সম্পাদকের কলমে
খরায়
মাটি ফেটে পড়ছে
আর আমি
হাঁটছি রক্তপায়ে
যদি দু
একটা বীজ ভিজে ওঠে
হাঃ হাঃ
যদি দু একটা…..
_অরুণ
মিত্র
সময়ের তির্যক প্রতিবিম্বের ছায়াপাতে নিজেকে বড়োই আড়স্ট
লাগে সময় সময়। বিশেষ করে যদি সেই প্রতিবিম্বে ফুটে উঠতে থাকে নিজেরই অসতর্ক মুহুর্তের
কিছু কিছু ছবি। না জীবনানন্দের মতো নিজের মুদ্রাদোষে আজ আর কেউই আলাদা হতে থাকেন
না। আমরা সকলেই সকলের যথার্থ প্রতিবিম্ব আজ। বলা যেতে পারে এটাও একটা অর্জন।
অর্জিত সাম্য। অর্থনৈতিক সাম্য আসেনি। কিন্তু নাগরিক চেতনার একটা সমন্বয় হয়ে
গিয়েছে যেন আমাদের শিক্ষিত নাগরিক জীবনের প্রতিদিনের অভিমুখে। যেখানে আর নিজের
মুদ্রাদোষে নিজেকে আলাদা করে বের করে আনা যায় না। যায় না বলেই সকল মোমবাতি মিছিলে
মুখ ঢেকে যায় সকলেরই মসৃণ ভাবে। ভিড়ের মধ্যেই নিরাপত্তা বেশি। নিরাপদ সেই আশ্রয়ই
নাগরিক জীবনের অন্যতম প্রকৃতি।
ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় হয়তো এটাই নিয়তি আমাদের। হয়তো
এটাই প্রতিটি যুগেরই সাধারণ যুগধর্মও বটে। মনে হয় এইভাবেই এগোতে
থাকে সমাজ সংস্কৃতি মানবিক প্রত্যয়। সমাজের জ্যাঠামশাইরা যাকে অভিজ্ঞতার অর্জন
বলেই সমাদর করে থাকেন। আবার সেই চলটাই হয়তো উদ্ধত তারুণ্যর বুকে অচলায়তনের শেল হয়ে
বিঁধতে পারে। কবি যে কারণে এক শতাব্দী আগেই সেই উদ্ধত তারুণ্যকেই বরণ করতে ডাক
দিয়ে বলেছিলেন ‘আধমড়াদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। কিন্তু আমরা, কবির কথামত সেই আধমড়ারা
যারা অভিজ্ঞতার আলোতেই নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিয়ে নোঙর ফেলে দিই যেখানে সুযোগ
সেখানেই আর যেদিকে সুবিধে সেদিকেই! তাতে হয়তো রোজকার রাতের ঘুমটা মনোমতো হয়।
কিন্তু সেই পথেই যে রাত নামতে থাকতে আমাদেরই ফাঁকিবাজিতে, স্মরণে থাকে কি আর সে
কথা। প্রতিদিনের নিজস্ব নিরুপদ্রব জীবনে?
থাকে না নিশ্চয়ই। থাকলে অস্থির হয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে হতো
হয়তো। কিন্তু যে কথা বলছিলাম শুরুতেই, মাঝে মাঝে যেন সেটাই ঘটে যায়। আর বড়োই আড়ষ্ট
লাগে তখনই। কবি অরুণ মিত্রের যে লাইন কয়টি মাথার ভিতর ঘা মারতেই এত কথার অবতারণা,
কবিতার সেইখানে গিয়ে পৌঁছাতেই হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরল কিছুক্ষণের জন্য। অপারেশন
টেবিলে অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর ডাক্তারের ডাকে যেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন আলোআঁধারিতেও
সম্বিত ফিরে আসে রুগীর। কিছুক্ষণের জন্য।
সত্যইই আমাদের কবিতা লেখা, সাহিত্যচর্চার রোজকার দিগন্তে
ঠিক কোনদিকে এগোচ্ছি আমরা? আমাদের শব্দ চয়ন বাক্যবিন্যাস রূপকল্পে ছুঁতে পারছি তো
এই সময়কে। এই সময়ের ব্যাপ্তিকে? তার অসুখ আর যন্ত্রণাকে? সমস্যা আর সম্ভাবনাকে?
যদি পারি তবে তো ভালোই। কিন্তু যদি নাই পেরে থাকি? যদি কাব্যসংকলন প্রকাশের
আনুষ্ঠানিকতার সামাজিক বিন্যাসের প্রথমসারিতে পৌঁছানোই আমাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্য হয়ে
দাঁড়িয়ে যায়? তাহলে যে, ফাঁকিবাজিরই এক অমোঘ রাত নামিয়ে আনতে থাকবো আমরাই, স্মরণে
আছে তো?
আমাদের এই সময়ের দিকে টেলিস্কোপ তাক করলে রাতের
নিরুপদ্রব ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না তো? আমাদের কবিতা আমাদের সাহিত্যচর্চা আমাদের
কাব্যসংকলন প্রকাশের আনুষ্ঠানিক জাঁকজমক দেখে দেখে মনে হয় যেন প্রায় সব পেয়েছির দেশেই
পৌঁছিয়ে গিয়েছি আমরা আজ। এসো দু একটি কবিতা লেখা যাক এবার। সত্যই কি মনে হয় না, সময়
বদলিয়ে গিয়েছে আজ অনেক অনেকটাই। আমাকে
আমার মতো থাকতে দাও বলে নিজেরটা নিজে গুছিয়ে নিতে থাকার এই জনসম্মোহিনী ব্যস্ততার
কালে; আজ যেন কবি অরুণ মিত্রদের সেদিনের বলিষ্ঠ উচ্চারণগুলি আজ আর সজীব তরুণ নাই
ততটা।
অবশ্যই আজকের বাণী আজকেরই হবে। সেটাই দর। কিন্তু সেই
বাণীতে যে সময়কে ধরছেন আজকের নাম যশ প্রার্থী কবিকুল, সময়ের সেই ছবির বাইরে অনেকটা
সময়ই অধরা পড়ে থাকছে না তো? ঠিক এই প্রশ্নটাই বেশ কিছুদিন যাবত যেন ঘুরপাক খাচ্ছে
মাথার ভিতর। খুরপাক খাওয়ার কারণও আছে। মাসিক কবিতাউৎসব প্রকাশের কর্মকাণ্ডের সাথে
জড়িত থাকার সুবাদে এই সময়ের লেখা ও লেখনীর উৎসবকে কিছুটা পরিমাণে কাছ থেকেই
প্রত্যক্ষ করার একটা অভিজ্ঞতা তো সঞ্চয় হতেই পারে। খুব একটা সুখকর পরিতৃপ্তির বড়ো
কোন পরিসর কি খুঁজে পাচ্ছি? সময়ের অভিজ্ঞতার সাথে কবিতার এই উৎসবের প্রতিচ্ছিবির
কোথায় যেন একটা গরমিলের ছবিই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আজকাল। জানি না এই একই ধরনের আশঙ্কার
শরিক কজন সম্পাদক হবেন। হচ্ছেন। তবু যেন শঙ্কাটা খচখচ করেই চলেছে। বড়ো বেশি ফিলগুড
ছবির সমারোহ আজ যেন কাব্যচর্চার চতুর্দিকে। বড়ো বেশি ঝাঁ ঝকঝকে সেল্ফির ফ্রেমে
বন্দি হয়ে পড়ছে না তো শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলি?
সঠিক জানি না। কিন্তু সময়ের খরায় তৃষ্ণার্ত
যাদের সময় তাদের চোখে চোখ রাখলে হিসাব মেলাতে কষ্টই তো হয়। হচ্ছে। চারিদিকে একটা
লুঠের মেলা চলছে অবিরাম। সেই লুঠের মেলায় অনেক অংশীদার। তার থেকেও বেশি
প্রসাদভোগীর সংখ্যা। কিন্তু সব সংখ্যাকেই ছাপিয়ে উঠেছে লুন্ঠিত মুখের স্তম্ভিত
হতবাক মুখচ্ছবিগুলি। সেই ছবির ভাষাকে কতটা ধরতে পারছি আমরা আমাদের শব্দ চয়ন
বাক্যবিন্যাস রূপকল্পে? তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন, কতটা ধরতে চাইছি আদৌ? চাইছে আজকের
নাগরিক সমাজ। কবি তো সেই সমাজের বাইরের কেউই নন। তাই কবিও যদি নিজের মুদ্রাদোষে
আলাদা না হতে পারেন সময় মতো তবে কিন্তু বাংলা কাব্যচর্চার দিগন্তে অনেক বড়ো তীব্র
খরার পদধ্বনি শোনা যাবে অচিরেই। মূল শঙ্কা ঠিক এইখানেই। আর তখন ‘খরায় মাটি ফেটে পড়ছে আর আমি হাঁটছি রক্তপায়ে যদি
দু একটা বীজ ভিজে ওঠে’ –না সেরকম কোন রক্তপায়ের খোঁজও পাওয়া যাবে না বাংলার
কাব্যচর্চার দিগন্তে।
খুবই
ইচ্ছে হয়, অমূলক হোক এইসব শঙ্কা আশঙ্কা। বরং শতশত রক্তপায়ের ছাপে ভিজে উঠতে থাকুক
বীজক্ষেত। সেই স্বপ্ন নিয়েই তো কবিতার সাথে ঘরবাড়ি। সেখানেই উৎসব শুরুর ডাক দিতেই
মাসিক কবিতাউৎসবের এবারেরও আয়োজন। দেখা যাক এসময়ের লেখনী কতটা অব্যর্থ ভাবে ধরতে
পারছে এই সময় সঙ্গতিকে মহাকালের ক্যানভাসে।