কবিতাউৎসব
সাক্ষাৎকার ১৪২৫
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে
ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো
আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক
কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। বাংলার জনজীবনে
কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার
লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: আমাদের পরিবার ছিল হরিহরের পরিবার। খুব ছোটবেলায়, তখন ফোর কি ফাইভে পড়ি, বাবা যজমানের বাড়িতে যখন
সত্যসারায়ণের পাঁচালি পড়ত তখন মুগ্ধ হয়ে মুনতাম। সুরেলা গলায় দুর্গাপুজোয় বাবার
চণ্ডীপাঠ আমাকে চুম্বকের মতো টানত। এখানেই প্রথম আমি কবিতার সংস্পর্শে আসি। পরে
দেখলাম কোথায় নেই কবিতা! জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু – সবজায়গাতেই কবিতা।
আমরা যারা কবিতা লিখতে ভালোবাসি, কবিতা পড়তে ভালোবাসি, কবিতায় থাকতে ভালোবাসি – তাদের কাছে কবিতার এই বাড়বাড়ন্ত
একটা অন্য প্রাপ্তি। তবে এই আবহাওয়া তৈরীতে “কবিতা উৎসব”-এর একটা বিরাট ভূমিকা আছে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যখন
আটের দশকের শেষদিকে কবিতা লিখতে আসি তখন কিন্তু এই পরিবেশ ছিল না। তখন একজন কবিকে
একটা কবিতা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হত। এখন একজন কবি তাঁর
সাম্প্্রতিকতম কবিতাটি “কবিতা উৎসব”-এর মাধ্যমে পাঠকের সামনে খুব দ্রুত
হাজির করতে পারছেন। এখন একজন কবিকে কবিতা লিখে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয় না। হাত
বাড়ালেই “কবিতা উৎসব”। অন্যদিকে পাঠকেরা কবিদের
প্রতিমাসের নতুন নতুন সৃষ্টিকে পড়ে নিতে পারছেন। এজন্য “কবিতা উৎসব”-কে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আমাদের
যৌবনে এরকম একটা “কবিতা উৎসব” থাকলে বেশ হতো। কবিতায় নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষাকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া
যেত।
কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর
সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে
কি?
এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা
কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে মনে হয় আপনার।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: না,
একেবারেই না। কবিতাকে সামনে রেখে যে ধারণা করেছিলাম আজও সেই
ধারণায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। হুবহু এক আছে। চেষ্টা করে কবিতা হয় না – হ্যাঁ একমাত্র কবিতাই হয় না। সাধনা করতে হয়। হৃদয়ের দুয়ার
খুলে সুন্দরের সাধনা। কবিতা নাও আসতে পারে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তবে এই
কবিতা সাধনাকালীন সময়ে মন পবিত্র হয়ে উঠতে পারে। তবে এটা নির্ভর করছে তুমি কতটা
গভীরে যেতে পারো। এতে একটা অদ্ভুত পরিবেশ চোখের সামনে গড়ে ওঠে। পৃথিবীর সবকিছুই
তখন সুন্দর। চোখের সামনে শুধু আলো।
যে জীবন যাপন করি, যে আদর্শে বিশ্বাস
করি তা-ই আমার কবিতায় ভাষা পায়। আমার অদেখা জীবন কখনও আমার কবিতায় আসে না। চেনা মানুষ, চেনা কথা, চেনা পরিবেশ
যাদের কবিতায় আসে না তাদেরকে আমার চরিত্রহীন বলেই মনে হয়।
কবিতা আমার কাছে আশ্রয়ের মতো। জীবনের বহু সমস্যায় কবিতাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে
ধরেছি। উথ্থানের রাস্তা সে-ই করে দিয়েছে। আজও কবিতা ছাড়া মুহুর্তমাত্রও কল্পনা
করতে পারি না। শুধু আজ বলে নয়। বাংলা কবিতায় চিরকালই দুই ধরনের কবি ছিলেন। একদল
বিশ্বাস করেন কবিতা সাধনার ধন। আর একদল কবিতা লেখার চেষ্টা করে নিজেকে কবি করে
তোলার চেষ্টা করেন। তিনি কবিতা যাই লিখুন সারাদিন কবির ভূমিকায় অভিনয় করে যান।
বাবা যখন মারা গেলেন তখন মনে হল মুহূর্তে পৃথিবীটা শূন্য হয়ে গেল। কোথায় গিয়ে
দাঁড়াব?
সেদিন কবিতা দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছে। মায়ের মৃত্যুদিনেও কবিতার কাছ থেকে একই সারা
পেয়েছি। এমনও দিন গেছেএকবেলা ভাত জুটেছে। সেই দারুণ দুঃখের দিনেও কবিতা বুকে সব
ভুলে গেছি। কিন্তু কবিতা যে কবির কাছে দেখানোর সামগ্রী সেই কবি কবিতার কিছে আশ্রয়
পেতে পারেন না।
কবিতা সাধনার ধন – কজনের কাছে আমি জানি
না। তবে এখন চারিদিকে হুজুগ। প্রাণ থেকে কেউ আর এসব করে না। সবাই মেনেও নিচ্ছে।
তাই মনে হয় আজকের সমাজ ক্রমাবনতির দিকে।
কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার
প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক
বিকাশ,
কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন এই বিষয়ে।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফুর্ত
আবেগের তো অবশ্যই প্রয়োজন। ককবি আবেগ
দ্বারা তাড়িত হবে না --- এটা তো হতে পারে না। তবে শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে কিছু হবে
না। কারণ আবেগ তো সব মানুষেরই আছে। তাহলে তো সবাই কবিতা লিখতে পারতেন। কিন্তু তা
তো হয় না। খুব সামান্য সংখ্যার মানুষই
আবেগকে কবিতায় রূপান্তরিত করতে পারেন। তার মানে কবিতার মধ্যে আবেগকে কাজে
লাগাতে গেলে নিজের বোধ চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। শুধু বোধ চেতনা থাকলেই হবে না।
তাকে শিল্পসম্মত উপায়ে প্রয়োগ করতে হবে। কারণ আবেগকে সংযত করতে না পারলে যে কবিতা
তৈরী হবে তা কবিতা না হয়ে স্লোগান হয়ে যাবে। ছাত্রবয়সে দেখেছি আমার বন্ধুরা সবাই কবিতা লিখছে। আসলে সে
কবকিতাগুলো সবই প্্রেএমের কবিতা। যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো আর না হয় যে মেয়েটাকে তার
ভালোলাগতো তাকে নিয়েই এই কবিতা। আসলে এগুলো কবিতা নয়। মেয়েটি কতটা সুন্দর, মেয়েটিকে সে কেন ভালোবাসে – এইসবই লেখা থাকতো তাতে। যা লিখতো তা সবই একধরনের। তারপর
একসময় দেখলাম সেইসব বন্ধুরা একে একে সবাই লেখা ছেড়ে দিল। ওদের একটাই বিষয় ছিল
প্রেম। ওরা বলল,
যা বলার ছিল সব বলা হয়ে গেছে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে অভিঞ্জততার ঝুলিও ভরে ওঠে। কবিতা লেখার ভঙ্গিমা বদলে যায়।
কিন্তু এরকম কবির সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগ কবিই একই ভঙ্গিমায় লিখে যান। আমরা যদি
বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পীর কাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো বিভিন্ন সময়ে তাদের
কাজের ধরন বদলেছে। যেমন, পিকাসো।
কবিতার ক্ষেত্রেও তাই হয়।
কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে
শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন। একবিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে
আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রকৃত সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। সব বয়সের চাহিদা এক নয়। বয়স
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বদলে যায়। শৈশবে যে মাতৃস্তন্য পান করে আমরা বড় হই, সেই স্তন্য
সম্পর্কেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধারণা বদলে যায়। সবটাই স্বাভাবিক। ক্লাস
নাইন টেন থেকে বুদ্ধদেব বসু, সমেশ বসুর উপন্যাস পড়েছি। অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের
উপন্যাস। কখনও অন্যরকম কিছু মনে হয় নি। মনে আছে তখনও আমি মাধ্যমিক দিই নি।
পাঠাগারে বই আনতে গেছি। অজিতদা বলে একজন ছিলেন, তিনি আমার জন্য বিশেষ বিশেষ বই
রেখে দিতেন। একদিন সমরেশ বসুর “বিবর” নিচ্ছি। হঠাৎ একজন বয়স্ক মানুষ আমাকে কিছু না বলে অজিতদাকে বলতে শুরু
করে, “তোমরা এই অল্পবয়স্কদের এই ধরনের বই দাও কেন?” অজিতদাকে কিছু বলতে না দিয়ে
আমি বলেছিলাম, “কেউ যদি অল্পবয়সেই পড়ার উপযুক্ত হয়?” উনি আর কিছু বলেন নি।
আসলে জীবনের প্রয়োজনে যা আসার তা আসবেই। কেউ আটকে রাখতে পারবে না। জীবন বাদ
দিয়ে তো আর সাহিত্য হয় না। তাই সাহিত্যে জীবনের ছবি এসে পড়বেই। আমাদের চারপাশে
যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমাদের পরিবারের মানুষগুলো – সবাই তো নিজের নিজের মতো। কারও
সাথে কারও মিলবে না। তবে সাহিত্যে যা-ই আসুক না কেন কোনো অসুবিধা নেই। তবে একটাই শর্ত,
তা যেন শিল্পসম্মত হয়ে ওঠে।
কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা
প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ
নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য আজ অনেকদূর বিস্তৃতি
লাভ করেছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক
মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং
জীবনানন্দের কাব্যভূবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্যে আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ
করেছে। গত শতকের চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতা সবদিক থেকেই সমাজ রাজনীতির বোধ জারিত।
এইসময়ের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, হিটলারের
রাশিয়া আক্রমণ,
সাম্যবাদীদের দিক থেকে ফ্যাসিবাদকে প্রতিহক করবার সংকল্প
গ্রহণ,
তেতাল্লিশের মন্বন্তর, গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা। এইসময় বাংলা কবিতায় আগুন ঝরিয়েছে।
বাংলা কবিতা সুস্পষ্ট বাঁক নেয় ১৯৩৭ – ৩৮ সাল থেকে যখন কবিতা লেখা শুরু করলেন অরুন মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,সমর সেন, দিনেশ দাশ।
কবিতা যেন সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকাশ করতে পারে। তাই কবিতার ভাষা হল সরল,বক্তব্য হল গণসংবেদী। লক্ষ্য হল জনচেতনার জাগরণ। পঞ্চাশের
দশকের কবিরা ব্যক্তিগত উপলব্ধির নিমগ্নতলে কিভাবে অবগাহন করেছিলেন সেটা আমরা শক্তি
চট্টোপাধ্যায়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকারের
কবিতা পাঠ করলেই বুঝতে পারব। এইভাবেই বাংলা কবিতা নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে
দিয়ে এগিয়ে গেছে। সেই ধারা আজও পিনাকি ঠাকুর, জয় গোস্বামী, বব্রত
চক্রবর্তীর হাত ধরে সমান তালে এগিয়ে চলেছে। তবে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক
কবিতাও বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠান যে কবিতা পছন্দ করছে সেগুলোকেই তারা
ছাপছে। আজকের নবীন প্রজন্মের কবিরা সেই পত্রিকায় কবিতা ছাপানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের
সেই শর্তকেই মেনে নিচ্ছে। এটা বেশ চিন্তার বিষয়।
কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক
এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: পাত্র পাত্রীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেয় ঘটক। সমালোচকরা ঘটকেরই মতো। পাঠকের কাছে
তো সাহিত্য সমালোচকরাই কবিকে পৌঁছে দেন। কাজটি
খুবই গুরূত্বপূর্ণ। কিন্তু যোগ্য সমালোচক কোথায়? বেশিরভাগ তো আলোচনার জন্যই আলোচনা করেন। দেখা যায় বছর দুয়েক
কবিতা লিখছেন এমন কবিও সম্পাদকমণ্ডলীর সাথে যোগাযোগের কারণে কবিতার বই-এর আলোচনা
করিয়ে নিচ্ছেন। এই আলোচনা যে খুব উন্নতমানের হবে না তা বলাই বাহুল্য। শিল্পী
শ্যামল দত্তরায় শিল্প সমালোচকদের একদম সহ্য করতে পারতেন না। আমার কাছে অনেকবার
বলেছেন,
“তুলি ধরতে পারিস না, তোর আবার অত কথা কিসের? আমরা আঁকি বলেই তো তোদের কথা। নিজে একটা এঁকে দেখিয়ে দে তো
ছবি আঁকা কাকে বলে।“ আমি বলি, জেনে বুঝে এসে সাহিত্য সমালোচনায় অংশগ্রহণ করুন।
কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন
কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কবি সমাজের বাইরের কেউ নন। তিনি অনেকের থেকে অনেক বেশি বেশি এই সমাজের গভীরে
বাস করেন। সমাজের অনেক বিষয়ই তাঁকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। কবি সমাজের এমন একজন
মানুষ যার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরোটাই সমাজের জন্য উৎসর্গীকৃত। কবি একটা পাখিকে নিয়ে লিখছেন। তার মানে কবি পাখিকে
নিয়ে ভাবেন। কবি মনে প্রাণে চান পাখিরা এই পরিবেশে ভাল থাকুক। এবার যদি আপনি সেই
কবিকে জিঞ্জাসা করেন যে আপনি পাখিকে নিয়ে
লিখছেন কেন,
কবি এর উত্তর হয়তো আমার মতন করে দিতেও পারেন, আবার নাও পারেন। কিন্তু উত্তর ওটাই। এটাই তো সামাজিক দায়বদ্্্ধতা।
তবে হ্যাঁ,
কবি এই ব্যাপারে হয়তো সবসময় সচেতন থাকেন না। সমগ্র পৃথিবীর
প্রতি কবির ভালোবাসা তাঁর রক্তের মধ্যে নিহিত। তাই তাঁর আর আলাদা করে ভাবার বা
বলার প্রয়োজন নেই।
কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি। না কি
রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কবি বিশষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী – এ আমি স্বপনেও ভাবতে পারি না। কবি সবসময় মানুষের পক্ষে।
জাতি,
দর্ম, বর্ণ
নির্বিশেষে মানুষের সম্মান একমাত্র কবির কাছেই আছে। মানুষের যন্ত্রনা, কষ্টে বঞ্চনা, শোষণ –
সবার আগে কবি গর্জে ওঠেন। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে
বিশ্বাসী হলে কবির এই প্রতিবাদ করার শক্তি আর থাকে না। আমি মনে করি রাজনৈতিক
মতাদর্শের ভিত্তি থেকে মহত্তর কবিতা সৃষ্টি কখনও সম্ভব নয়।
কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজ’। আপনিও কি সেই মতে
বিশ্বাসী?
আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি
সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়। একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি
সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে আপনার মনে হয়?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: হ্যাঁ, আমিও কবি
শঙ্খ ঘোষের মতে বিশ্বাসী। কবি আর এসটাবলিশমেন্ট – এ তো সোনার পাথরবাটি। আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করতেই পারব না
কবি এসটাবলিশমেন্ট পছন্দ করবেন। প্কৃত কবি কখনও এসটাবলিশমেন্ট পছন্দ করতে পারেন
না। আজকের ছবি অবশ্য আলাদা। অনেকেই আজ এসটাবলিশমেন্টের পেছনে ছুটছেন। কিন্তু তারা কোথায়
যাবেন আমি জানি না। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার – এই সমস্ত কবিদের কথা ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজও
আমরা এদের কথা ভুলি নি।
কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব
সর্বজনবিদিত। আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি কারা?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি সচেতনভাবে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গন
থেকে কিছু গ্রহণ করেছি -- এটা কখনই হয় নি। তবে বিদেশি কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে কখন
অচেতনভাবেই মনরে মধ্যে অনেক কিছু ঢুকে পড়েছে। নিজে কবিতা লিখতে গিয়ে কোনো কোনো সময়
তার প্রয়োগ ঘটে গেছে। তবে কোনোটাই সচেতনভাবে নয়। আমার খুব প্রিয় বিদেশী কবিরা হলেন এলিয়ট, অক্টাভিও পাজ, এলার্দে,
লার্কিন, খলিল জিব্রান, পাবলো নেরুদা।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা
কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: অবশ্যই দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেলটা কোথা থেকে পেলেন? বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গন থেকে। সেইসময় রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার
দ্বারা অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। এই প্রভাব তো জীবনের ওপর প্রভাব। আর সেখান থেকেই
তো সাহিত্য। এই বাংলার মাটিতে বাউল তত্ত্ব, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের
ভাবধারা --- পৃথিবীর যেকোনো মানুষের আশ্রয়। এমন শান্তির নীড় আর কোথায়? বিশ্বসাহিত্য আজও এই আশ্রয়ে আশ্রিত।
কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির
কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়
না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: পুরষ্কার অবশ্যই কোনো কাজের স্বীকৃতি। কিন্তু তবুও পুরষ্কার দিয়ে কোনো কিছুর বিচার করা যায় না। বিশেষত সাহিত্যের
ক্ষেত্রে তো নয়ই। একজন প্রকৃত কবি প্রাতিষ্ঠানিক পুরষ্কারের আশায় বসে থাকেন না।
তিনি তাঁর কাজ করে যান। একজন কবির সবচেয়ে বড় পুরষ্কার মানুষের ভালোবাসা আর আগামী
দিনে তিনি কতটা মানুষের সনে বেঁচে রইলেন।
অবশ্যই পুরষ্কারের খ্যাতি একজন কবিকে একজায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। যে লেখার
মধ্যে দিয়ে তাঁর এই স্বীকৃতি, দেখা গেল সেই
লেখার মধ্যেই তিনি আমৃত্যু রয়ে গেলেন। এ তো একধরনের মৃত্যু। আবার আমরা এও দেখেছি, কোনো রাষ্ট্রশক্তি পুরষ্কারের মাধ্যমে কবির বিদ্রোহী
সত্ত্বাকে থামিয়ে দিচ্ছেন। তবে আমি বিশ্বাস করি, কোনো প্রকৃত কবিকে কোনো কালেই কোনো কিছু দিয়েই থামিয়ে রাখা
যায় না।
কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায়
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী
আপনি?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: অতীতকে বাদ দিয়ে কোনো কিছুই হবার নয়। আমাদের তাকাতেই হবে পেছনের দিকে। এই
তাকানো মানে কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া নয়। তাই আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার
মধ্যে সমন্বয় সাধন ভীষনভাবেই জরূরী। এই প্রজন্মের তরূণ কবিদের আমি বলব, তারা অবশ্যই পরীক্ষা নিরীক্ষা করুক কিন্তু তা কখনই যেন
আমাদের ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে না হয়। মানুষ অনেককিছুই ভুলে গেছে আবার অনেক কিছুকেই আজও
মনে রেখে দিয়েছে। একজন প্রকৃত মানুষের মধ্যে আজও যা বেঁচে আছে সেটাই হল তাঁর দেশের
সাহিত্য। যে মানুষ তার ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলে সে তো মৃত।
কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা
সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি
কিভাবে দেখেন। অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের বিষয়ে যদি বলেন।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কবি নবারুন ভট্টাচার্যের একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই ব্লতেন, “কবি মানেই একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, পকেটে একটা ফুটো পয়সাও না থাকা --- এটা আমাদের মনে একেবারে বদ্ধমূল হয়ে গেছে।
এর বাইরে কবি বেরোলেই তাকে নিয়ে হাজার আলোচনা শুরু হয়ে যায়।“
আমারও বক্তব্য তাই। এই সমাজে বাস করে সকলের সবকিছু হবে আর কবির কিছু হলেই
বিপদ। কেন?
আমার এই বক্তব্যের একটা ভুল ব্যাখ্যা হতে পারেএ, যেমন নবারুন ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে হতো। আমি কিন্তু আজকের
সময়ের কবিদের দৌড় প্রতিযোগিতাকে কিছুতেই সমর্থন করি না। কবিরা প্রতিযোগিতায় কেন? আজকের কবিরা তো কাব্যসাধনার থেকে মুখ দেখানোতেই বেশি ব্যস্ত
হয়ে পড়েছেন। এই আচরণের মধ্যে দিয়ে কবি কিন্তু সম্মানিত হচ্ছেন না।
কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ
থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে জানতে চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে
আপনি কতটা আশাবাদী?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যত নিয়ে আমার ধারণা খুবই ইতিবাচক। “কবিতা উৎসব”-এর দিকেই
তাকিয়ে দেখুন না, প্রতি মাসে এখানে কত
কবিরা কবিতা পাঠান। দিনের পর দিন এর জনপ্রিয়তা কোথায় গিয়ে পৌঁছে গেছে। অনেক নতুন
নতুন কবিরা লিখতে আসছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ সম্ভাবনাময়। তবে পাশাপাশি নবীন
প্রজন্মের কবিরা যেন এটাও মনে রাখেন যে, কবিতা ছাপানোর জন্য তাঁরা কোথাও কোনো আপোষ করবেন না। প্রতিষ্ঠানের কাছে মাথা
নত করলে তাদের অনেক কিছুই শেষ হয়ে যাবে।
সবশেষে “কবিতা উৎসব”-এর
উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত সকল মানুষকে আমার তরফ থেকে
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। সবাই ভালো থাকুক। সবাই ভালো রাখুক।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ---- হুগলী জেলার ধনিয়াখালি গ্রামে জন্ম। ১৯৬৭ সালের ২
জানুয়ারি। ১৯৯০ সাল থেকে চুঁচুড়াতে বসবাস শুরু। পেশা গৃহশিক্ষকতা। যতক্ষণ চোখ খোলা
থাকে ততক্ষণ কবিতা দেখতেই উনি পছন্দ করেন। কবিতাই তাঁর সবকিছু। দুপুরের প্রতি এক
অমোঘ টান । ভরা গ্রীষ্মে কোনো নির্জন স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা একা বসে থাকতে পছন্দ
করেন। কথা শুনতে ভালোবাসেন, বলতে নয়।
আমৃত্যু সুন্দরের মুখোমুখি বসে থাকার স্বপ্ন দেখেন। আরও এক স্বপ্ন তাঁকে তাড়িয়ে
ফেরে,
এক নির্জন দুপুরে নির্জন পথ ধরে একা হেঁটে দিগন্তে ভেসে
যাবেন,
আর কোনোদিন ফিরবেন না। কারও ওপর তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। কারো
কাছ থেকে তিনি কিছু প্রত্যাশাও করেন না।