মৌলী বনিক
ধস
ওহে উদ্ভ্রান্ত ! দাঁড়াও। কোথায়
চলেছ দিগ্বিদিগ-জ্ঞান হারা?
কিসের নেশায় ছুটছো ঊর্দ্ধশ্বাসে? কিসের
ঘোরে? কেন এত তাড়া?
জীবনসিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে পৌঁছাবে
পরিতৃপ্তির শিখরচূড়ায়?
কিন্তু শেষ ধাপে আছে কি সাফল্য? প্রাচুর্য
সুখ দুয়ার গোড়ায়?
সুখস্বপ্নরা মাধবীলতা-চারা। কত
যত্নে লালিত করেছ অন্তরে,
ওরা পল্লবিত মুকুলিত পুষ্পিত হয়ে
বাগান ভরেছে থরে থরে।
সত্যকে কবর দেবে বুঝি? তার
উপরে ফুটবে মাধবীলতার চারা,
মিথ্যের পাহাড় আড়ালে জানি লুকোচুরি
ছলচাতুরী সন্তর্পনে সারা।
সিঁড়িভাঙা নেশা মারাত্মক তীব্র অথচ
একটু অসতর্ক হলেই অনিবার্য পতন।
খুব সাবধান! পাহাড়গুলোয় একেক সময়
ধস নামে- ল্যান্ডস্লাইডের মতন।
দেওয়াল
ইটের পর ইট সাজিয়ে ক্রমাগত উচ্চতর
করে
গড়ে তুলেছি যে দেওয়ালটা,
ওর নাম আসলে অহং অভিমান।
বেশ মজবুত করে গাঁথুনি দেওয়া।
ও হাসে, শুধায়-
'তোমার বন্ধু কে?'
ওর পিঠে হেলান দিয়ে বসি আয়েস করে-
দাম্ভিক রণজয়ের ভঙ্গীতে বলি, 'কেউ না'।
ও আবার হাসে,- 'ভুল বললে।
তোমার বন্ধু দী্র্ঘশ্বাস।'
দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বয়ে
যায়।
মৃদু হেসে ও আবার বলে,
' আমার শূন্যতা তলহীন অতল।
তোমারও কি তাই? '
অনর্থক অতি উচ্চগ্রামে বলি-
' তুমিও ভুল বললে।
আমার জীবন পরিপূর্ণ, কোথাও
নেই ফাঁক।
বর্ষার নদীর মত কানায় কানায় ভরা।'
ও উচ্চ অট্টহাসি হাসে-
সঙ্গে সঙ্গে দশদিক থেকে
প্রতিধ্বনিরাও ছুটে আসে,
উচ্চতর ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে-
' মিছে কথা, মিছে কথা।'
প্রতিধ্বনিরা একসময় মিলিয়ে গিয়ে
দশদিক স্তব্ধ হয়ে যায়।
স্তব্ধতা ভেঙে দেওয়াল আবার বলে,
' কেউ পারেনি আমায় লঙ্ঘন
করে যেতে।
ওরা সব দূরের পথ দিয়ে যায়-
ডাকলেও আসেনা কাছে। ওদের হাসির
শব্দ
বাতাসে ভেসে আসে, কিন্তু
ওরা পারেনা
দেওয়াল টপকে ভিতরে আসতে।
ঐ দেখো দূরে রঙীন বাগান,
কত ফুলে ফুলে ভরা-
তোমার যে সাজি আছে, চলো
ফুল নিয়ে আসি-
সেই সাজি ভরে।
এখুনি ভেঙে ফেল ইটের গাঁথনি-
দেওয়াল টপকে এবার বাইরে চল যাই।'
সহায়
মানুুষ আজ বড় বিপন্ন -
বন্ধু, মানুষ
হয়ে, প্র্রসারিত কর হাত মানুষের জন্য।
মানুষ পাঁজর নিংড়ে দিবারাত্র ফেলছে
দীর্ঘশ্বাস
বন্ধু দেখো, সে
দীর্ঘশ্বাস যেন কখনো হয়না হতশ্বাস।
মানুষ কাঁদছে, তার
দু'চোখে ভীষণ ত্রাস
বন্ধু দেখো, সে
যেন মানুষের প্রতি হারায় না বিশ্বাস ।
মানুষ ভুলেছে নির্ভয়ে মাথা উঁচু
করে চলতে
বন্ধুু দেখো, অবজ্ঞায়
কেউ তাকে না যেন পারে দলতে।
মানুষ মানুষকে করছে নিত্য প্রতারণা
বন্ধু দেখো, তার
অধিকারে যেন ফাঁঁকি থাকেনা এককণা।
মানুষ হয়েছে আজ উদ্বাস্তু তার
আদর্শ হতে
বন্ধু দেখো,হৃদয়ের
স্বপ্ন হতে সে যেন উদ্বাস্তু হয়না কোনমতে।
মানুষ আজ বড় বিপন্ন -
বন্ধু, মানুষ
হয়ে, প্রসারিত কর হাত মানুষের জন্য।
সত্য স্বাধীনতা
শ্রাবণধারা, তোমার
ধারাপাত অবিরাম অবিশ্রাম জানি,
কিন্তু তুমি একবার শুধু ঝরো, একটি
শান্তিময় পৃথিবীর জন্য।
ধুয়ে দিয়ে যাও সভ্যতার ইতিহাসের
রক্তাক্ত প্রচ্ছদ-
মুছে দিয়ে যাও পৃথিবীর ইতিহাসের যত
বিভেদের মানচিত্র-
উড়িয়ে নিয়ে যাও ঝড়ো হাওয়ায় বারুদের
কটু গন্ধময় বাতাস-
নিষ্ক্রিয় করে দাও তোমার প্লাবনজলে
যাবতীয় মাইন বোমা বারুদ।
শুধু তুমি একবার ঝরো একটি শান্তিময়
পৃথিবীর জন্য-
যে পৃথিবীর দু'চোখে
আঁকা শুধু অনাবিল খুশী আর স্বপ্ন,
যে পৃথিবীর উপর থাকবে নিরাপদ
নির্ভরযোগ্য একটি ছাত।
সে'ছাতে উড়াব সাদা
পতাকা অনন্ত নীলাকাশের উদ্দেশ্যে-
আমরা গাইব গর্বিত খুশীর গান- সেই
আমাদের সত্য স্বাধীনতা।
সত্যের বেদীমূলে চেতনের
আলোকবর্তিকা জ্বেলে
আজ লক্ষ আদম সন্তান উপলব্ধিতে
জানুক ও শিখুক-
রক্তাক্ত সংগ্রামে অর্জিত
স্বাধীনতাই আমাদের শেষ লক্ষ্য নয়,
সসম্মানে তার সুরক্ষা-কবচ হওয়ার
যোগ্যতাই শেষ প্রার্থনীয়।
আজ এই সব-হারানোর অন্তিমলগ্নে, এসো
সমবেত প্রার্থনায়-
একটি প্রকৃত স্বাধীনতার আহ্বানে
উচ্চারণ করি পুণ্যশ্লোক
শুধু অনাবিল মৈত্রী ও ক্ষমার
অনন্তগাঁথায় গাঁথা পুণ্যশ্লোক।
দেবীত্বহীনা
শোন মুগ্ধ প্রেমিক কবি! তোমার
কলমের আঁচড়ে
স্থান দিও না দেবীত্বের সিংহাসনে-
দেবীর চেয়ে কিছু কম দেবীত্ব চাই।
ছুটী দাও।
স্থান চাই আজ মাটীর মানুষের মনে।
মনে মনে সংগোপনে সাধ জাগে এক
সাধারণী হতে
পুকুরঘাটে ব্যস্ত ভারী গেরস্থালী
কাজে;
মোহের সিংহাসন হতে দু'ধাপ
নেমে বসব জলের ঘাটে
আরামের বিরামটুকুও স্পর্শ পাবে না
যে।
শুনেছ আমার অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস? দেখো
উপোসী পাংশু চোখ
অতৃপ্তির চরা জেগে থাকে; ভাসাওনি
যে দু'কুলহারা প্লাবনে।
বিশীর্ণ হাতে দেবীত্বের মুকুটভার
খুলে ছুঁতে চাই পরিতৃপ্তি-
দেখেছি তো স্বর্গ বেশী দূর নয়-
যখনই খুঁজেছি মনে মনে।