সম্পাদকের কলমে
নববর্ষ ১৪২৫। আবারও আরও একটি নতুন বর্ষ। নতুন সময় সরণী।
প্রকৃতির দিগন্তে চৈত্রের অবসানে বৈশাখী আমন্ত্রণ। নতুন দিনের নব জীবনের নতুন আশা
আনন্দের ডালি হাতে নিয়ে এসেছে কি বৈশাখ?। আসারই কথা
যদিও। আমাদের বাংলায় বৈশাখ মানেই নতুন কিছু। নতুন একটি বছর। পুরানো কষ্ট ব্যাথা
হাহুতাশ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন উদ্যোমে সমস্ত কিছু নতুন ভাবে শুরু করারই যেন এক মস্ত
আশ্বাস এই বৈশাখ। তাই বৈশাখ মানেই নববর্ষ। বৈশাখ মানেই নতুন দিনের ডাক। বৈশাখ
মানেই আশা ভরসা আশ্বাসের এক ত্রিবেণীসঙ্গম। বৈশাখের এই নবজীবনের আমন্ত্রণ বাঙালির
ঘরে ঘরে। আর সেই আমন্ত্রণেই নববর্ষের উৎসব আমাদের এই সবুজ শ্যামল বাংলায়।
কাঁটাতারের দুই পারেই। মহাকালের রথের চাকা খুব ধীর গতিতেই এগিয়ে চলে। তাই সাধারণ
দৃষ্টিতে আগের বছরের সাথে নতুন বছরের খুব একটা বেশি ফারাক চোখে পড়ে না আমাদের।
কিন্তু এইভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের সমাজ সভ্যতা কেবলই নিজেকে নতুন থেকে
নতুনতর করে নেয়। তাই প্রতিটি নতুন বছরই বিশেষ মূল্যবাণ মহাকালের প্রেক্ষিতে। আর
আমাদের ব্যক্তিগত জীবন প্রবাহ সেই একই সূত্রে সম্পর্কিত। হয়তো সেই কারণেই নববর্ষের
আনন্দ উচ্ছ্বাস আমাদের মধ্যে এত প্রবল।
কিন্তু না এসবই তত্ব কথা। এমন নয় যে এ বাস্তব সত্য় নয়।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনসীমানায় যে যখন যতটুকু ভালো থাকি, থাকতে পারি, ততটুকুরই বাস্তব চিত্র অনেকটা এমনই। কিন্তু এই চিত্রের
বাইরেও আমাদের একটি সামাজিক জীবনসীমানা রয়ে গিয়েছে। যেখানে অধিকাংশ ঘটনা প্রবাহই
আমাদের ব্যক্তিগত আমি’র নিয়ন্ত্রনাধীন নয়। যেখানে প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথের মতোই
সমাজিক পরিস্থিতিগুলি সাথে ক্রমাগত আপোষ করে নিয়ে চলতে হয় আমাদের। বছর আসে বছর
যায়, কিন্তু এই যে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো আপোষ করে চলার ধারাবাহিক প্রবণতা, তার
বিশেষ কোন বদল ঘটে না। আমাদের ব্যক্তিগত এবং সমাজিক জীবনে। কারণ আমরা সমাজের
অন্তর্গত। কিন্তু সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার এক্তিয়ার বা শক্তি কোনটাই আমাদের
আয়ত্তাধীন নয়। সাধারণ মানুষের জীবনের এই এক অমোঘ পরিণতি। এক মর্মান্তিক সত্য।
আর সেই সত্যের মধ্যেই আমাদের নিরন্তর প্রয়াস, নিজের মতো করে
নিজের চৌহদ্দির মধ্যেই নিজের মতো করে ভালো থাকার। কিন্তু সমাজের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে
এইভাবে চোখকান বন্ধ করে রেখে, নিজের মতো করেই কি ভালো থাকা যায়। সবসময়ে? নিশ্চয়ই
যায় না। কেউ কেউ পারলেও অনেকের পক্ষেই তেমন অসামাজিক ভালো থাকা সম্ভবও হয় না। তাই
প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন সীমানায় দাঁড়িয়েও আমরা আমাদের সামাজিক পরিস্থিতির বেশি
ভালো থাকতে আসলেই কি পারি? পারা কি সম্ভব? এখন প্রশ্ন উঠবে কেমন আছে আমাদের সেই
সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি? যার অমোঘ প্রভাবের বাইরে আমরা প্রায় কেউই নই? একটি
বছরকে বিদায় জানিয়ে এই যে আরও একটি নতুন বছর চলে এলো আমাদের সকলের জীবনে, কতটুকু
তার নতুনত্ব? কতটুকুই বা তার পার্থক্য পূর্ববর্তী বছরের থেকে?
ঠিক এই প্রশ্নের সামনেই যদি আমরা দাঁড় করিয়ে দিই নিজেকেই
নিজে? কি দেখতে পাবো? এটা ঠিক যে, এক একজনের দেখার দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্যই আলাদা। সেখানেই
মানুষের সভ্যতার বড়ো বৈচিত্র। না হলে জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির সাথে আমাদের
বিশেষ পার্থক্য থাকতো না নিশ্চয়। কিন্তু দেখার দৃষ্টিভঙ্গীর সহস্র রকমের পার্থক্য
বা অনন্যতা থাকলেও, আমাদের পরিপার্শ্বের সমাজবস্তবতাটি কিন্তু সকলের সাথে সকলের
ক্ষেত্রেই একই রকমের আঞ্চলিক। অর্থাৎ সেই বাস্তব সত্য়গুলি আমাদের সকলের জন্যেই এক।
আর সেই সমাজবাস্তবতায় নতুন কোন আশার বাণী, ভরসার বরাভয় কি আনতে পারছে ১৪২৫?
পেরেছিল কি পূর্ববর্তী ১৪২৪ পূর্বতর ১৪২৩ এর থেকে? না। চরম সত্যটা আমরা সকলেই
জানি। পরিবর্তন একটা ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনে আশার বাণী কতটা নিরুত্তর আর
কতটা অসত্য সেই তথ্যও কি আমাদের অজানা? তাও তো নয়। দিনে দিনে ভরসার বরাভয় যে
ক্রমেই পিছু হটে যাচ্ছে আমাদের হাতের নাগালের বাইরে, প্রতিদেনের সংবাদ প্রবাহের
ধারাবাহিক চিত্রবিবরণীতে সেটিও কি পরিষ্কার নয় আমাদের চোখে? অবশ্যই সবাই দেখতে
পাচ্ছে সবকিছুই। কিন্তু ঐ যে বললাম, ব্যাক্তির জীবনসীমানার বাইরে আমাদের সামাজিক
জীবনসীমানায় আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের
কাছে এক একজন ঠুঁটো জগন্নাথ। না আছে সামর্থ্য, না আছে প্রত্যয়। না আছে অধিকার না
আছে অর্জন। কি করে আমরা অক্ষর জোগাবো নিরুত্তর আশার বাণীতে? কি করে প্রত্যয় জোগাবো
ক্রমাগত পিছু হটে যেতে থাকা ভরসার বরাভয়ে?
না সেই শক্তি ও সামর্থ্য, অধিকার ও অর্জন, বিশ্বাস ও প্রত্যয় আমদের কিছুই নাই। আর নাই
বলেই আজকের সামাজিক পরিস্থিতিতে আমরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে বসে আছি। আর
সেখান থেকেই জন্ম হচ্ছে আমাদের নিজস্ব কবিতার। শব্দের চর্চার মধ্যে নিজেকে ব্যর্থ
প্রবোধ দেওয়ার একান্ত মরিয় প্রচেষ্টা। কেউ সজ্ঞানে, কেউ অজ্ঞানে। হ্যাঁ এই বৈশাখের
কবিতাউৎসবের আয়োজনের মধ্যেও সেই প্রয়াসেরই উদ্ভাসন। তবে কি কবিতা লেখা আসলেই পলায়ন
বৃত্তিরই নামান্তর? সামাজিক পরিস্থিতিকে মুখোমুখি মোকাবিলা করার থেকে?
সত্যি করে বলতে কি, কবিতা লিখি বা না লিখি, আজকের সামাজিক
পরিবেশ পরিস্থিতি পরিণতির সাথে মুখোমুখি মোকাবিলা করার সাধ সাধ্য সাধনা আমাদের
কারুরই নাই। আর নাই বলেই রোজকার প্রভাতী সংবাদপত্র হাতে নিয়ে নির্বিকার চিত্তে
নিজের আখের গোছানোই আমাদের ব্য়ক্তি পরিসরে অত্যন্ত স্বাভাবিক সত্য়। কথায় বলে আপনি
বাঁচলে বাপের নাম। আর আমাদের স্বদেশ স্বজাতি সমাজ যদি আসলেই পিতা বা মাতা হয়, তো
কথাই নাই। আগে তো নিজে ভালো থাকি। বাকি সব কিছুই পরে। তাই সান্ধ্য টিভির সংবাদ
চিত্রের বহরেও আমরা একই রকম স্থির অবিচল থাকতে পারি, নিজের নিজের চড়কায় তেল দিতে।
বাকি সবে পরে। বালিতে মুখ গুঁজে পরে থাকার মতো এই প্রবণতাই আমাদের ঐতিহ্য আজকের
সমাজবাস্তবতায়।
তাই নববর্ষ আসুক বা নাই আসুক, আমরা রয়ে গিয়েছে, ঠিক
সেখানেই; যেখানে আমরা ছিলাম এতদিন। ঘুরে চলেছি শুধু নিজেরই ব্যক্তি সীমানার কেন্দ্রেরই
চারিধারে। যেখানে গতকাল আর আগামীকালের মধ্যে পার্থক্য শুধুই আজ। কবিতাউৎসবও তার
ব্যতিক্রম নয়, পূর্ববর্তী মাসের মতোই আবারও বর্তমান সংখ্য়াটি নিয়ে হাজির তাই
পাঠকের দরবারে। অবশ্য নতুন নতুন কবিতার ডালি নিয়ে। এবং সাথে এমাসের অতিথি কলিকাতা
নিবাসী কবি শীলা বিশ্বাসের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আশাকরি পাঠকের মনযোগ আকর্ষণে এই
সংখ্যাটিও পূর্ববর্তী সংখ্যাটির মতোই সফল হবে। শুভ হোক সকলের নববর্ষ।