কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার ১৪২৫
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি:
বাঙালি আর উৎসব এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে,
এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে
ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই
কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র
কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব
এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই
প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
রীনা তালুকদার: কবিতা উৎসব পরিবারকে অনেক
ধন্যবাদ। বাংলার প্রকৃতিই যেনো সুন্দর এক কবিতা। প্রাথমিকের পুরো সময় এবং
মাধ্যমিকের দু'বছর
সময়টা মামার বাড়ী এবং ও দিকের স্কুলে কেটেছে। ছোটবেলায় যখন গ্রামের ভেতর দিয়ে
স্কুলে যেতাম হেঁটে হেঁটে;
তখন দু'পাশের
প্রকৃতির সৌন্দর্য ভাল লাগতো,
কাছে টানতো। শুকনো ধানের মাঠে শীতকালে মাটির নীচ থেকে শালুক তোলার আনন্দই
অন্যরকম। মাধ্যমিক পড়াকালীন স্কুল যাবার রাস্তার একপাশে ওয়াটার বোর্ডের খাল অন্য
পাশে সুপারির বাগান আর কোনো কোনো অংশে বিস্তারিত ধানের ক্ষেত। স্কুল শেষে বাড়ী
ফিরলে খাওয়া দাওয়া করে খেলতে যেতাম ধান ওঠে যাওয়া মাঠে। ছেলেরা ফুটবল খেলতো, হা-ডু-ডু
খেলতো। আমরা কজন দেখতাম আর মাঝে মাঝে খাল পারে মাঝারী ধরনের গাছে ওঠে খেলা দেখতাম
আর নীচে স্বচ্ছ খালের পানি বয়ে যাচ্ছে। এগুলো মূলত: ভেতরে কেমন যেনো প্রতিক্রিয়া
করতো। একদিন কিভাবে যেনো একটা দেশাতœবোধক
কবিতা লিখলাম। সেটা কী ভাবে তা আর অতো মনে করতে পারিনি। তবে সেলেখার সময় ক্লাস
সেভেনে পড়ি। তারপর আমার স্কুল বদল হলো,
থাকার জায়গা বদল হলো। সে সময় আমার এক
কাকা কলেজে পড়তো তার সংগ্রহে প্রচুর বই দেখলাম। সেখানে দেবদাস, শাপমোচন, পথের পাঁচালী
আরো অনেক বই সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার
বিশাল একটা কবিতা সংকলন পেলাম। তারপর আমার লেখা শুরু হলো। একদিন একটা
পত্রিকার ঠিকানা পেলাম নাম হচ্ছে নর-নারী কুইজ। এটিতে লেখা পাঠালাম। ছাপা হলো। এ
গুলোর সাথে সামাজিক ব্যবস্থার পরিবেশ আমাকে লিখতে বাধ্য করেছে। চারপাশে দেখতাম সব
মেয়েদের লেখার পড়ার দিকে জোর না দিয়ে কোনো রকম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতো তারপর যে
কোনো সময়ে পাত্র পেলেই বিয়ে দিয়ে দিতো। তখন আমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম না পড়া
শেষ করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তারপর অন্য কাজ। সেই দৃঢ়তাই আমাকে শক্তি
দিয়েছে সব সময়। আর এখন কবিতা লিখলেই ছাপা হয়ে যাচ্ছে পত্রিকা বা নেট ভিত্তিক
প্রকাশনায়। যেটা আমাদের সময়ে এতটা সহজ ভাবে ছাপানো যেত না। নদী বেষ্টিত বাংলাদেশই
কবিতার মত এই জন্য নদীমাতৃক বাংলাদেশ যেমন তেমনি বলা যায় কবি মাতৃক বাংলাদেশ। কবিতা যে কোনো জাতিকে স্বপ্ন দেখায়। আর সেই
স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা কবির কবিতায়। সুন্দর মানুষ, পরিবার,
সমাজ, রাষ্ট্র
ও পৃথিবীর জন্য কবিতা এক সুন্দর উপাদান।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য
কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে
চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি
একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক
পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
রীনা তালুকদার: সত্যিকারের কবিতা কর্মী যারা
তাদের কাছে কবিতা লেখা একটা তপস্যা। সারাক্ষণই কবিতার জপ তপে থাকতে হয় মনের ভেতর।
এতে মনটা সহজ, সরল
আর কোমল থাকে। এটা কঠিনতম সাধনা একজন কবিতা কর্মীর। কবিতা মানুষের জীবন যাপনের
নির্যাস। বর্তমান সময়ে কবিতা কর্মীর বর্ম চেপে লেবাসে অনেকেই আসে কবিতা লিখতে।
তাদের মধ্যে হুজুগ কিছুটা আছে। কেউ কেউ হঠাৎ খ্যাতির লোভেও করে থাকে। এই হুজুগটা অনেকটা মতলবী ভাবনা থেকে
করে তারা। কবিতা বরাবরই নীরব পরিবেশ দাবী
করে। প্রেম, স্নেহ, মায়া, প্রতিবাদ সব
কবিতাই একটা পরিবেশ দাবী করে। সুললিত,
সঠিক শব্দ চয়ন, উপমার
যথাযথ ব্যবহার, অলংকারিক
বিন্যাস এসবই নিরেট শীতল পরিবেশে অনেক বেশী যথার্থ হয়ে ওঠে। যেখানে ব্যক্তি, সমাজ,
রাষ্ট্র তথা সুন্দর পৃথিবী বির্নিমাণের বাণী তৈরী হয়। আর কবিতা কর্মীর
আত্মতৃপ্তি সবচেয়ে বেশী সেখানেই। কবি হয়ত সামাজিক পরিচিতি লাভের আশায় লেখে না।
কিন্তু ওটা তার স্বাভাবিকতা থেকেই হয়ে ওঠে। ঠিক কবিতার মতই। বলে কয়ে কবিতা হয় না। এটা স্বাভাবিকতা থেকেই
কোনো কোনো মানুষের ভেতর জেগে ওঠে। যাদের
সমাজ, রাষ্ট্র
কবি বলে ডাকে। কবিকে হতে হয় মানুষের কবি। পৃথিবীর পন্ডিতেরা শার্ল বোদলেয়ারকে
বলেছেন পৃথিবীর কবি বা মানুষের কবি। যার কবিতায় কোনো পক্ষ নেই। কেবল মানুষ ছাড়া।
যার কবিতা সবকিছুকে ছুঁয়ে যায় বিস্ময় বিশ্বাসে।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা বা সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যচর্চা বলতে
আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই সাহিত্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে
করেন কবিতা বা সাহিত্যেরও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব
সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার
নিরিখে, একজন
সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? যেমন ধরা যাক
একুশের চেতনা। বাংলা ভাষার স্বাধিকার বোধ। এইসব বিষয়গুলি। মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ
লক্ষ্যগুলি।
রীনা তালুকদার: সাহিত্য বা কাব্য চর্চা কোনো
বিলাসী আচরণ হতে পারে না। এখানে পরিশ্রম আছে। শ্রম আছে বিনিময় বিহীন। এই শ্রমের
বিনিময়টা হচ্ছে ব্যক্তি মনের স্বাধীনতার তৃপ্তি। এখানে সাধারণ মানুষের নয় বরং কবির
বিবেক কবিকে তার নিজস্ব আদালতে দাঁড় করায়। যেখানে কবি তার ভাবনাকে মানুষের কল্যাণের দিকে নির্দেশ করে। মানুষ যেনো
মানবিক হয়ে ওঠে। সমাজ জঞ্জালমুক্ত থাকে। কবি/ সাহিত্যিকের সমাজের কাছে এটা দায়।
সাধারণ মানুষকে কেউ কবি অভিধায় ডাকে না। কবিকেই কবি বলা হয়। এই কবি ডাকটি যে
ব্যক্তি মানুষের বিশেষ গুণ সমাজের কাছে তার এটা কৃতজ্ঞতার দায়। সে জন্যই সমাজ, রাষ্ট্র, জাতীয়তাবোধ
তথা বিশ্ব সম্পর্কে সচেতনতা কবির জন্য অপরিহার্য। তবে সচেতনতা বিষয়টা অনেকটা কবির
চারপাশের পরিবেশের উপরও নির্ভর করে তার জানার পরিধি ও ধারণ ক্ষমতার পরিধি অনুযায়ী।
কবি ডাকা হয় এমন কেউ কেউ তার নিজের ব্যক্তি সত্তার বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়। সেখানে নিজের
জন্মগত সত্ত্বা, শেকড়ের
কথা পাশ কাটিয়ে যায় তার সাধনায়। সেটা বোঝা যায়। ষাট ও সত্তরের দশকের অনেকেরই লেখায়
বাঙালী তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়কে কবিতায় এড়িয়ে গিয়ে প্রেমের কবিতা
লিখেছেন। কেউ কেউ বিমানের শব্দে শংকা বোধ করে চুপ করে ছিলেন কবিতায়। একুশের কবিতা
লিখেননি অনেকেই। অনেকেই লিখতে পারেন না। অথচ এই বাঙালী ও বাংলাদেশের তারাও
অংশীদার। আর সেখানেই রাজনীতি বিশুদ্ধতা হারিয়েছে সুস্থ্য নাগরিকের জন্য। যেখানে
কবিতা ও কবির দায় আছে। কিন্তু দায়িত্ব সবাই পালন করে না। হটকারী বিপ্লবীর উপস্থিতি
সর্বকালেই ছিল। একজন কবিতা কর্মী হিসাবে অনুভব করি কবিতা সমস্ত দুঃসময়ের
বন্ধু।
কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজ সচেতনতার প্রসঙ্গে
একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই
প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি,
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে
তুলতে পারে? এমনকি
হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
রীনা তালুকদার: কবি/ সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও
রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশেষ ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। যেটা বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের জন্য বাঙালীর
মুক্তিযুদ্ধে কবি / সাহিত্যিদের কবিতা, গল্প, নাটক, গান
যোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছে। পাশাপাশি সেখানে আমাদের জাতিগত ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুখ্য
হয়ে ওঠেছে কবিতার প্রতি শব্দ ও বাক্যে। আমাদের একুশের চেতনায় বহু বিখ্যাত কবিতা, গল্প, নাটক, গান রচিত
হয়েছে। নির্দিষ্ট মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের লেখার ভূবনকে বৈচিত্র দিতে পারে
অবশ্যই। তবে শেকড়ের ঐতিহ্য বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে বিশ্ব পন্ডিত হবার অভিপ্রায়ে
লেখক লক্ষ্যে পৌঁছাবে এটা খুব শক্ত ও লেখকের বিবেক বর্জিত কাজ। বলা যায়
"দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য"। তবে হা স্পেনের যুদ্ধে অনেক লেখকরাই
নির্যাতিত হয়েছেন, মারা
গেছেন কিন্তু লেখার উৎকর্ষতা হারিয়েছেন বলে দেখা যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প
বিপ্লব বিশ্বকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবও উপহার দিয়েছে। ফরাসী পরাবাস্তব কবি পল এলুয়ার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কবি,
আধুনিক স্প্যানিশ কবি আন্তোনিও মাচাদো,
স্প্যানিশ কবি রাফায়েল আলবের্তি যার রাজনৈতিক কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু, লাতিন
আমেরিকার কবি সেসার বাইয়েহো যুদ্ধকালীন লেখা কবিতা, বিট জেনারেশনের কবি লরেন্স ফালিংহেটি রাজনৈতিক কবিতা
লিখেছেন। গুন্টার গ্রাস -এর কবিতা রাজনৈতিক বলয়ে থেকেও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের নিরিখে এমন সাহিত্য চর্চায় এমন কঠিনতর কোনো বিষয়তো দেখা যায় না।
কবিতাউৎসব: আবার এই সমাজ সচেতনতার ভিত্তি
সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন? কবি
জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
রীনা তালুকদার: কবি/ সাহিত্যিকের সমাজ চেতনার
ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাস বোধের উপর প্রতিষ্টিত হওয়া অপরিহার্য। কবি / সাহিত্যিক সম
সাময়িক কালকে ধারণ করে। প্রত্যেকেই নিজের সময়কে লেখার রেখায় অঙ্কন করে রাখতে চান।
যেনো এই কালেই তিনি মূর্তমান থাকেন সমকালের ইতিহাসে। এই জন্য কবি তার নিজের সময়কে
কবিতায় ধারণ করে স্বর্ণযুগ করে রাখাটা দরকার। তা না হলে অস্তিত্বই বিলীন। এই
কারণেই দশকওয়ারী বিভাজন তৈরী হয়েছে।
মাইকেল যুগ, রবীন্দ্র
যুগ, পঞ্চ
পান্ডব, কল্লোল
যুগ এই শব্দ গুলো সাহিত্যে বহু ব্যবহৃত। আর একই সাথে এই সমকালের কবি/ সাহিত্যকগণও
চিহ্নিত হয়ে আছেন। প্রতিনিয়ত মানুষের মুখের ভাষা বদল হচ্ছে, মানুষের গড়
আয়ূর পরিবর্তন হচ্ছে,
ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের
চেতনায় পরিবর্তন তো আরো দ্রুত হচ্ছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ কবিতায় একশভাগ সত্য।
কবির কবিতাও বিবর্তনিক ধারায় ধাবমান। আর সেখানে কালচেতনা কবিতার ক্ষেত্রে আরো
জরুরী। মানুষ বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে ওঠলেই পরিবার, সমাজ,
রাষ্ট্র স্বাবলম্বী হয়ে ওঠবে। কালের মধ্যে থেকেও কোনো কোনো লেখা কালকে
অতিক্রমে করে যায়। যেভাবে সাহিত্যে মাইকেল,
বিহারী লাল, লালন, রবীন্দ্রনাথ, পঞ্চপান্ডব, সুকান্ত, নজরুল আছে।
অন্যদিকে শার্ল বোদলেয়ার,
শেক্সপীয়ার, পাবলো
নেরুদা সহ আরো অনেকেই আছে।
কবিতাউৎসব: এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার
প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার
সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই সাহিত্যের
পরিমন্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম
আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে?
বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম
স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
রীনা তালুকদার: প্রত্যেক কবি/ সাহিত্যিকই তার নিজের চারপাশের
বিষয়কে প্রথমে অবলোকন করে। যারা এদেশের আবহাওয়ায় লালিত পালিত তাদের লেখায় তা
অনিবার্য ভাবে দেখা দেয়। আর আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাবার বিষয় নিজের জাতিসত্ত্বার ভেতর
থেকেও সম্ভব। বিশ্বের সব মানুষই কান্নায়
চোখের জল ফেললে তা সবাই বুঝতে পারে। নদীর
নাম ভিন্ন, জল
পরিবেশ ভেদে জলের রং আর বাঁক,
ঢেউ, নীরবতা, নির্বাক, স্থবিরতা সবই
এক। পৃথিবী ব্যাপী একটাই চাঁদ ওঠে। একটাই সূর্য ওঠে। প্রতিটি ভূ-খন্ডেই রাতদিন, সমুদ্রে
জোয়ার-ভাটা, আহ্নিক
গতি -বার্ষিক গতি, তেজ
কটাল -মরা কটাল সংঘটিত হয়। ফুল আছে রঙ
ভিন্ন, জাত
ভিন্ন হতে পারে। প্রকৃতি আছে কম বেশী।
মানুষের জীবনের তাগিদ আছে। খাবার-দাবার,
পোশাক- প্রসাধনীর মিল আছে,
ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আছে। নারীর অবদাহ
আছে। কৃষি ও কৃষকের গল্প আছে। রবীন্দ্রনাথের গান বিশ্বব্যপী সমাদৃত ও নোবেল বিজয়ী
হয়েছে। লালনের গান ছড়িয়ে গেছে। জীবনানন্দ বর্তমানে বিশ্বের দিকে ছড়িয়ে গেছে। বাংলা
সাহিত্যে যেভাবে শার্ল বোদলেয়ার, জন মিল্টন, ওমর খৈয়াম,
জালাল উদ্দিন রুমি চর্চা হয়েছে। লিওন্যার্দো, ভ্যানগগ,
পিকাসো বার বার কবিতার লাইনে উপজীব্য হয়েছে। দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোক ঐতিহ্য'র সাথে
বিশ্বের তাবৎ ইতিহাস,
ঐতিহ্য ও মিথ সংযোজনের মধ্য দিয়ে বিষ্ণু দে কবিতাকে বহুমাত্রিকতা দিয়েছেন। সমর
সেন পৃথিবীর নির্যাতিত শ্রমজীবির কথা কবিতায় তুলে ধরেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়
জীবনের সকল খুঁটিনাটি বিষয়কে কবিতায় ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান সময়ে যোগাযোগ
ব্যবস্থার উন্নতির কারণে কবি/ সাহিত্যিক গণ রাষ্ট্রীয় ও নিজ উদ্যোগে দেশ -বিদেশ
ভ্রমণ করছেন। সাহিত্যের আন্তর্জাতিক উৎসব হচ্ছে। সবার সাথে সবার ভাবের আদান প্রদান
হচ্ছে। ফেসবুক সাহিত্য মুহূর্তেই সারা বিশ্বের মানুষের সাথে সংযোগ ঘটাচ্ছে।
পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের স্বাধীনতার কথা গুলো একই ভাষায় প্রকাশ করে। প্রতিবাদের সুর ও প্রতীক ভিন্ন হতে পারে বোঝাতে
চায় যা তা স্বাধীনতাই। এছাড়া বিশ্বব্যপী বিজ্ঞান কবিতা লেখা হচ্ছে। বিজ্ঞানের
সমস্ত আবিস্কার গুলো বিশ্বের সব মানুষই কম বেশী ব্যবহার করছে। এখানে শব্দ ও
বাক্যের দিক থেকে অনেক সম্ভাবনা আছে আন্তর্জাতিকতায় পরিণত হওয়ার। কেননা বিজ্ঞানের
শব্দ গুলোর কোনো আঞ্চলিকতা নেই এবং উচ্চারণ ও অর্থ একই বিশ্বে। এইজন্য বিজ্ঞানকে
কবিতায় কোমলতার মালা দিয়ে ব্যবহার করতে হবে বেশী বেশী। সুতরাং দেশীয় স্বাজাত্যবোধ
মোটেও প্রতিবন্ধক নয় আন্তর্জাতিকতায়। সব দেশের সাহিত্যের বেলায় এই কথা সত্য। বরং
যাদের নিজেদের কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস নেই তারা যাযাবর আখ্যা পায়। তারা না ঘরের না
ঘাটের। তারা কোনোটাকেই গ্রহণ করতে পারে না। নিজের নেই অবজ্ঞা থাকে সর্বত্রই। আর
যাযাবর হলেও এর থেকে বেরিয়ে গ্রহণের মানসিকতা থাকে যাদের তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না
কিছুই। ভাবনাকে বিশ্বজনীন করে ভাবতে পারলে আন্তর্জাতিকতাবোধ আপনা আপনিই তৈরী
হয়।
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে
বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে
গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের
পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো
দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে।
এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন?
অনেকেই যদিও বলছেন,
এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায়
চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি
আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি?
না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
রীনা তালুকদার: সাহিত্যের ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন
করা মোটেও সহজ নয়। অনেক ভাল লেখার মধ্যে কতিপয় লেখাই কালজয়ী হয়। কবির ক্ষেত্রেও তাই। পাশাপাশি দুর্বল কবি - কবিতাও আছে থাকবে। ভাল
কবিতা গুলো ভাল হিসাবে বেচে নিতে পারে দুর্বল কবিতার কারণেই। সেখানে দুর্বল কবি ও
কবিতার অবদান কম নয়। আন্তজালিক মিডিয়ায় অনেকেই লিখছেন এক দুই তিন চার লাইনে। মানুষ
জীবন জীবিকার তাগিদে উর্ধ্বশ্বাস জীবন যাপন। সেখানে যদি দুই চার লাইন লিখে
আত্মতৃপ্তি বা সুখ পায় তো লিখুক না। এতে যারা শংকা করছেন তাদের শংকা আশংকার কোনো
কারণ আছে মনে করি না। এই দুর্বল লেখকরা কোনো কিছু পাবার আশায় লেখে না। এরা কোনো
প্রতিযোগিতা মূলক সাহিত্যে টিকতে পারে না। সব বিখ্যাতদের পিছনেই অখ্যাত ও
দুর্বলদের অবদান আছে। প্রকৃত যে ভাল লেখে
সে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছাবেই। আর প্রকৃত লেখা পাঠক প্রিয়তা পাবেই। তাই নেট মাধ্যমে
অত্যন্ত কম সময়ে এবং অনেকটা ব্যয়বিহীন দ্রুত বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে পৌঁছানো
যায়। স্টোর করে রাখা যায়। যখন তখন যে কোনো জায়গায় বের করে পড়া যায়। বিজ্ঞানের
প্রবল উৎকর্ষতার সময় এখন। সাহিত্যে আন্তজালিক মিডিয়া বিজ্ঞান ভিত্তিক সাহিত্যের
ক্ষেত্রে সহায়ক। কবিতাও বিজ্ঞানমুখী ও বিজ্ঞান কবিতা। সংগঠনভিত্তিক সচেতন ভাবে
বিজ্ঞান কবিতা চর্চা শুরু করে আশির দশকে অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। আমার বিজ্ঞান
কবিতা লেখার সূত্রপাত সেখানেই। অবশ্যই আন্তজালিক মাধ্যম আশা ব্যাঞ্জক। এই মাধ্যম
বিদেশী সাহিত্যের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে একটি সহজ ও দ্রুততম মাধ্যম। যে
লেখা ছড়িয়ে যেতে পারে না সে লেখা ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্রের আদোতেই কোনো কাজে লাগে
না।
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা
সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের
কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায়
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন,
এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার
ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান
লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা,
রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত;
নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই
বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে কি? বা পারলে
সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?
রীনা তালুকদার: সমাজ জীবনের অস্থিরতা
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক তো নয়ই বরং সমাজ বিনির্মাণে কবিতার অবদান
অস্বীকার্য। একজন লিখিয়ে যে কোনো পরিস্থিতি পরিবেশেই লিখতে পারেন। আর সকল
পরিস্থিতিই লিখিয়ের লেখার উকরণ হতে পারে। বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন,
একাত্তরের অস্থিত্বের যুদ্ধ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নি:সন্দেহে।
অতিবুদ্ধিজীবি অতিবিপ্লবী যুগে যুগে ছিলো। এরা সুবিধাভোগী থাকবেই। কিন্তু সাহিত্যের সমৃদ্ধির যে ব্যাপারটা সেটা
এসব প্রতিবন্ধকতা পিছনে ঠেলেই হয়ে ওঠে। সাহিত্য চর্চায় যত বেশী বিজ্ঞান মনস্কতা
বাড়বে মৌলবাদ সে হারেই কমে যাবে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে পৃথিবীতে
ও প্রকৃতিতে। কিছু বিষয় হারিয়ে যাচ্ছে আবার নতুন কিছু তৈরী হচ্ছে। সাহিত্য এভাবেই
সমৃদ্ধির দিকে যায়। ভাল লেখা অবশ্যই হচ্ছে। মানুষ বাড়লে কবি /সাহিত্যিক বাড়বে।
ভাল-মন্দ লেখা সেই রেশিওতে বাড়ে। হতাশার কোনো কারণ দেখি না। একজন লিখিয়ে কয়েক দশক
ধরে লেখেন। কিন্তু প্রত্যেক নতুন দশকেই কিছু নতুন বিষয়ের উদ্ভব হয়। অনেকেই পুরনোকে
অনুকরণ করেন। তারা মনে করেন ওমুক বড় কবি তিনি তো এই শব্দ ব্যবহার করছেন, এই আঙ্গিকে
লিখছেন। আমি লিখলে অসুবিধা কোথায়?
কিন্তু যে বিচ্ছিন্ন সুর নিয়ে হাজির হয় তাকে সাহিত্যের মঞ্চ থেকে ফেলে দিতে
পারবে না। তাই হতাশার কিছু নেই।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান
জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন।
যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক
অস্থিরতার দহন নেই, আছে
শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,
কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো
মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি
জুটবে? কবির
কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?
রীনা তালুকদার: চীনা দার্শনিক ল্যূ সান
বলেছেন-কবিতায় রাজনীতিই প্রথম। সুতরাং কবি-কবিতায় রাজনীতি আছেই। মানুষ রাষ্ট্রের
নাগরিক হিসাবে সুযোগ সুবিধা,
দুঃখ সুখের সাথে জড়িত। একজন মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা যেমন পর্যায়ের থাক একজন
কবির কিন্তু থাকবেই বা থাকা উচিত। যদি রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে ছুটে গিয়ে একান্তই
রোমান্টিকতায় মেতে ওঠে তবে তাও হতে পারে। কেননা কবি তো ব্যক্তি মানুষ হিসাবে
জীবনের স্বাভাবিক সব চাহিদাই তার আছে। কিছু সময় সেখানে রোমান্টিকতা জড়িয়ে থাকতেই
পারে। বরং সেই রোমান্টিকতাই তার সমস্ত কাজকে সুচারু রূপে গুছিয়ে দিতে সহায়তা করে।
কল্পনার ডানায় ভর করে রবীন্দ্রনাথও ছুটেছিলেন স্বপ্ন রাজ্যে। তিনিতো সেখানেও সফল
হয়েছেন। আবার আবদুল মান্নান সৈয়দ সহ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধ বিষয়ক কোনো
কবিতা না লিখে শুধুই প্রেমের কবিতা লিখেছেন। আবার কখনো আশংকিত কবিতা লিখেছেন।
কিন্তু মান্নান সৈয়দ বা অন্যদের পাঠক যারা
তারাতো সেটাকে গ্রহণ করেছে। অবশ্য যারা একেবারেই এড়িয়ে যান তাদের ক্ষেত্রে সুসাহিত্যিক
বলার ব্যাপারটা প্রশ্নবিদ্ধ। পাঠককের ক্যাটাগরী অনুযায়ী পাঠককের চাহিদা ভিন্ন
ভিন্ন। সব পাঠকের জন্য সব লেখা নয়। একজন দায়িত্বশীল কবি সর্বজনীন বা সার্বজনীন
লেখাই লেখার চেষ্টা করেন। সেখানে রোমান্টিকতার আড়ালে কল্পনার জগতে যে প্রকরণ নিয়ে
লিখুন তিনি ভাল লেখারই চেষ্টা করেন। গ্রহণ
যোগ্যতার বিষয়টা সমসাময়িক পরিবেশে আপেক্ষিক।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার
তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক
সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে।
আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি
সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।
রীনা তালুকদার: শ্লীল-অশ্লীল বিষয়টা পাঠকের
আপেক্ষিক। কেউ না বুঝেও অশ্লীল ভাবে গ্রহণ করতে পারেন। কেউ বুঝে অশ্লীলকেও শ্লীল
ভেবে গ্রহণ করতে পারেন। কেউ শ্লীল-অশ্লীল এর মধ্যে শিল্প খোঁজেন। ইউরোপ জুড়ে
রাস্তা ঘাটে ভেনাসের নগ্ন মূর্তি রয়েছে।
সেখানের নাগরিকদের দেখতে অশ্লীল মনে হয় না। এদেশের বিমান বন্দরে নামলে
লালনের ছবিতে ধর্ম চলে যায়। সৈয়দ শামসুল
হকের বৈশাখের পংক্তি মালা কবিতা পারিবারিক বলয়ে উচ্চারণ করা অস্বস্তি। কিন্তু তার
কবিতার ভাষাতো সমাজের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা থেকে উৎখিত। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধেও
অশ্লীলতার অভিযোগ আছে। যে কোনো মানুষ তার মগজে অনেক অশ্লীল চিন্তা করতে পারেন।
কবির সমাজে দায় আছে। কবি অনেক অশ্লীলকেও শব্দের ব্যঞ্জনায় শ্লীল করে প্রকাশ করতে
পারেন। অশ্লীল-শ্লীলতায় রূপ লাভ করে মানুষের পৃথিবীতে আগমন। কোনো কোনো দেশে অশ্লীল
কে সমাজ সনদ দিয়ে বৈধতা দিয়েছে। কোনো দেশে সমাজ -রাষ্ট্র দৃষ্টিকটু না দেখানোর উপর
জোর দিয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ নয়তো। কবিতায় অশ্লীলতা প্রকরণে আপেক্ষিক হলে ব্যবহার
অনিবার্য। তা না হলে কবিতার অঙ্গসৌষ্ঠব অসমাপ্ত থাকতে পারে। শ্লীল-অশ্লীল বিষয়টা
শব্দ নয় বরং মানুষের মনের মধ্যে। ডি এইচ লরেন্স -এর লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার বই অশ্লীতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছে। বিট
জেনারেশনের কবি লরেন্স ফালিংহেটির হাউল বইর বিরুদ্ধে আদালতে অশ্লীতার অভিযোগ ওঠে।
সমরেশ বসুর প্রজাপতি বইটিও অশ্লীলতার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশেই অনেক লেখকের বইয়ের
বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে। অশ্লীলতাও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হয়। যদি মনে করি
তিনি মানুষের লেখক তাহলে কথা ভিন্ন। অভিধানে অশ্লীল শব্দ অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে
যখন তখন ব্যবহার না করলে কি প্রয়োজন ছিল অন্তর্ভুক্তির ? ক্ষেত্র
বিশেষে শব্দ ব্যবহৃত হয়। কোনো প্রকরণের বাক্যে অশ্লীল শব্দটা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
তবে ভোগবাদী পৃথিবীতে একসাথে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের লড়াই। এর মধ্যে কবির জন্য
স্বাধীন লেখার জগতটা খুব ছোট। তাই কবি যা লিখেন সেটি শিল্প হিসাবে না নিতে পারলেই
তো অশ্লীলতার অভিযোগ। একজন কবির জন্য পাঠকের অশ্লীলতা ধারণ ক্ষমতা চিন্তায় রাখা
দরকার নেই। তবে যতটা সম্ভব উপমা,
অলংকারে, রূপকের
আশ্রয়ে লেখার অবকাশ আছে। সেখানে খুব বেশী উদোম করে লেখলেই অভিযোগ। এই শ্লীল-অশ্লীল
এর প্রশ্লেই কবির পৃথিবী বা মানুষের কবি বা লেখক হয়ে উঠা কঠিন। শ্লীল -অশ্লীলতা তো
পাঠকের মনের মধ্যে। শব্দের গায়ে তো অশ্লীলতা লেখা থাকে না। দেশ-কাল-সমাজ, পরিবেশ ভেদে
কিছু শব্দকে মানুষ শ্লীল এবং কিছুকে অশ্লীল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং শ্লীল-
অশ্লীল মানুষের মন-মগজের ব্যাপার।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত বাংলায়
কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি
ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ
বাংলা সাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের
দু’পারে
দুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি
ভাবে দেখতে চান?
রীনা তালুকদার: কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা
সাহিত্যে কেবল ভাষাগত মিলটা বেশী। নাগরিক জীবন যাপন ও ধ্যান ধারণায় অনেক ভিন্নতা
আছে। কবিতার উপকরণে বিশেষ করে ৪৭ এর ভাগের
পরে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবন জীবিকা, শক্তি,
সাহস, পরিবর্তনের
মানসিকতা কলকাতার থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাকে সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে ইউনেস্কোর মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে। জাতিসংঘ মিশনের মাধ্যমে অনেক দেশেই বাংলাদেশের সেনা ও
পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন দেশেও বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের
সংগীত উপমহাদেশ ছাড়িয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ও রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের মাধ্যমে এখনো রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে
যাচ্ছে পৃথিবী ব্যপী। একজন এ্যালেন গিনসবার্গ একাত্তরের বিভীষিকা দেখে এদেশের
উপকরণ নিয়ে এদেশের মানুষের কথাই লিখছেন ইংরেজী ভাষায় তার কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর
রোড । এটাতো অভূতপূর্ব পাওয়া বাংলা সাহিত্যের।
কলকাতা এখনো বাংলাকে কলকাতা থেকে তাদের রাজধানী বা অন্য কোনো প্রদেশেই ছড়াতে পারেনি। কলকাতার বর্তমান
সাহিত্যিকেরা বাংলা ছড়াতে বাংলাদেশে আসেন।
যেখানে প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারা ভারতের অপরাপর অঞ্চলে ছড়ানোর লক্ষণ দেখা
যায় না। দুই দেশের মাঝে যে কাঁটাতার সেটা উঠানোর সম্ভাবনাও নেই। কেননা নির্দিষ্ট
ভূ-খন্ডের দাবীতেই বাংলাদেশের সৃষ্টি। ভারতের কোনো অংশ এতে যুক্ত নয়। তাতে
সাম্রাজ্যবাদী দোষে দুষ্ট হবে রাস্ট্রীয় সম্পর্ক। বাংলাদেশ ৪৭ ভাগের পর থেকে যে
উত্তরণ ঘটিয়েছে সর্বক্ষেত্রে। সেখানে কলকাতার অবস্থান খুবই নাজুক। কবিতার
বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে কলকাতা বর্তমান সময়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে যেখানে বাংলাদেশের
কবিতা এগিয়ে গেছে মনে করছি। কলকাতায় বাংলা ভারতের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অধীন। তবে
বাংলা (কলকাতা)- বাংলাদেশ পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ে আশার দিক রয়েছে।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত
জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান; যাকে পুঁজি
করে ইঙ্গ-মার্কিন মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে
সদাসক্রিয় থাকে; নেট
বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে
মুক্ত করতে পারবো আমরা?
আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে
বলে আপনি মনে করেন!
রীনা তালুকদার: যে কোনো জাতির সংকট মুহূর্তে
কবি/সাহিত্যিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান যুগে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ঢেউ
কবিতায় লেগেছে। বর্তমান সময়ে কবিতায় বিজ্ঞান সচেতন ভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সাধারণ
মানুষের কাছে বিজ্ঞান কবিতা একশ ভাগ পৌঁছাতে পারলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের
অন্ধত্ব দূর হবে। একই সাথে বিজ্ঞানের অবদান নেটের কল্যাণে সাহিত্য বিশ্বব্যপী
ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুততম সময়ে। আশাবাদী দিক হচ্ছে বিশ্বজুড়েই সাহিত্য ও সংস্কৃতির
বিনিময়ে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য বেড়ে যাচ্ছে। ফলে
মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবেই। সেখানে কবিতার অবদান অনেক। আর বাংলা সাহিত্য থেকেই
বিজ্ঞান কবিতার যাত্রা শুরু করেছে। ফলে বাংলা সাহিত্য একদিন বিশ্ব সাহিত্যকে
নেতৃত্ব দিবে। সেটা খুব বেশী দূরে নয়। তার জন্য মান সম্মত অনুবাদকদের এগিয়ে আসা
প্রয়োজন।
কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের
অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের
কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?
রীনা তালুকদার: পাঠকের মনে থাকার মত করে যে
লেখাটি লিখতে পারবো। আর অবশ্যই বিজ্ঞান ভিত্তিক কবিতার মাধ্যমে। সেই লেখার জন্যই
লিখে যাচ্ছি নিরন্তর। পাঠক আমার লেখার নির্যাস থেকে আমাকে পৃথক করে চিনুক আমার
স্বনামেই।
কবিতাউৎসব: আপনার সাহিত্যচর্চার আজীবন
সাধনার বিভিন্ন পর্ব পেরিয়ে এসে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা তৃপ্ত আপনি? আর কতটা
আক্ষেপ রয়ে গেল? ভবিষ্যতের
বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?
রীনা তালুকদার: বাঁচি যতক্ষণ লিখেই যাবো। পাঠক
যদি কোনো লেখা গ্রহণ করে তবেই আত্মতৃপ্তি অনুভব করবো। ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য হবে
বিজ্ঞান সাহিত্য। কবিতা একশভাগ বিজ্ঞান কবিতা হবে। খুব অল্প সময়ের ব্যবদানে রোবট
মানুষের সাথে কবিতা লিখবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাহিত্য আরো সহজ হবে প্রকাশ, প্রচার ও
প্রসারে। বাংলা বিজ্ঞান কবিতা বিশ্বপরিচিতি লাভ করবে দ্রুত। অচিরেই নেট সাহিত্য
মাধ্যম সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় হবে। পাশাপাশি প্রিন্ট মাধ্যমের আবেদন কখনো কমবে না।
রীনা তালুকদার: নব্বই দশকের
কবি , প্রাবন্ধিক
। মহাসচিব- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। বিভাগীয় সম্পাদক: অনুপ্রাস সাহিত্য পাতা -
দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা,
সাপ্তাহিক কালধারা ও দৈনিক নব অভিযান। বিশেষ প্রতিনিধি: শিরদাঁড়া। বাংলাদেশ
প্রতিনিধি: মননস্রোত (ত্রিপুরা,
ভারত)। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ। সদস্য- হাসুমনির পাঠশালা। সাবেক সভাপতি, বদরুন্নেসা
কলেজ ও সাবেক সহ-সভাপতি,
ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগ। বাবা -মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম।
পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম -২১ আগস্ট,
১৯৭৩, জেলা-
লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৩টি,
গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও কাব্য কথায় ইলিশ), সম্পাদনা
কাব্যগ্রন্থ-১টি, সহযোগী
সম্পাদনা (বিষয়ভিত্তিক)- ১১টি। জাগ্রত ছোট কাগজের সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ- সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট (বঙ্গবন্ধু সিরিজ), বিজ্ঞান
কবিতা, প্রেমের
বিজ্ঞান কবিতা, স্বাধীনতা
মঙ্গলে, বিজ্ঞান
সনেট। বর্তমান সময়ে তিনি বিজ্ঞান সমন্বয়ে কবিতাকে নতুনত্ব দিয়েছেন। প্রথম
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় নব্বই দশকে। লেখালেখির
জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর মহান বিজয় দিবস ২০১১
সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন।