সম্পাদকের কলমে
কবিতাউৎসবের চার বছর। এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর শুধু আমাদের কাছে নয়,
আমরা যারা সরাসরিভাবে যুক্ত এই পত্রিকার সাথে,
সেই পরিবৃত্তের বাইরে সমস্ত ধরণের সাহিত্যপাগল মানুষ যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন , কবিতা নিয়ে নতুন কিছু ভাবতে চান তাঁদের সবার কাছেই এই সংবাদ আনন্দের এবং শ্লাঘার। চারদিকে যখন সার্বিক অন্ধতা এবং বিচারবিমুঢ়তা যার ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা অন্ধ নিঃসাড়তা ছাড়া আর
কিছুই অর্জন করতে পারছি না। সেই প্রেক্ষিতের ভেতর কবিতাউৎসবের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বহুস্বরিক উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তৈরি করেছিল সত্তা ও অপরতার সেতু। নিজেদের চারপাশে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ তৈরি করে তাকেই ভূবনগ্রাম তকমা দিয়ে এক মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে যারা ।তাঁদের এই বিশ্ববিজয় বালখিল্যের উল্লাস ছাড়া আর কিছুই নয়। কৃত্রিম মানচিত্রের অন্দরমহলে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে আরও অনেক সংকীর্ণ অণু মানচিত্রের সীমান্ত। কবিতাউৎসবের প্রথম এবং প্রাথমিক শর্তই ছিল বিভাজনের এই অন্ধ সীমান্তবিন্দুগুলিকে মুছে দিয়ে সত্যিকারের কবিতার এক অমল বাতাবরণ সূচিত করা। এই
অনন্যতাই কবিতাউৎসবের চিন্তা ও চেতনাকে মৌলিক দীপ্তি দিয়েছে। একটু কাব্যিক উচ্চারণে বললে যা দাঁড়ায় তা হল এই উৎসবের প্রতিটি তাৎপর্যই আসলে প্রকল্প তাকে কেউ কখনও চুড়ান্ততায় অবরুদ্ধ করতে পারে না। কোন ক্রিয়ারই শেষ কথা নেই। আয়ুষ্কাল থাকা স্বত্তেও অবসান নেই কোন মানবিক ভূমিকারই। তাই ব্যক্তি নয় সমবায়িক চলাচলের ভেতর দিয়েই সমস্ত উচ্চারণের জন্ম হয়। উৎসব যেমন কোন নির্দিষ্ট সত্তার নয়। সত্তার চেয়ে সমষ্টির অংশগ্রহণই হয়ে উঠে তার প্রাণবিন্দু।জীবন অর্জিত অভিজ্ঞতার ক্রমপ্রবাহের ভেতর দিয়েই অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করে।শিল্প বা সাহিত্যের প্রতিটি প্রশাখাই মূলত সৃষ্টির সমাজতত্ব। সংযোগ ছাড়া বাচকের চেতনা অথবা অবচেতনার রূপান্তর সম্ভব নয়। তাই কবিতা উৎসব তার ওয়েবের জানালায় কবিতার বাকমুক্তি ঘটিয়েই নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। সকলের চিন্তা এবং চেতনাগুলিকে গ্রন্থিত করেছে বিভিন্ন আলোচনার মধ্য দিয়ে ।যার সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও সামাজিক শক্তির সজীব মিথস্ক্রিয়ার সার্বিক প্রকাশ এবং বিভিন্ন উপলব্ধির স্পন্দিত অভিব্যক্তি। Every
Word is directed toward an answer and cann’t escape the profound influence of the answering word
that is anticipates.
নিস্তেজমান এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যদি আমাদের সামাজিক প্রেক্ষিতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব এই স্ফুর্তিময় উল্লাসপ্রবণ সাহিত্যের বাতাবরণে শক্তিহীনের কৃত্রিমতা এবং জড়ত্ব ক্রমাগতই আবিল করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রকৃত সাঁতার না জানা সাঁতারু শুধুমাত্র পাঁকটুকু তুলে আনছে এবং ঘোলা করে দিচ্ছে জলের সমগ্রতাকে।ফলে মানুষের নান্দনিক মননশক্তির সদর্থক প্রত্যাভিজ্ঞান এবং উপলব্ধির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রতি মাসে নিয়মিত একটি ওয়েব প্রকাশ করা এবং তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে গ্রহণীয় করে তোলার জন্য যে মেধা এবং শ্রমের সক্রিয়তা দরকার হয় তা বলার অপেক্ষা লাগে না। কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি ভাষাচিহ্নের প্রতি প্রতিনিধিত্বমূলকতা এবং আত্মবিচ্ছুরণের বিভিন্ন লক্ষণগুলি উত্তরকাঠামোবাদের প্রবণতাকেই সূচিত করে । অর্থাৎ কবিতা কোন বিষয়কে প্রতিফলিত করবে বা করবে না তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু বিভিন্ন স্বরের প্রক্ষেপনের ভেতর দিয়ে কথিত এবং অকথিতের নিরাভরণ সম্পৃক্ত সমগ্রতাই তুলে আনতে হবে। কবিতার নামে শব্দের জাগলারিকে কখনোই গুরুত্ব আরোপ করেনি কবিতা উৎসবের সাম্প্রতিক কাজগুলি। বরং এক সুস্পষ্ট দার্শনিকতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে তার ধারাবাহিক কাজের মধ্য দিয়ে। প্রথা নির্দেশিত সীমাকে চূর্ণ করে সমস্ত সংকীর্ণতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে সকলকে উদবুদ্ধ এবং উদ্দীপিত করার আকাঙ্ক্ষা সঞ্চারিত হয়েছে তার পাতায় পাতায়। কবিতাউৎসব এক নতুন উৎসব যেখানে বস্তবিশ্ব এবং ভাববিশ্বের নিরন্তর বিনিময় ঘটে। এই রূপান্তরের নান্দনিকতা আসলে অণীয়ানকে মহিয়ান করে তোলে।প্রকৃত প্রস্তাবে সময় ও পরিসরের নির্যাস থেকে তুলে আনে নতুন উৎসভূমি।
আজ কবিতা নিয়ে যা
চলছে আমরা ক্রমাগত লজ্জিত হয়ে উঠি। কে অলংকৃত করবেন রাজসভা তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে বাংলা কবিতায়। কবিতা লেখার জন্য রাজানুগ্রহ এবং ক্ষমতার অনুপ্রেরণা কি এতই জরুরি হয়ে উঠেছে?
বাংলা কবিতা তাহলে কোনদিকে ফিরে যাচ্ছে?
আবার কি রাজ দরবারের সভাকবি হয়েই একজন কবির সাফল্য নির্ণীত হবে?
মুখে কবিতার অগ্রগতির কথা বলে প্রকৃতপ্রস্তাবে শেকলকেই কিছু কিছু কবি মনে করছেন অলংকার। এইসব রাজসভার কবিদের জন্য আমাদের করুণা প্রদর্শন ছাড়া আর কীই বা অবশিষ্ট থাকতে পারে। কেরিয়ার লোভী মেরুদণ্ডহীন প্রবীণ বা তরুণ প্রজন্মের কবিদের জন্য আমাদের মাথাব্যথা নেই। তারা যার প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে আত্মগরিমায় ফেটে পড়ছে পড়ুক। কারণ ক্ষমতাহীন প্রজ্ঞাহীন এইসব মানুষের আনুগত্য ছাড়া আর কোন প্রার্থনা থাকে না। বাংলা কবিতাকে দেওয়ার মতো মেধাবী নীলিমা তাঁদের নেই। আর
নেই বলেই কবিতার সজীব উপাদানগুলিকে তাঁরা ধ্বংস করতে চান। একথা বরাকর থেকে ভাতজাংলা অবধি প্রসারিত পশ্চিমবাংলা জানে। জানে তার বাইরে যতদূর বাংলার আকাশ।
এই দুঃসময়ের ভেতরেও কবিতা বেঁচে আছে,
বেঁচে থাকবে। ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে নিরলসভাবে এগিয়ে চলেছে সত্যিকারের সাধনা। যা
যথার্থ কবিতার জন্ম দেয়। সত্যিকারের কবির গলায় কোন শেকল নেই,
থাকে না কখনও। তাই কবিতা স্বাধীন,
মুক্ত এবং সর্বত্রগামী।
উৎসব সকলের তাই উৎসব সুন্দর। কবিতাউৎসব সমস্ত মানুষের সমর্থনে এবং ভালোবাসায় এগিয়ে চলেছে তার লক্ষ্যে। হাতে হাত রেখে সম্প্রীতির রাখিবন্ধনই তার স্বপ্ন। প্রতাপ থেকে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে বহুদূরে তার প্রতিদিনের উৎসব।
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়