রবীন
বসু
সভ্যতা
ধুয়ো দেবে
কে যেন পেছন থেকে টেনে ধরে
সভ্যতার ঘাড়
তাকে যে শিক্ষা দেবে, তার যত
সংক্রমণ রোগ
সবই আজ জড়ো করা, ভরে ওঠে
নদীদের পাড়
সময় তাড়িয়ে আসে দৃপ্ত অশ্ব, খুরে জাগে
শোক
অরণ্যের, তপোময়
বধ্যভুমি হাতছানি দিয়ে ডাকে
অহরহ কানাকানি, সুবিস্তৃত শামিয়ানা
ভেদ করে
জাতিমুখ ধর্মমুখ বর্ণমুখ মানুষের
কঙ্কালের শোকে
সভ্যতা কেঁদেই চলে, সে ক্রন্দনে
অর্ন্তগূঢ় রক্ত ঝরে
শিরামুখে, পাললিক শিলা
চুঁইয়ে চুঁইয়ে উঠে আসে
অভিমান, বালিকা শরীর, রক্তমাখা
কাদামাখা ওই
দ্যাখো জান্তব বিকার ; তবু তুমি
প্রগতির রথ-পাশে
ধ্বজা নিয়ে দাঁড়াবে নিশ্চয়? একে বলে
পারানি-খই
ছড়াতে ছড়াতে যাবে সুমসৃণ হাত, সভ্যতা ধুয়ো
দেবে
তার যত ক্লেদরাগ অগ্নিবর্ষী
অভিশাপ অঞ্জলিতে নেবে
নদী ও মানুষ
যদিও নদীর কাছে যাওয়া-আসা সেরকম
নয়
দূর থেকে হাই-হ্যালো দায়সারা ভাব বিনিময় ;
তবুও অপেক্ষা থাকে গাঢ়তর, হয়তোবা দু'তরফেই
নিজস্ব গোপন কথা তার কানে পৌঁছে
দেওয়া চাই l
যে গুপ্ত আড়ালে থাকে তার সত্য
জেনেরাখা ভালো
সে-জানায় ভয়ও আছে, অপ্রিয় এবং
কালো ;
তাই দ্বন্দ্ব দোলাচল—যাবো কিনা
যাবো, ভাবে
নদী
কিই-বা হবে, জল হয়ে একবার
ছুঁয়ে তো দেখি l
এ-বড় সংকটকাল, সংকোচ টিপে
ধরে গলা
অনাবৃত সত্য নয় জেনেবুঝে
রেখেঢেকে বলা ;
নদীও মাথার কাছে রেখে দেয় ভাঙনের
তাস
মানুষও হিংসা রাখে করতলে, নেই ফোটা কাশ
l
ভাঙন ও হিংসা নিয়ে পরস্পর
মুখোমুখি হয়
নদী ও মানুষ আজ অন্যতর গল্পকথা
কয় l
বন্ধুত্ব-দিন
তোমার চোখের দিকে চেয়ে আছে নীল ধ্রুবতারা, হে বন্ধু
জীবন কাঁপছে দেখ, দেখ আজ ভরে
গেছে সমূহ বিনাশ,
তুমি তো বিশ্বাসভূমি, তুমি সেই অথৈ
জলের থেকে উঠে
আসা সন্তরণ, অন্ধকার ভেদ
করে জীবনের মায়া পরশ !
কী ভীষণ মন খারাপ, সারাদিন
মেঘভাঙা বিষাদের ঢেউ
ছলনা চাতুর্য আর পদেপদে অপমান
রাশি,অশালীন
এই
সময় তোমাকে বিঁধছে শুধু কাঁটাতার, সুতীক্ষ্ণ
হিংস্র কেউ
ফালাফালা করে দিচ্ছে মানুষের
বিশ্বাসকে বিবেককেই l
তবু তুমি শেষ কথা, তোমাতে ভরে
আছে সমস্ত রাত দিন
অফুরন্ত আকাশ আর অবিরাম ইচ্ছার
খুশিময় ঘরবাড়ি,
আমাদের অন্ধকার জীবনের এলোমেলো
সব মাখামাখি
তোমার বুকের কাছে এই আমি রাখিলাম
হাত বন্ধুত্বদিন l
কবিতার মুখ
কবিতা আমার পাশে বসে আছে, স্থির দৃষ্টি
আলুথালু বেশবাস,
কেন জানি আনমনা,
সমস্ত আবেগ নিয়ে খুঁজছে সে
ঐতিহ্যের বৃষ্টি
ধারাস্নানে স্নিগ্ধ হবে, আবহমান তার
জানা l
জানে না রহস্য কেন, কেন এত ভরা
জল?
অবগাহনের অতল থেকে উঠে আসে যে
ইঙ্গিত, তার পায়ে
শতাব্দীর সবুজ শৈবাল
তাকেও আচ্ছন্ন করে মনখারাপের মেঘ
যে l
কবিতা আমার পাশে বসে আছে, অন্য মুখ—
অচেনা রহস্যমাখা অস্তিত্বও
ঘেরাটোপ ঘিরে,
সে শুধু দেখেই যায়, আলপথে পড়ে
থাকে সুখ,
শব্দকে চিনে নিতে কারা যেন ঘরে
আসে ফিরে l
ফেরা তো সহজ নয়, নির্মোহ আবেশ
নিয়ে তাই
কবিতাও বলে চলে, চাই, শিকড়ের
সন্ধান চাই l
দুঃখ
ডাঙায় যে মাঝি আছে, নৌকা তাকে
বিদায় জানায়
জল তাকে টেনে নেয়, সে দূরত্বে
ভাসমান সময়—
শিকড়ে যে টান লাগে, তার ব্যথা উপড়ে
ফেলা দায়
ভূমির নিজস্ব দুঃখ ঘুরেফিরে
কৃষকের মনে পড়ে যায় l
সে দুঃখ সাঁতার কাটে মধ্যরাতে
চোরাবালি মেঘ—
কৃষকের স্বপ্নে ভাসে আদিগন্ত
সবুজের ক্ষেত l
যে মাঠে ফসল ফলে,সেই মাঠ
দিনদিন করায়ত্ব হয়
মুনাফা অছিলা খোঁজে, বন্ধুলোক ঘাড়
নেড়ে সায় l
মাঝি যদি নৌকা ছাড়ে, চাষী ছেড়ে
দেয় মাঠ—
তাহলে কী পড়ে থাকল? কবি হাতে নেয়
কাঠ l
কাঠেও অঙ্গার হয়, ধিকি ধিকি
জ্বলে সে আগুন
আগুনের দুঃখ জেনে কার কী লাভ হয় বলুৃন l
তবুও দুঃখ হাঁটে পা-পা, হেঁটে যায়
সীমানার কাছে
ওখানেই কাঁটাতার, পরিত্যক্ত
স্বপ্ন পড়ে আছে l