সমরেন্দ্র বিশ্বাস
কাঁচের শব্দ
ক্লান্ত পদাবলীর ওপার থেকে
সবুজ গাছের ঝাঝরি পেরিয়ে
কাঁচের শব্দ হেঁটে এলে
বুঝতে পারি,
প্রেম আসছে!
কাঁচেরা মায়াময় –
সিরামিক নির্মাণের এক জটিল প্রক্রিয়া
তোমার চুড়ির রিনঝিন স্বপ্নের মতো ,
যেমন দিঘির গভীরে ঢেউ তোলা ছায়া ও মায়া!
কোনো একদিন অভিমানের রাগী হাতে
কাঁচের শব্দরা খান খান হয়ে গেলে
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে তোমার মুখ,
নীরব রাত্রি ঘিরে উদাসী বিষন্নতা!
স্বপ্নে ভাসে নির্জন দিঘি, আমি,
জল আর একাকী চাঁদের ছায়া।
অপেক্ষায় থাকি
কখন আবার চুপি চুপি হেঁটে আসবে কাঁচের শব্দ !
একটা দেশাত্মবোধক দিন
সংকেত টাওয়ারের ধাতব শরীর বেয়ে দেশের মাটিতে নেমে আসে
বিদেশী তক্ষক। দূষিত মগজের বাদামী ধোঁয়ায় টাল খেতে থাকে দেশাত্মসংগীত। প্যারেড
গ্রাউন্ডের মার্চপাস্ট ,
কেল্লার সামনে আকাশী স্যালুট আর ভাঙ্গা বাদামের উপেক্ষিত খোসা পরে থাকে ডেঙ্গু
বিধ্বস্ত নর্দমার কালো জলে। পশ্চিমা হাওয়ায় উপহার আসে ব্যবসায়ী পাথর আর প্রটোকলের
গ্রহরত্ন। আরোপিত বন্দুকবাজীতে ভেঙ্গে যায় সৌখিন জটলা, বেঁকে যায়
ডান্ডার কপিকলে লাগানো ধ্বজার বিষন্নতা। অশৌচ জলের দেশে গাছের শুখা ডালে ঝুলে থাকে
কিষাণের ছায়া। বন্ধ কারখানার সামনে মজদুরের সাইকেলকে বাজী রেখে বোমার শব্দে
আত্মঘাতী হয় একটা তেরঙ্গা বিকেল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে আসে
উড়ন্ত অশোকচক্র। ক্ষুধার্ত দেশের আলোময় হলঘরে সারি সারি শ্বেতপাথরের ডাইনিং টেবিল, অন্যদিকে
সময়ের গর্ভে জন্ম নেয় সন্ত্রাস,
সারি সারি কবরের গর্ত থেকে মূহর্মূহু উঠে আসে মৃত্যু সংকেত। কারণ উদযাপিত
স্বাধীনতা!
এখন বনাঞ্চলে
ছুটন্ত বুলেটকে পাথর কিংবা ভাগ্যলিপি ভেবে
যেসব আদিবাসী মানুষেরা
জঙ্গল কিংবা টিলার আড়ালে মুখ লুকায়
তারা এই বনাঞ্চলেই থাকে।
পোষাকে বল্কল,
মহুয়ার নেশায়
এইসব মানুষেরা
দুহাতে অঞ্জলি পেতে চেয়েছিলো শান্তি
অরণ্যের নির্জনতা,
ঘোটুল সংগীত
গাছের ছায়ায় উড়ন্ত পাখির জীবন
প্রাচীন শস্যের ঘ্রাণ।
অথচ ঘাতক সন্ত্রাসে
বনাঞ্চল আজও অন্নহীন,
শান্তিহীন -
ময়দানে ইতিউতি পড়ে আছে দ্যাখো
ছিন্ন শির শিমুলের ফুল !
অদৃশ্য ফটো
মৃ্ত্যুর পরে যে অদৃশ্য ফটোটা হলঘরে ঝুলবে
সেটা আমি নিজের হাতেই
ডিজিটালে তুলে রেখে যেতে চাই ।
তবে এখন নয়,
আরেকটু পরে,
এখনো অনেক অনেক কাজ বাকী ।
#
সন্ধ্যা নামলে রেল ইঞ্জিন যখন পৌঁছে যাবে প্রান্তিক
স্টেশনের নির্জনতায়,
নারকেল গাছের পাখিগুলো উড়াল দেবে অন্ধকারের দিকে ,
যখন তুমি রাগ সংগীত শেষ করে
একটা পুরোনো ডায়েরীর ছেঁড়াপাতা নিয়ে বসবে বাষ্পীভূত স্মৃতির
জানালায়,
সমস্ত ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে
ধুয়ে রাখবে রঙের শিশি,
পলকা তুলি, তুলে
রাখবে ভঙুর পেন্সিল ,
যখন দীর্ঘশ্বাসে কারোর নাম ধরে ডাকলে
একটা ব্যর্থ প্রতিধ্বনি যুগান্তের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে
আসবে আমাদেরই উঠানে
#
তার আগে,
কিছুটা আগে
মরূভূমি যাত্রার মাঝপথে তৃষ্ণার্ত উটটাকে ক্ষণিক থামিয়ে
নিজের হাতে নিজেই ডিজিটাল ক্যামেরায়
তুলে রাখবো সেই অদৃশ্য ফটোটা,
মৃত্যুর পরে অন্তিম ফ্রেমে যেটা হলঘরে ঝুলবে ।
দৃশ্যমান করতে তুমি কি মোমবাতি জ্বালবে অদৃশ্য ফটোফ্রেমের
নীচে , দেয়ালে
?
#
তবে এখন নয়,
আরেকটু পরে,
এখনো মরূভূমির অনেকটা পথ বাকী,
জনপদের দেয়ালে দেয়ালে চোরা গোপ্তা পোষ্টার ।
মৃ্ত্যুর পরে যে অদৃশ্য ফটোটা হলঘরে ঝুলবে
অবশ্যই সেটা আমি নিজের হাতে নিজে ডিজিটালে করে যেতে চাই ।
প্রেম
পৃথিবীর যত টিয়া চলে গেলে গৃহস্থালি কাজে
অনন্ত দুপুরে আমি হিসেবের খাতা নিয়ে বসি।
সেই মুখ খুঁজে নিতে আমি চলে যেতে পারি
দারু বনানীর ধারে
যেখানে সমস্ত সভ্যতা নিঃসাড়ে ঘুমায়,
তার সঙ্গে দুদন্ড কাটাতে আমি ভেসে যেতে পারি
তোলপাড় জলস্রোতে
একা একা স্মৃতির ভেলায়।
#
স্বর্গ মর্ত্য চরাচর ছিন্নভিন্ন করে এসে দেখি
বাসন্তী মেঘের কোলে তানপুরা হাতে তুমি
আনমনে গান গাও,
ঠিক যেন আমার কবিতা!
এত কাছাকাছি আছি,
তবুও জানি না
তোমার গোপন কথা।
#
তুমি কি জেনেছ কতখানি আগুনেরা ধিকিধিকি
আমাকে পোড়ালে
আমি নষ্ট হতে পারি?