সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য
~:একাকী শ্রাবণ:~
যে শ্রাবণ ছুঁয়ে গেলে রুক্ষ নদী পায় নাব্যতা, তার নিজস্ব কালবিক্ষেপে দৃকপাত করিনি কখনও।
শত ঋতুজন্মের আতিশয্যে নিমগ্ন থেকে বিস্মৃত হয়েছি সেই
মোহকাল;
যা কেবল আমারই জন্য রেখেছিলে একাত্মতায়, নির্ভরতায়।এই যে অকুণ্ঠ মায়া
তার সবটুকু জুড়ে ছিল পারস্পরিক অন্বেষণ।
আমি তো বিষাদ সিন্ধুর শোকগাথা হওয়ার বাসনালিপ্ত নই।
শীতকাতরতায় ভীষণ সন্ত্রস্ত চিরকালই। অজেয় সুখের নির্মাণ শেষে একটা মাত্রাহীন
শূন্যস্থান ছিলই। তোমাকে ঈশ্বর ভেবে আবাহন করেছি সেই স্বচ্ছতোয়ায়। বিপন্নতার
কাছে নতজানু হয়ে যে সংজ্ঞা জেনেছি তার সমস্ত ইহকাল জুড়ে শ্রাবণ বর্ষণের সততা এখনও
মিথ্যে নয়।
এই তো সম্পর্ক। আর এখানেই বিস্তৃতির অতলে আমার নাবিক
জন্ম...
~:তবুও বর্ণহীন:~
হয়তো প্রেম তোমারই মতো আত্মবিলাসী অবসরমাত্র, যেখানে ভ্রমণরত অযুত আলোকরশ্মিতে তুমি বর্ণময় রামধনু।
নিজেকে রঙিন করার কারুকার্যে আমার চিরকালীন অপটুতা তোমার
অজানা নয়। বর্ণহীন সিক্ত তুলির আঁচড়ে যে অদৃশ্য ছবিতে ক্যানভাস ভরিয়ে তুলতে তার
স্বীকারোক্তি আমার একান্ত বিলাপমাত্র। যে রুদ্ধতা ক্লান্তিকর তাকে জড়িয়ে রেখো
না। আবেগ শূন্য হলে ফিরে পাবে সেই চোরাগলির একমাত্র মুক্তিদ্বার, যেখানে অপেক্ষারত তোমার চিরকালীন মোহময়তা।
এখন গোধূলির শেষ ছটায় চেয়ে দেখো কোথাও কি বর্ণহীন মেঘ
একেবারেই নেই?...
~:ভিজব বলেই:~
যে অমোঘ নিয়মের কাছে নত হয়েছে আত্মগরিমা তা কি নিছকই
অভ্যাসমাত্র?
সব শোকই আকারবর্জিত হয় না। চলমান প্রবাহ থেকে আটকে থাকা
ক্লেদাক্ত বাধাসমূহ একটু একটু করে জন্ম দেয় অনাকাঙ্খিত সন্তাপ, যা কেবল পুড়তে শেখায়।
তীব্র দহন শেষে যে অকালবর্ষণ অবশ্যম্ভাবী ছিল তা নিশ্চিত করতে
পার করেছ প্রায় একযুগ।
অথচ দেখো, কথা ছিল
একসাথে ছুঁয়ে দেখব শ্রাবণ সন্ধ্যার বারিবিন্দু।
অহেতুক তিতিক্ষার ভারে জর্জরিত করেছ আমার যে প্রেমময়তা, তার শেষ রেশটুকু পারলে কখনও ছুঁয়ে দেখো—এখনও বৃষ্টি নামে রোজ সেখানে...
~:প্রেমে অপ্রেমে:~
শরণার্থীর মতো ফিরে এসেছি প্রেমে ও প্রমায়। এত যে কাঙ্খিত
বাসনা তার সবটাই কি অস্ফুট উচ্চারণের ঘাত-প্রতিঘাত ভাবো? কিছুই কি সঞ্চিত রূপকল্পের পর্যাপ্ত সুখযাপন নয়?
যে প্রত্নতাত্ত্বিক তল্লাশির পর তুমি আবিষ্কারের
উন্মত্ততায় দিকভ্রান্ত হলে, ঠিক সেই
মুহূর্ত থেকে একটি একটি করে আগল বন্ধ করেছি নৈর্ব্যক্তিকতায়। যে রাতের অপেক্ষার
প্রহর গুনে নিয়মের বেড়াজাল অতিক্রম করেছিলে, তার প্রতিটি নির্ঘণ্ট যে জানিয়ে গেছে প্রেমের অন্তিম
সময়কাল। শুধু হিসেবটুকু মেলাতে পারনি নিজস্ব বিভ্রমে।
প্রতিটি জন্মের শেষে ফুরিয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হওয়া অভ্যাসে
পরিণত হয়েছি। এই কি তবে চাওয়া - পাওয়ার শেষ পরিণাম?
দীর্ঘ পরাজয় শেষে এবার নীলকণ্ঠ হতে চাই...
~:নিয়তি অথবা:~
মোহভঙ্গের পর এই প্রথম মাটির গন্ধ ভরে নিলাম জরাজীর্ণ
ফুসফুসে।
যে উৎসের যোগসূত্র ছিঁড়েছিলাম প্রারম্ভিক ক্ষত-নির্মাণের
বিনিময়ে,
তারও ছিল কিছু মায়াডোর।
কত বসন্ত ডেকে গেছে নিয়ত দায়বদ্ধতায়। সেই প্রতিধ্বনি
অনুরণিত হয়েছে শুদ্ধ কল্যাণের করুণ আর্তিতে। অথচ নিদারুণ স্বার্থপরতায় শুধু জারণ
করেছি আত্মগত অপ্রেমময়তা।
নিয়তির কাছে বিস্ময় চিরকালীন। যেটুকু দুর্বোধ্য সংকেত ছিল, তা সমাধানের অহেতুক প্রচেষ্টায় এখনও ব্যর্থ আমি। ফিরতে
চাওয়ার যে বাসনা এযাবৎ লালন করলাম, তাকে আত্মস্থ
করেছ আকিঞ্চনে।
মোহভঙ্গের পর এই প্রথম শুদ্ধ হলাম...