপর কবিতার
উদ্দেশ্য হলো 'নবাঞ্চল' তৈরি করা বা আলাদা হয়ে ওঠার একটা প্রয়াস।এ
প্রসঙ্গে জহর সেন মজুমদার, প্রণব পাল, ধীমান চক্রবর্তী, শুভঙ্কর দাস ,স্বপন রায় , অলোক বিশ্বাস প্রমুখ কবিদের
নাম করা যায়। নব্বইয়ের কবিরা টেকনোলজি ও অর্থনীতির খোলাবাজার সঙ্গে করে
দুর্দান্ত সব কবিতা লিখেছেন। সুবীর সরকার, জপমালা ঘোষরায় , ইন্দ্রনীল বিশ্বাস, সোনালী বেগম, প্রদীপ চক্রবর্তী, রুদ্র কিংশুক, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়, অনিন্দ্য রায়, রিমি দে, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় রক্ষণশীলতার বাইরে থেকে কবিতা লিখেছেন। নব্বই শূন্য দশক
ও প্রথম দশকের অন্যপন্থার কবিরা সাংস্কৃতিক ও কাব্যিক যৌগিকতায় বিশ্বাস করেন।
বেশীরভাগ কবির সাইবারলালিত জীবন।
তো বাকি রয়েছে ২০০০ সাল
থেকে শুরু করা কবিতা। এ সময়ে পশ্চিমবঙ্গ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলা কবিতার
একটি বিরাট অংশ এ সময়ে জনদরদী প্রতিবাদী কবিতায় আক্রান্ত হয়েছিল। যার দগদগে
প্রভাবে আলাদা আলাদা করে লিটলম্যাগ মেলা অনুষ্ঠিত হল কোলকাতায়। শূন্য দশক আলাদা
করে কিছু করে নি শুধু নতুন কবিতা আর আশির দশককে অনুসরণ করেছে এটা একটু অতিরিক্ত
বলা হবে। শূন্য দশক ইনফিউশনকে প্রশ্রয় দিয়েছে বেশি। একঝাঁক মেয়েকবির আগমন
ঘটেছে। কবিতায় সিনেমাটিক প্রয়োগকৌশল নতুনমাত্রা এনেছে। গোদার, ঋত্বিক ঘটক, ফেলিনি, থিও অ্যাঞ্জেলো পুলুস, ইঙ্গমার বার্গম্যান প্রমুখ ছবি পরিচালকদের প্রভাব
অনেক কবির উপর আছে। এ ছাড়া পিকাসো তথা যাবতীয় বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের ভাবধারাও
অনুসরণ করেছেন অনেকে। সঞ্জয় ঋষির অনুকবিতা চর্চা, সৌমিত্র রায়ের ই- পোয়েম , অনুপম মুখোপাধ্যায়ের পুনরাধুনিক প্রকল্প ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। কবিতায়ও ডিজিটাল দামামা শূন্য দশকের কবিরাই এনেছেন। শূন্য
দশকের সঙ্ঘ আছে বটে আবার নেইও বটে। সব্যসাচী হাজরা, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সেলিম মন্ডল, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলাব্জ চক্রবর্তী, অরিত্র সান্যাল, রোহন কুদ্দুস, সঙ্ঘমিত্রা সান্যাল, সঙ্গীত মিত্র, ইন্দ্রনীল ঘোষ, ঋপণ আর্য, শমীক সন্নিগ্ৰাহী, অমিতাভ প্রহরাজ প্রমুখ অনেক মেধাবী কবির নাম করা
যায়।তাহলে শূন্য দশকের কবিতাকে পূর্বপরিচিত অর্থে কোনো কবিতার বিকল্পধারার কবিতা
হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো মানে হয় না। এই কবিদের কবিতার যে কোনো আঘাতই কাব্যিক।
চেতনায় উজ্জীবিত নান্দনিকতায় ঋদ্ধ শূন্য দশকের কবিতা। কবিতায় নেতি নেতি করে অন্বেষণটাই জারি রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান অপ্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি ব্যাপার আছে।
এখন দ্বন্দ্ব এসেছে আন্তর্জাল না ছাপার পত্রপত্রিকা কোনটা বেশি দরকার কোনটা বেশি
সম্মানজনক। আছে তৃতীয় লিঙ্গদের নিয়ে অধিকার আন্দোলন। জীবন আরো খুল্লাম খুল্লা।
কবিতার ভাষাও। একদল অপশব্দের অভিধান তৈরিতে ব্যস্ত। বলছেন সভ্য অসভ্য দু দিকই খুলে দেওয়া হোক লেখায়। এখন
হোয়্যাটসঅ্যাপসেও কবিতার গ্ৰুপাগ্ৰুপি
দলাদলি।
শূন্য দশকের পরে প্রথম দশকের
অর্থাৎ ২০১০ এর পরবর্তী কবিরা খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠানের অপেক্ষায় না থেকে লিটল
ম্যাগাজিনেই কবিতা চর্চা করছেন। কেউ এক প্যাকেট প্রেম লিখছেন তো কারো কাছে
ভালোবাসার শর্ট বেকহ্যামের ফ্রি কিক হয়ে যাচ্ছে । কেউ আবার কারো চাহিদার ওভার
ল্যাপিং স্টক গুনে নিতে ব্যস্ত। প্রতিষ্ঠানের আছে ব্যাপক উদাসীনতা। অর্থহীনতা,
অনির্দিষ্টতা, অসংলগ্নতার প্রচুর প্রয়োগে বুদ্ধিজীবীরা
প্রাবন্ধিকরা অনেকে বিরক্ত ও দিশাহীন। এ ছাড়া সামগ্ৰিকভাবে কবিরা যেমন ধামাধরা
স্বার্থান্বেষী ছিলেন তেমনি আছেন।এর মধ্যে কেউ কেউ চেষ্টা করছেন আবেগের কতো কেলভিন
আগুনে শব্দকে মোল্ড করে মধ্যবিত্ত ও মধ্যচিত্ত জনসাধারণের বোধের উপযুক্ত করা যায়
তাই নিয়ে। সুতরাং মণীষার পার্থক্যে ও নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদে একদল কবি
চিরকালই ব্রাত্য হয়ে থাকছেন।
কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য
সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?
দেবযানী বসু: সমালোচক ও প্রাবন্ধিকরা
সৃষ্টি ও স্রষ্টার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আবার তারা নিজেরাই স্রষ্টা কখনো
কখনো। বিদেশে অবশ্য একাডেমিক তাত্ত্বিকদের মর্যাদা বেশি। এদেশে যিনি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কর্মরত তাদের লেখাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী পত্রিকাগুলো প্রাবন্ধিকদের প্রভাবিত করেন। প্রাবন্ধিকরা
স্বেচ্ছায় অনেক প্রতিভাবান কবিদেরকে 'কাব্যে উপেক্ষিত অথবা উপেক্ষিতা ' করে রাখেন। আবার এই কবিরাই পরবর্তী কালে চেয়ারের ভোলবদলের সঙ্গে সঙ্গে কোনো
কবি-প্রাবন্ধিক, প্রাবন্ধিক, গবেষকের চোখে পড়ে মণিরত্মস্বরূপ প্রতিভাত হন।
সর্বাধিক বৃত্ত ও বিত্ত সম্পন্ন পত্রিকায় এক লাইন নিজের সম্পর্কে উল্লেখ দেখতে
কবিরা মুখিয়ে থাকেন।মনে হয় কবিখ্যাতির বৈতরণী পার করার মাঝিস্বরূপ
হলেন এইসব প্রাবন্ধিকরা। কবিদেরকেও প্রচুর পরিমাণে গদ্য লিখতে হয় কবিতা নিয়ে
আলোচনা তর্কাতর্কির জন্য। কবিতা লেখে একদল। আরেকদল সেটা বোঝে আর সমালোচনা করে। কবি
জীবনানন্দের সমারূঢ় কবিতাটি মনে পড়ছে। সমালোচকরা কবিকে যখন বুঝতে পারেন না তখনই
অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কবিতা সমালোচনা করার জন্য একাধারে রসিক ও গভীর জ্ঞানের
অধিকারী হতে হয়। নবাগত কবিরা অগ্ৰজ প্রাবন্ধিক কবিদের থেকে সামান্য প্রসাদ পেলে
নিজেকে তৈরি করে নিতে পারেন। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাবন্ধিকরা একসময়ে বড়ো স্কেলের
আওতায় চলে যান। এবং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য এসে পড়ে। বর্তমানে
প্রাবন্ধিকদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে। একই কবিতা নিয়ে বিভিন্ন
প্রাবন্ধিকদের বিভিন্ন মতামত আছে। শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের কাজে লাগে এমন প্রবন্ধ লিখতে সবাই ব্যস্ত। বাংলা
কবিতা নিয়ে পরীক্ষা দেবার সময়ে যে সব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পড়েছি ও ধারণা তৈরি
করেছিলাম তা কবিতা লিখতে এসে অনেকটাই পাল্টে গেছে।
কবিতা কিভাবে লিখবেন কবি তা
প্রাবন্ধিকরা বলে দিতে পারেন না। কবিতার ফেনায়িত ব্যাখ্যা করে করে কবিতা প্রায়
ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলোকপাত করলেই কবিতার প্রতি
সুবিচার করা হবে। বিংশ শতাব্দীর কবিতাকে স্কুলপাঠ্যোপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে লিটল
ম্যাগাজিনের পাতা না ভরানোই ভালো। অন্যদিকে দেখা গেছে বিখ্যাত প্রাবন্ধিকরা নিরাপদ
বোধ করেন যখন কোনো প্রতিষ্ঠিত ( জীবিত অথবা মৃত) কবিদের নিয়ে লেখেন। তবু নিজের
কবিতার প্রচারের জন্য প্রাবন্ধিকদের শরণাপন্ন হয়ে কবিদের থাকতে হবে। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
চীরঞ্জীব শূর, অরবিন্দ প্রধান, সমীর রায়চৌধুরী, সুস্নাত জানা, প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য, অভিজিৎ দত্ত, অমিতাভ মৈত্র, বারীন ঘোষাল,
অলোক বিশ্বাস , অরুনাংশু ভট্টাচার্য প্রমুখ কয়েকজনের নাম উল্লেখ
করলাম। এছাড়াও অজস্র প্রাবন্ধিক আছেন তা বাংলাসাহিত্যের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ
তর্কাতীতভাবে। Jacques
Derrida সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
প্রাবন্ধিক। তিনি বলেন The poet... is the man
of metaphor : while the philosopher is interested only in the truth of meaning,
beyond even signs and names, and the sophist manipulates empty signs... the
poet plays on the multiplicity of signified.
কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার
অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?
দেবযানী বসু: অর্থাৎ সাহিত্য সমাজকে কি
দিল? কবিতা সমাজকে কি দিল ? এমন কোনো সমাজ আছে কি যেখানে খুন ধর্ষণ চুরি হয় না? বেশির ভাগ কবি সামাজিক মানুষ।ছাপোষা পারিবারিক
মানুষ। সামাজিক নানা দূর্নীতি, বৈষম্য তাকে আপাদমস্তক
নাড়িয়ে দেয়। কবি কোনো রাজনৈতিক দলের ধামাধরা কবি হলেও তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ
জানাতেই হবে। কবিতার মাধ্যমে লিখে জানাতে হলে তাকে রসমন্ডিত করে ব্যঙ্গাত্মক
ভঙ্গিতে লেখাই ভালো। কোদালকে কোদাল হিসেবে সরলভাবে উপস্থাপন করলে তার কাব্যগুন কমে
যায়। জোর করে সমাজের ভালো করব বলে কবিতা লিখলে আদৌ কিছু হয় না। না কবিতা না
রাজনীতি। কবিতা ও সমাজের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কবিতা সমাজে পরিবর্তন আনে
সোজাসুজি তখনই যখন সমাজের বৃহত্তর অংশ নির্দিষ্ট কোনো ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে
যায়। জনপ্রিয় কবিরা সে সময় বহুল প্রচারিত পত্রিকায় লেখালেখি করেন। এতে জনমানসে
আশ্বাস ও নানা সদর্থক ভাবনার জন্ম হয়। কবির কাছে অনেক সময় অনেক ঘটনা অদ্ভুত লাগতে
পারে যা সাধারণ মানুষের কাছে , পাঠকের কাছে লাগে না।এমনকি
শাসকদলও সেরকম কিছু মনে করেন না।কবি সেই বিষয়টি নিয়ে কবিতা লিখলে অনেক হুমকির
মুখোমুখি হন। কবিদেরও নিজস্ব ইউটোপিয়ার জগৎ থাকে। তিনি তো নিজেই বিচ্ছিন্নতাবোধে
আক্রান্ত। ভুল সমাজে জন্মেছেন এই জ্ঞানে পীড়িত থাকেন। নারীবাদী কবিরা যে শুধু
নারী হবেন তাই না অনেক পুরুষ কবিও নারীবাদী হতে পারেন। আয়ারল্যান্ডে মহিলারা
কবিতা লিখেই কবিতা না লিখতে দেবার প্রতি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ভারতীয় সমাজে
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রচুর। ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্বের দগদগে ঘা আমাদের প্রত্যেকের
মনে আছে। অন্যায় সন্দেহে হত্যা তার পরিবারেই হোক আর রাজনৈতিক কারনেই হোক এসব দেখে
কবিতা না লিখে থাকা যায় না। তবে সে সব কবিতার শ্লোগানসর্বস্ব হয়ে পড়ার আশিভাগ
সম্ভাবনা থাকে। দেশের কারণে লেখা কবিতা না হয় একটু ঊণকবিতা হয়েই থাকল। তবু কবিতা
লেখা দরকার। শুধুই সামাজিক সমস্যা নিয়ে বা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কবিতা লিখলে তিনি
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সেভাবে হারিয়ে যায় নি আজও। অবশ্য
কবিরা 'অসামাজিক'
হয়ে থাকেন চোখে কলম
দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। সমাজের
কুন্দনন্দিনী ও নগেন্দ্রনাথ সমস্যা আজও প্রকটভাবে আছে কবিতায় গল্পে। এথিকাল
অলট্রুইজম দিয়েও অসংশোধনযোগ্য। মা ফলেষু কদাচন বলে কবিকে লিখতে দেওয়া হোক। সময়
বরং কথা বলুক ভবিষ্যতে। ব্যক্তিগত সমস্যা
সবসময় ব্যক্তিগত না থাকতেও পারে।সেও শাখাপ্রশাখা মেলতে পারে। কবিরা অনেকে
সক্রিয়ভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেন। এছাড়া নিয়মিতভাবে দায়বদ্ধ থাকার
প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে। আমি তথাকথিত এই সমাজের সঙ্গে সেভাবে ঘনিষ্ঠ নই। আমার এই
খড়কুটো কবিতা চর্চা বরং নিজেকে ভাসিয়ে দেবার জন্য।
কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে
কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি। না কি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর
কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?
দেবযানী বসু: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ
কবিতার সাহিত্যমূল্যকে একটা পর্যায়ে সাহায্য করে। বিশাল আকারে পরিচিতি পেতে, প্রাথমিক ভাবে মুক্তমনা হতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে, মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক
মতাদর্শ কাজে লাগে। দি গ্ৰাস ইজ সিংগিং এর লেখিকা ডরিস লেসিং একসময় একটি রাজনৈতিক
মতাদর্শ অবলম্বন করে সক্রিয়ভাবে প্রচুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন যা নভেল লিখতে কাজে
লেগেছে। রাজনৈতিক জীবনও একটি জীবন। কবি
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কবি জয়দেব বসু রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন। আবেগ ও
চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা কখনো কখনো সাংবাদিকতার স্তর অতিক্রম করেছে। দেশের স্বাধীনতা লাভ
করার সময়ে রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত প্রভৃতি কবিরা অনেক কবিতা লিখেছেন । আনা
আখতোমোভা পাবলো নেরুদার নাম আমরা কখনো ভুলবো না। রাজনীতিমূলক কবিতায় কবিরা
যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলেছেন আবার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার উদ্দীপনাও জোগান দেন তখন
মনে হয় যুগের প্রয়োজনে কাজ করলেও,
সমসাময়িকতার
গন্ডিবদ্ধতায় আটকে গেলেও কোথাও সাধারণ মানুষের বা জনসাধারণের মনকে তারা ছুঁয়ে
গেছেন। মায়া অ্যাঞ্জেলো, রবার্ট ফ্রস্ট, সমর সেন, দীনেশ দাশ , মৃদুল দাশগুপ্ত , চিলির কবি নিকোনার পাররা এদের কবিতা পাঠক বিস্মৃত
হয় না। খুব বেশিদিন দলদাস হয়ে থাকলে সেই কবির লেখা একঘেয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
তখন সাহিত্য মূল্য কমে যায়। মহত্তর ও মহৎকবিতা লেখা সম্ভব বৈ কি। কিন্তু তা
শুধু জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার করা উচিত নয়। প্রতিবাদী ভূমিকায় লেখা মলয়
রায়চৌধুরীর কবিতা, অলোক বিশ্বাসের কবিতা বাংলা
সাহিত্যে সমাদরযোগ্য।
কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক
ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজ’। আপনিও কি সেই মতে বিশ্বাসী? আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে
পৌঁছিয়ে দেয়। একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে
আপনার মনে হয়?
দেবযানী বসু: এসট্যাবলিশমেন্ট সম্পর্কে
এই মন্তব্য শঙ্খ ঘোষের একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এসব মন কষাকষি পরে ঠিক হয়ে
যায়। কবির জনপ্রিয়তায় কোনো ভাঁটা পড়ে না বলেই মনে হয়। কবি কিভাবে সামলাবেন
সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে একটা কথা আছে। উৎসব অনুষ্ঠানে
অনেক বাজে সময় নষ্ট হয়। পড়ালেখার ক্ষতি হয় সাময়িক ভাবে। কবিরা এসব সুন্দর করে
মানিয়ে নিতে পারেন বলেই মনে হয়। ছোট্ট কবিতাজীবনে এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই
আমার। তবে এসট্যাবলিশমেন্টের আনুকূল্য পাওয়া আখেরে সুফল দেয়।
কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর
বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব সর্বজনবিদিত। আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে
এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি
কারা?
দেবযানী বসু: ইংরেজি কবিদের সম্পর্কে
আমার জ্ঞান ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক অবধি। মনের ভিত তৈরি করতে তা যথেষ্ট
সাহায্য করেছে। অনুবাদের মাধ্যমে কিছু বিদেশী কবিদের বিশেষ করে ফরাসি ও উর্দু
ভাষার কবিদের কবিতা পড়েছি। খুব প্রত্যক্ষভাবে কোনো বিদেশি কবির দ্বারা প্রভাবিত নই। দান্তের নরক পড়লাম অনূদিত
বই। আন্তর্জালে বিভিন্ন পোয়েট্রি গ্ৰুপ ফলো করি। অনেক কবির কবিতা পড়ি। নিকোনার
পাররা, খলিল জিব্রান, অ্যালেন গিন্সবার্গ ইত্যাদি কবিদের পড়ি। বরং বলা
যেতে পারে বিদেশি ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস কবিতার চাইতেও বেশি আকৃষ্ট করে আমাকে। পল
কোয়েলো, সলমন রুশদি, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এদের লেখা আমার
ভালো লাগে।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন
অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?
দেবযানী বসু: বাংলা কাব্যসাহিত্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে বিভিন্ন বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে।
দেশের আমলাতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হিসেবে কবি সাহিত্যিকরা বিদেশে যান।
বাংলায় বিশ্বমানের কবিতা লেখা হলেও বাংলা কবিতার প্রভাব সে দেশের কবি ও
সাহিত্যিকদের উপরে পড়ে না। বিভিন্ন দেশের গবেষকরা বাঙালি কবিদের সাক্ষাৎকার নেন জার্নালে লেখেন ব্লগে লেখেন।
ব্যস ঐ পর্যন্তই। বাংলা ভাষা এখানেই যথেষ্ট অবহেলিত। নতুন প্রজন্মের সবাই ইংরেজিতে
দক্ষতা চায়। অনুবাদ সাহিত্য অপ্রতুল, বিশেষত বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ কবিতার কজন বা করেন বা করান। ও ঠিকমতো
পরিবেশনা করাও হয় না। অপরিমিত জ্ঞান সদিচ্ছা ও মধ্যবিত্ত বিত্ত নিয়ে সঠিক কবিতা
চর্চা হয় না। আমেরিকার ডানা জোইয়ার 'ক্যান পোয়েট্রি ম্যাটার' পড়লে বোঝা যায় ওরা নিজেরাই
টালমাটাল হয়ে আছে নিজেদের কবিতা নিয়ে। আমাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থাটাও একইরকম।
সেরকম জোরদার কোনো প্রাবন্ধিক বা মহানায়ক কবিও তো এই পরিস্থিতিতে উঠে আসছেন না।
অতএব যেমন চলছে চলুক।
কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা
মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়
না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?
দেবযানী বসু: প্রকৃত কবিরা কি যশ
প্রতিষ্ঠা শূকরীবিষ্ঠা জ্ঞান করবেন?
নাকি এমিলি
ডিকিনসনের মতো বলবেন 'fame is a fickle food/Upon a shifting plate' ...কবিরা বাংলা সাহিত্যে কতোদিন
টিঁকে থাকবেন জনমানসে কতোদিন বিরাজিত থাকবেন এসব ভেবে কি কবিতা লেখেন আমার তা মনে
হয় না। প্রকৃত কবি পুরস্কারের কাছে এলে পুরস্কার উড়ে চলে যায় কিনা তাই বা কে
বলবে...অনেককে বলতে শুনেছি অর্থকরী পুরস্কার চাই না এই একটা স্বীকৃতি পেলাম এই
যথেষ্ট। কবির ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করবে পুরস্কারের খ্যাতি তার প্রতিভাকে একস্থানে
দাঁড় করিয়ে দেবে কি দেবে না। পয়সাকড়ি পাওয়া কিছু খারাপ ব্যাপার না।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিই হোক আর অর্থানুকুল্যই হোক তার সদর্থক দিকটিকে প্রাধান্য
দেওয়া উচিত বলে আমার বিশ্বাস।
কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন
কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের
ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী আপনি?
দেবযানী বসু: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার যুগ শেষ
হয়েছে বাংলা সাহিত্যে এটা কেন যে মেনে নেওয়া হয় না মন থেকে আমি জানি না। এখন
উত্তর আধুনিকতার যুগ। আমরা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এনু গেনু খেনু করে কবিতা
আর লিখতে পারবো না। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী আধুনিক যুগে বাস করছি আমরা। ঐতিহ্য মানে
কি মহাকাব্য না চর্যাপদ না মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্য বোঝাচ্ছে? যাই হোক ঐতিহ্যবাহী
আধুনিককাল রবীন্দ্রনাথ ও তার সমসাময়িক কাল ধরে নিলে বা নবজাগরণের সময়কাল যদি বলা
যায় তাহলে চল্লিশের দশক থেকে আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্ব বলা যায়। আধুনিক যুগের
তৃতীয় পর্ব হতে পারে আশির দশকের পর থেকে কল্পনা করতে দোষ নেই। সেই জন্য শূন্য
দশকের অনুপম মুখোপাধ্যায় তার কবিতার রচনাশৈলীকে নাম দিয়েছেন পুনরাধুনিক। এর আগের
পর্বটা নতুন অপর ইত্যাদি নামের। মলয় রায়চৌধুরী পুষ্কর দাশগুপ্ত রবীন্দু গুহ
আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা বললেও শ্রুতি ও নিমসাহিত্য ইত্যাদি আন্দোলন করলেও তা
আধুনিক কবিতার যুগ হিসেবেই পরিগণিত হবে? বিদ্বজ্জন বলতে পারবেন। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। পোস্ট কলোনিয়াল যুগ তার হ্যাং
ওভারসহ এখনো চলছে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় করার কোনো প্রয়োজন আছে কি? বরং কবিরা একটু স্বাধীন শৈল্পিক কোনো অচেনা শৈলীর
অবতারণা করুক। নতুন প্রজন্মকে কিছু বলার নেই আমার। আমি নিজেই নতুন প্রজন্মের দলে
পড়ি। ২০০০ এর পর থেকে যারা লিখছেন কবিতা তারা অনেক জ্ঞানী ও পরিণত আমার থেকে। আমার তো সব অসম্পূর্ণ। আমি তাদের কাছ থেকে শিখতে
চাই।
কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার
মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন। অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের
বিষয়ে যদি বলেন।
দেবযানী বসু: কবিখ্যাতির বাজারমূল্য তারাই পান যারা একাডেমীর সঙ্গে জড়িত
বা দৈনিক সাপ্তাহিক নানা খবর কাগজে ও বহুল প্রচারিত অর্থকরী কোনো কোনো সাহিত্য
পত্রিকায়। নিজের বাজার মূল্য বুঝে ছোটোকাগজ বড়ো কাগজ সবার সঙ্গে নিজের সুবিধা
মতো ব্যবহার করতে পারেন। এটা আর এমন কি মন্দ দিক। বইপত্র দ্রুত বিক্রি হতে
পারে। এটা ভালো দিক। সম্পাদকদের স্নেহ ও খাতির পান।এটা ভালো দিক। লিখে টাকা রোজগার করা খুবই
কঠিন ব্যাপার।কবিখ্যাতি রোজগারের
দীপশিখা উজ্জ্বল করে। সেটি অবশ্যই ভালো ব্যাপার।খারাপ দিক বলতে কবিতায় কাব্যগুণ
না থাকলেও স্নেহধন্য কেউ কেউ বিখ্যাত কবির অনুমোদন লাভ করেন। বিখ্যাত কবি দেহ রাখলে আরেকপ্রস্থ
তার বই বিক্রি হয়। কালক্রমে তার বাজার মূল্য তেজি থেকে স্তিমিত হয়ে আসে। আর
সুবিখ্যাত কবি হলে তার অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে বাজার বেশ কিছু দিন ব্যস্ত থাকে।এটা
নিশ্চিত সৌভাগ্যজনক বিষয়।অলমিতিবিস্তরেন।
কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে জানতে
চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
দেবযানী বসু: কবিতার ভবিষ্যত নিয়ে
নিরাশাবাদী হবার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে কবির সংখ্যা
যারপরনাই সীমাতীত। এছাড়া বহির্বঙ্গ আছে। আন্তর্জালে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে
কবিতা। কবিদের সুসময় চলছে। কবিদের সঙ্গে কবিদের, কবিদের সঙ্গে বোদ্ধা জনগণের, কবিদের সঙ্গে অন্যান্য শাখার শিল্পীদের যোগাযোগ যতো বৃদ্ধি
পাবে ততো কবিতার উন্নতি হবে। আগামী দিনে শ্রেষ্ঠ ফসলে আমাদের ঘর ও বার ভরে যাবে।
দেবযানী বসু: শূন্য দশকের কবি। বর্তমান নিবাস টালিগঞ্জ। গৃহবধূ।
জন্ম ১৯৬০। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও বি. এড.। পিতা : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক। স্বামী আইনজীবী। তিন সন্তান বর্তমান। কৃত্তিবাস থেকে প্রথম কবিতার বই : দেবযানীর
স্বীকারোক্তি। প্রতিভাস থেকে : স্বপ্নিল বর্ণমালা। সহযাত্রী থেকে : তৃতীয়া পৃথিবী।
কবিতা ক্যাম্পাস থেকে : আইভরি খাতা। নোনামিঠে জলচিহ্ন। রেডিও অ্যাক্টিভ মিনারেল
বৃষ্টি। সুতরাং থেকে : চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা। সুতরাং থেকে শীঘ্রই
স্ট্রবেরিগন্ধার যোজনপথ প্রকাশিত হবে।