সম্পাদকের
কলমে
এখন উৎসবের মরশুম। জাতি ধর্ম
নির্বিশেষে সকলে উৎসবে মেতে উঠেছে। দুর্গা পুজোতে আমরা মাতৃশক্তির আরাধনা করি। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে শুভ শক্তির
প্রতিষ্ঠা করি। দুর্গা পুজোর প্রথম প্রচলন হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। তখন পারিবারিক পুজো হিসাবে প্রচলিত ছিল। ১৭১০ সালে গুপ্তিপাড়ার ১২ জন ব্রাহ্মণ
মিলে সর্ব সাধারণের পৃষ্ঠ পোষকতায় বারো ইয়ারি (বন্ধু) পুজোর প্রচলন শুরু করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয় কাশিমবাজারের রাজবাড়ির রাজা
হরিশচন্দ্রের পারিবারিক বাড়িতে। ধীরে
ধীরে সেটা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর রূপ পায়। সামনেই
লক্ষ্মী পুজো তারপর দীপান্বিতা উৎসব। ভাইফোঁটা
পর্যন্ত পরপর চলতে থাকবে। দৈনন্দিন জীবনের
সমস্যা ভুলে এই উৎসবের দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের সঙ্গে মেলার চেষ্টা করি।
কার্ত্তিক মাস মানেই হেমন্তের শুরু। শীতের ছোঁয়া। প্রকৃতি
সেজে ওঠে অন্যরূপে। চারিদিকে নতুন ধানের গন্ধ।
নতুন চালের পিঠে পায়েস,
নতুন শাক সব্জি বাঙালীর
দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়েছে।
কবি জীবনানন্দের ভাষায় “আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় …… কার্ত্তিকের নবান্নের দেশে …” প্রিয়
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত ‘ হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ হতে চাই যদিও আমরা
প্রকৃতিকে তার ঋতু বৈচিত্র্যে বিশেষ করে
হেমন্তকালকে সেভাবে উপভোগ করতে পারি না।
তবুও বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণ। আমরা যারা কবিতা প্রয়াসী যারা কবিতার পাঠক তাদের কাছে চোদ্দতম পার্বণটি হল
কবিতা উৎসব।
সুখে দুঃখে বেঁচে থাকার সঙ্গে
সঙ্গে কবিতা যাপন আমদের কাছে উৎসব হয়ে ধরা
দেয়। সময়কে আমরা ধরতে চাই কবিতার মাধ্যমে। কবি তখন ভিড়ের মাঝেও নিজেকে একলা করে নেয়। মগজে মননে ক্রমশ একলা হতে থাকা ভাঙাচোরা হেরে যাওয়া
মানুষের ভেতরের উচ্চারণ যখন কিছু শব্দকে
ভর করে বেরিয়ে আসে অবয়ব চায় তখনই তো কবিতার জন্ম দেয়।
কবিরা তাদের সৃষ্টিকে সকলের সঙ্গে ভাগ করে
নিতে চায় তখন তার উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়। কবিতাউৎসবের
আয়োজনে সাতচল্লিশ জন কবির কবিতা নিয়ে কবিতা উৎসবের কার্ত্তিক সংখ্যা ১৪২৫ প্রকাশিত
হল।
উৎসব উপলক্ষে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। দেশের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে দারিদ্র্য একটি মূল
সমস্যা। সেখানে পুজো উপলক্ষে এত খরচ করাটা আমাদের একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এই বিপুল অর্থের কিছু অংশ দিয়ে যদি দুঃস্থ মানুষের
পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে এই উৎসবের দিনগুলোতে অনেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারব। আশার কথা এখন সোশ্যাল সাইটকে যোগাযোগের মাধ্যম করে
একত্রিত হয়ে মানুষ এই ধরনের সামাজিক কাজকর্ম
করছে। সম্প্রতি
থিমের পুজোতে শারদীয়া দুর্গোৎসব শিল্পের একটা নতুন দিক তুলে ধরছে যা এই সময়ের
শিল্পীদের নতুন আঙ্গিকে কাজের সন্ধান দিচ্ছে।
উৎসব আমাদের জাতপাতের ও ভাষার
ভিত্তিতে লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্য দূর
করবে এই আশা রাখি কিন্তু সম্প্রতি কিছু ঘটনায় দেখছি ভাষা ভিত্তিতে বিভেদ তৈরী করার
চেষ্টা চলছে। কোন ভাষাই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয় সংস্কৃত কিংবা উর্দু
সে যে ভাষাই হোক তার ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ভাষা হারিয়ে গেলে জাতির সংস্কৃতিও
হারিয়ে যাবে।
আমারা যখন উৎসবের আয়োজন করছি
মাতৃ শক্তির আরাধনা করব বলে তখন
আটশ বছরের পুরোনো শবরীমালা মন্দিরে
মহিলাদের প্রবেশ বৈধ করল শীর্ষ
আদালত। ধর্মের আড়ালে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। ঋতুমতী মহিলাদের অপবিত্র মনে করে তাদের মন্দিরে প্রবেশের
অধিকার ছিল না। ঋতুচক্র একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও শরীরবৃত্তীয়
প্রক্রিয়া যা কখন কোন মানুষকে অপবিত্র
করতে পারে না এই ধারনা এখনও অনেক মহিলার মধ্যে তৈরী হয়নি।
হিন্দু মন্দির শুধু নয় মুম্বাইয়ের হাজি
আলি শাহ্ বুখারির মাজার ২০১২ সালে দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল পরে ২০১৬ সালে আবার খুলে দেওয়া
হয় সকলের জন্য। এখনও অনেক হিন্দু মন্দিরে দলিতদের ও মুসলমান
ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশে উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। সেসব
নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে উঠে যাবে এই আশা রাখি।
সুপ্রীম কোর্টের আরও একটি সাম্প্রতিক রায় ৩৭৭ ধারায় সমকাম আর অপরাধ নয়।যৌনতা মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলন
সার্থক হল। কিন্তু সমাজ এই ‘হলদে গোলাপ’ দের কতটা মেনে নিচ্ছে সেটাই দেখার।
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল না হলে এই মানুষগুলো বঞ্চনার শিকার হবে।
আরও একটি যুগান্তকারী রায় দিল
সুপ্রীম কোর্ট পরকীয়া আর ফৌজদারি অপরাধ নয়। ৪৯৭
ধারায় এটা অপরাধ ছিল। সুপ্রীম কোর্ট
জানিয়ে দিল ১৮৬০ সালে তৈরি ৪৯৭ ধারায় নারী তার স্বামীর সম্পত্তি নয়। এতদিন কোন নারী যদি তার স্বামীর অমতে কোন পুরুষের
সাথে যৌন সম্পর্কের লিপ্ত হত তাহলে পুরুষটির বিরুদ্ধে ৪৯৭ ধারায় মামলা করা যেত। দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছরের জেল জরিমানা করা জেত।
সমান দোষে দোষী নারীটির বিরুদ্ধে মামলা
করা যেত না। এরকম একটি ধারাকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছে।এই আইনটির সংস্কার প্রয়োজন ছিল।
তবে পরকীয়ায় সিভিল কোর্টে যাওয়া যাবে এবং ডিভোর্সের মামলা করা যাবে। পরকীয়ার জন্য কেউ কোর্টের রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল না। যেমন চলছিল চলবে। তবে চারটে মানুষের জীবন যেখানে জড়িত সেখানে
শুধু আইন কিছু করতে পারবে না বিবাহ নামক চুক্তিটি বা বন্ধনটি আলগা হয়ে যাতে না যায়
সেটা নিজেদের ভাবতে হবে। এটা সমাজ বা
রাষ্ট্রের বিষয় নয়।
তবে গ্রামে গঞ্জে কেউ আইনের ধার
ধারে না মোড়লরাই শাস্তি ঘোষণা করে দেয়। এ
ব্যাপারে লাভপুরের ঘটনা মনে পড়ে যায়। এখন যে
অপরাধগুলো রাষ্ট্র বলছে অপরাধ নয় সেগুলো সমাজ মেনে নিচ্ছে কিনা, পরকীয়ার
সাফাই গাইতে আইনের কথা বলা হচ্ছে তা পরিবারগুলোকে রক্ষা করছে কিনা, আমরা সত্যি সত্যি স্বাধীন হচ্ছি কিনা এগুলো এখন দেখার বিষয়। আসলে এখন ধর্মীয়
কুসংস্কারের বলি হচ্ছে মানুষ সেখানে এখন আইন পৌঁছয়নি।
আসলে সকলের ভালো থাকা মানে শিক্ষা স্বাস্থ্য এসবের প্রয়োজন সবার আগে। সবাই যদি ভালো না থাকি তবে উৎসবের আনন্দ অনেকাংশে
ম্লান হয়ে যায়।
বেঁচে থাকার অনেক সমস্যা অনেক
প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও আমরা এই কবিতা উৎসবের কাছে এসে আমদের অক্সিজেন সংগ্রহ করি। এই ধরনের ওয়েবজাইন কিন্তু আমাদের স্বাধীনভাবে কিছু
বলার সুযোগ করে দিয়েছে। কবিতার মাধ্যমে
আমরা আমাদের মত ও চিন্তভাবনা প্রকাশ করতে পারছি অনায়াসে।
কিছু বছর আগেও কিন্তু এত সহজ ছিল না। এই
কার্ত্তিক সংখ্যাটিতে অনেক নতুন মুখ দেখতে পাচ্ছি।
যে কোন কবি তার শুরুতে কিছু কাঁচা কবিতা লেখেন।
কবিতা উৎসব কিন্তু সেই চারা গাছে সার মাটি জল দেওয়ার কাজটি নিপুনভাবে করে আসছে। আশা করছি আগামীদিনে তাঁরা বাংলা কবিতাকে
এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এ সংখ্যার
সুন্দর আয়োজন । দেশ বিদেশের বাংলা কবিতার পাঠকরা আশা করি হতাশ হবেন
না। শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি
সবাইকে। সবার জীবন মঙ্গলময় হয়ে উঠুক।
শীলা বিশ্বাস