রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৮

শাহরিয়ার রুবাইয়াত


শাহরিয়ার রুবাইয়াত

উত্তর আখ্যান
        
এমন অনেক কথাই হয়তো থাকে
ধূসর সন্ধ্যায় স্তব্ধ স্বরলিপিরা পার হয়
সুদূর প্রান্তর
কিন্ত সময় বুঝতে পারে না
কতটা গভীর ক্ষত হয়ে পুড়ে যাচ্ছে বিষণ্ন কান্নার ধূপ
উত্তরের আকাশে মলিন শব্দেরা
অন্বেষণ করে অনুর্বর আত্মার খোঁজ

কোন এক কর্মহীন অবকাশে
মুহুর্তগুলি একীভূত হয় এক বিন্দুতে
অচেনা ট্রামের জানালায় ঝুঁকে থাকে নগ্ন দীর্ঘশ্বাস
তৃষ্ণার্ত অন্তরীক্ষে
একাকী বিপন্ন বেদনার মহাকাল
জলের আগুনে উপশমিত হয়
ঋতুমতীর ঋত্বিক যজ্ঞের ভালবাসা

কতটা আগুনে পুড়লে ব্রাহ্মণী মেঘ
ঝরে পরে অনঙ্গ অলাকানন্দে
দাউদাউ নীল ব্যাকুলতায়
স্মৃতিরা হারিয়ে যায় উজ্জয়িনীর মেঠো পথে
ভালবাসলে জলধির প্রসূনে
অবতরণের তাগিদ চলে না
নত হতে হয় প্রণয়ীর অনুরাগে

সজ্জিত আঁখির অকারন উপকথায়
ব্যথিত হয়েছে আস্থার অন্তর
অতীতের সব স্মৃতি
গুমোট জোয়ারে ভেসে যায় অখন্ডে অবলীলায়
মেঘে মেঘে মন্দিরে হানা দেয় তান্ত্রিক
পুরোনো দিন আর ফেরে না
সামীপ্য প্রান্তরে চলে সূর্যাস্তের অক্ষখেলা

লোহিত সকালের চৌপদী অভিমান
ডানা ঝাপটায় স্তব্ধ সন্ধ্যায়
ভুলে যাওয়া সময়ের প্রায়শ্চিত্তে
ক্ষত হয় নিঃস্ব তিন্তিলীর ফলক
মাটির গভীরে
নিমীলিত হয় অপরাহ্নের সমর্পিত যুগল নয়ন
অস্ফুট কমলের কুণ্ঠিত জলে






স্বপ্নলোকের উজ্জয়িনীপুর

সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল
অশ্বথের পাতা ছুঁয়ে জল ঝরেছিল তোমার আঙিনায়
বুকের মধ্যে জমানো কষ্টগুলো
অর্পণ করেছিলে আমার মালঞ্চে
জামার আস্তিনে ভেজা স্বেদবিন্দুতে
তুমি লিখে দিয়েছিলে শিশিরকণা

তোমাদের তালপুকুরে সহস্র পদ্মের গায়ে
গচ্ছিত রেখেছি অজস্র বলাকা
ভালবাসারা সবুজ হয়ে আশ্রয় করেছে বকুলের শাখে
অভিমানের মেঘ অভিযাত্রী হয়েছে আকাশের নীলে
তুমি দুরত্বকেই আগলে রেখেছো
অগুন্তি বছর এভাবেই কাটাবে বলে

কেওড়ার ভিটেয় চড়ুই পাখিরা উড়েছে
উদাসীন প্রেমিকের মত
নববর্ষার জলে তুমি কাটিয়েছো কোজাগরী রাত
তুমিই এমন চেয়েছিলে
বিষণ্ন স্বত্ত্বায় পুড়িয়ে দিতে লোবানের চোখ
যেন আর দেখতে না হয় ঈষৎ স্মিত সুখ

তোমার গোলাপী আঙুলে
নৈঃশব্দের কুয়াশারা শিউলি ঝরিয়েছে
অপরাহ্নের গোধূলিতে নিরুদ্দেশ হয়েছে নিমফুল
আমি কথা রেখেছি গুটিয়ে নিয়েছি হৃৎকমল
পথে পথে এখন শুধুই যন্ত্রণায় বিমূঢ় গান
তোমার স্বপ্নলোকের উজ্জয়িনীপুরে







প্রণয়ী

মেঘে মেঘে কতটা পথ তুমি যেতে পারো
সে দূরত্বের কথা জানা হয়নি এখনো
স্বপ্নের তরণীতে হাওয়ায় ভেসে ভেসে রাত্রিদিন
তোমার চঞ্চল মেঘমালা অতিক্রমের গল্প
শুনতে চেয়েছি নিরন্তর
কাঠবাদামের ছায়ায় বসে বসে
শব্দহীন সঙ্গীত গোধূলির লগ্ন পেরিয়েছে
শান বাঁধানো ঘাটের কোলে
গোলাপী পদ্মরা আছড়ে পড়েছে বারংবার
তবুও তুমি জানাওনি তোমার পথের খবর।

তোমার ঘর্মাক্ত কপালের নোনা স্বেদবিন্দুতে
সীমাহীন রাত্রিরা কোরাস ধরেছে কত
শেষ রাত্তিরের আকাশে
কুয়াশারা আলো ফুটিয়েছে দেদার
রৌদ্রের শৃঙ্খল ভেঙে
দিনান্তের সূর্য ডুবেছে প্রহেলিকায়
ঘুটঘুটে আঁধারেরা ছুটেছে দিগ্বিদিক
যেন উড়ে যাওয়া মেঘে জল ঝরে উদাসীন
মারিজুয়ানার অস্ফুট প্রলাপেও তুমি
মর্মরিত মহলের নিস্তব্ধ অন্ধকার কাটাতে পারোনি।

ছায়ার আড়ালে তোমার চোখেরা লুকিয়েছে
স্নান ঘরের অবরূদ্ধ সন্তরনে
তুমি উড়িয়েছো ক্লেদাক্ত বাষ্প
ঘুমহীন বিছানায় আরাধিত করেছো
গভীর একাকী স্বপ্নের
নির্জন ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে থাকা নিশাচরী
তোমার রক্তের স্বাদ নিয়েছে অবিরাম
তুমি এইসব নিয়েই বেশ ভাল আছো
অথচ এ পাড়ায় নক্ষত্র তার আলো নিয়ে
তোমার জন্য ভালবাসার মিছিলে যাবার প্রত্যয়ে অগ্রসর।






ধ্রুবস্মিতা

কবিতার শহরে ফিরে এলাম
হলুদ কংক্রিটের উজ্জ্বল নক্ষত্রের নিঃশ্বাসে
তোমার অনন্ত সান্নিধ্যে ধ্রুবস্মিতা...

ইতোমধ্যে তুমি অবশ্য
কলাপাতায় মুড়ে নিয়েছো আমায়
ফেলে দিতে অন্ধকারের নির্জনে
অথবা ফেলে দিয়েছো
শীতরাতে কুয়াশায় নিশ্চল সমুদ্রে...

কিভাবে রোজ রাতে বাড়ি ফিরেছি
যদি তুমি জানতে
হতাশায় নিমজ্জিত আশ্রিত মাস্তুলের ডগা ধরে
প্রহেলিকার মত করে
নিমগ্ন মন্থনে জলের আস্তিনে...

তোমাকে ছুঁতে পারিনি বলেই
আমার আকাঙ্খার বাগানে স্বপ্ন ফুটে আছে অনাবিল
ভালবাসার নিঃশ্বাসে মাখা
অজস্র শব্দেরা উড়ছে অন্তেঃ বাতাসে
বিকশিত প্রতিক্ষার সোপানে...

তোমায় প্রকাশিতে ফিরে এলাম
কবিতার শহরের অনন্ত সান্নিধ্যে ধ্রুবস্মিতা।






প্রেম

সাত সকালের ঘুমভাঙা চোখে
তাকে যখন প্রথমবার দেখেছিলাম
সে তখন কুন্দের শুভ্রবনে
বিহঙ্গের কটি ধরে
উড়তে চাইছিল
নিবিড় চকচকে
আনন্দিত দু'চোখ মেলে
ঘাস ফড়িঙের অনাবিল হলুদ পাখায়।

সেই থেকে সে
কত শতবার আমায় শুনিয়েছে জলের গান
যে গানে গঙ্গা থামিয়ে দিত তার প্রবাহ
মেঘ এসে দাড়িয়ে যেত মাথার উপর
পথ ভুলে যেত তার মেঠো কথা
কেবল তার ধ্রুপদ ধ্বনিতেই
মুগ্ধ থাকত সবাই।

তার চোখে মুখে বুকে ছিল
নদীর মত শিল্পিত মন
দু'হাতের লাল নীল সবুজ আঙুলে
সে আকাশ আঁকত
মেঘ আঁকত
বাতাস আঁকত
সুখ আঁকত
জাফরান রঙের চুলের বিনুনিতে
সে আমায় আঁকত অহর্নিশ।

একদিন জ্যোৎস্না রাতে
চাঁদের রূপালী আলোয়
সে আমার হাত ধরেছিল
চোখের ভাষা বুঝে নিতে
একদিন ঘুটঘুটে আঁধারে
সে আমার কাছে এসেছিল
অন্ধকার চিনে নিতে
একদিন আলো আঁধারের
কোন এক মাতাল হওয়া ক্ষণে
সে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল
আমাকে জেনে নিতে।

আমি তার মনের
সবটুকু নিতে পেরেছিলাম
কিন্তু দিতে পারিনি এতটুকুও
আর মুখে কিছুই বলিনি কোনদিন
বলতে পারিনি
বলা না বলার দ্বৈত দুলুনিতে
কেবল আন্দোলিত হয়েছি
অজস্র অসংখ্যবার।

আজ বাতাসে
গা ভাসিয়ে দিতে মন চাইছে
স্রোতের মত করে
কারন সে এসেছে আমার ঘরে
আজ ভেঙে পড়া জ্যোৎস্নার আবেশে
প্রজাপতি হতে মন চাইছে
কারন সে উড়ছে আমার হৃদয়ে
আজ বড্ড ইচ্ছে করছে বলতে-
'তোমায় ভালবাসি'
চুপি চুপি কানে কানে গোপনে।