শ্যামা
পদ দে
বিসর্জন
বড়ই অভাগী সে...
ছোট্ট থেকেই দুঃখ নদীর
কষ্ট চরে বাস...।
রোজই তো কতই ভাসে
অনাহারের বন্যায়...।
শত দগ্ধ হয়
অর্ধাহারের প্রখর উত্তাপে...
তবুও! তলিয়ে যায়নি
জীবন নদের হড়পা বানে।
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে
সঙ্গী করেছে আরও এক দুঃখীকে...
কিছুটা পরিত্রাণের আশায়
একত্র লড়াই এ...।
দুঃখীও সঙ্গ দিয়েছে...
না; অনাহার থেকে মুক্তি
নয়...
ভরে দিয়েছে তার শরীর_
তার সাধের কষ্ট বালুচরে
আরও এক অতিথি...
তার স্বপ্ন, তার
নয়নমণি...।
বিশ্বনিখিলের
মালিকানায়...
তার গর্বিত সংসার_
এক আকাশ ছাদের নীচে
শত ছিন্ন স্বপ্নের উড়ান...।
এই তো সেদিন...
একটা আস্ত জ্যৈষ্ঠ সুর্য
বুকে শুষে নিয়েও...
সোনাকে আগলে রেখেছিল
তার ছিন্ন আঁচলের ছায়ায়
পরম মমতায়...।
রাস্তার মোড়ে সবাই যখন
ব্যাঙ পুজো করছিল ...
দূর থেকে সেও তো গলা মিলিয়ে
অস্ফুটে প্রার্থনা করেছিল
"ও মেঘ বৃষ্টি দাও'...।
সন্ধ্যায় নামল রিমঝিম রিমঝিম...
আনন্দে সেও নেচে উঠে ভেবেছিল
তার প্রার্থনা বিফলে যায়নি...।
তাই! মনে মনে মেঘের সুরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলো শীতল
বুকে...
রাস্তায় পড়ে থাকা নিকাশি
নলের
নিরাপদ ছায়ায়...
স- সন্তানে...
নিশ্চিন্ত মনে...।
হায়রে অবোধ !
প্রার্থনা মঞ্জুরেরও যে
...
একটা সীমারেখা থাকা উচিৎ
সেটাও বোধহয় ভুলে
গিয়েছিলেন
স্বয়ং বিধাতা পুরুষ...।
রিমঝিম ক্ষণিকে ঝমাঝম
ঝমাঝম...
অভাগীর শীতল হৃদয়ে ও
জ্বলে ওঠে আশঙ্কার
আগুন...
বুকে চেপে ধরে তার
সন্তানকে,
ওদিকে বাড়তে থাকে
স্রোত...
আর এদিকে বুকের
আগুন...।
না! হেরে গেল সে...
আগ্রাসী স্রোত কেড়ে নিল...
তার প্রাণ রত্ন ধন।
পাগলপারা সর্বহারা...
ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁজতে থাকে
তার প্রাণ মুক্তো...।
কিন্তু! না ভাসানে, না
নিমজ্জনে...
কোথাও পেল না তার স্বপনের সন্ধান।
সবার অলক্ষ্যে ঘটে যায়
একটি স্বপ্নের নীরব "বিসর্জন' ।
এক পাহাড় নিরাশা বুকে...
সেই খানেই প্রতীক্ষা করে
এই প্রার্থনায়......
আবার একটা উল্টো বান আসবে
তার স্রোতে তলিয়ে যাওয়া "স্বপ্ন'
এসে ডাকবে "মা......'
হায়রে অভাগী......।
একলা-আমি
অগ্নিদগ্ধ খড়ের স্তূপ
নিঃসৃত
পুঞ্জীভূত ধোঁয়ার মতোই
বিরহ যন্ত্রণাক্লিষ্ট
হৃদয় থেকে
নির্গত ভস্মীভূত স্মৃতি
স্তূপে
দাঁড়িয়ে...
‘একলা-আমি’।
আজ কচ্ছপের ‘ক্যারাপেস’
এ
সমস্ত যন্ত্রনারাশি...
সযত্নে গোপন করে বার করি
কাষ্ঠ হাসি মুখ।
কিন্তু, তুমিই!
আমার জ্যৈষ্ঠ
রৌদ্র-দীর্ণ
ফুটিফাটা হৃদ ভুমে
তোমার প্রথম আষাঢ়ের
বল্গাহীন প্রেম বরিষণে
রোপণ করেছিলে
ভালোবাসার ভাবী বনস্পতি।
আমিও শ্রাবণের প্লাবন
উচ্ছ্বাসে
বুকভরা নদের গরিমায়
আপ্লুত...।
তোমার ভরসা মাখা হাতটি
ধরে
অন্ধকারেও পেরিয়ে গেছি
বর্ষণ- মুখর নিশি পথ।
কঠোর ভাদ্র রৌদ্রের চোখ
রাঙানি ও
সয়েছি হাসিমুখে, একসাথে_
ফাগুনের কুসুমিত
বনস্পতির আশায়।
কিন্তু হায়!
হঠাৎ আশ্বিনের ঝড়...
উৎপাটিত বর্ধিষ্ণু
চারাগাছ
আশ্রিত অন্যঘরে, সমাদরে...
আর রিক্ত ভূমে, ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে ...
‘একলা –আমি’।
কান্না রঙের আকাশ
প্রচ্ছদ ছিলো বেহায়া
বিকেল
আবহে প্রথম প্রেমের ভেলা,
উষ্ণ বুকে লাজুক হিমেল
প্রথম ছোঁয়া, প্রাণের খেলা।
সন্ধ্যে চোখে প্রভাত
বোনা
উথাল পাথাল নদীর ঢেউ
নিঃস্ব হাতেও অঢেল সোনা
আগুন সুখে ভিজছে কেউ।
হাতের মাঝেই হারিয়ে
যাওয়া
চোখের কোণে খুশীর জোয়ার
আচিন গাঙে নৌকা বাওয়া
সময় পথিক, স্বপ্ন সওয়ার।
চাতক দুপুর অনাথ পথে
নিখোঁজ হওয়া সুখের খাতা
জোছনা কাঁদা রাতের রথে
একলা জাগে চোখের পাতা।
কান্না রঙের আকাশ আঁকা
বিনি ঘুমের বালিশ জুড়ে
বেদন পাখি মেলছে পাখা
সোনার খাঁচা পুড়ছে
দূরে।।
কথা ছিলো
কথা ছিলো নামবে বিকেল_
রইবে হাতটি হাতে,
খেই হারিয়ে সন্ধ্যে নামে
বৃষ্টি আঁখি পাতে।
কথা ছিলো পথ হারাবে_
অচিন পথের বাঁকে,
সাথী হারা একক কপোত
কাঁদছে বকুল শাখে।
কথা ছিলো মেঘ-বালিকা
খেলবে খোলা চুলে,
চাতক হয়ে বৃষ্টি খোঁজে
মনের অবুঝ ভুলে।
কথা ছিলো জোছনা রাতি_
পরিয়ে দেবে মালা,
মেঘের আড়ে সন্ধ্যে তারা
সইছে দহন জ্বালা।
কথা ছিলো স্বপ্নের জাল_
বুনবে হৃদয় জুড়ে,
ছেঁড়া তারেও মলিন বীণা
বাজছে বেহাগ সুরে।
কথা ছিলো উছল নদী_
ছুটবে সাগর মাঝে,
গোপন তৃষা স্রোত হারিয়ে
বইছে অশ্রু সাজে।
কথা ছিলো রাখবে কথা_
সুখের পাহাড় বেয়ে,
ভুলের পাহাড় নীরব ব্যথা
ভাঙছে আকাশ হয়ে।
কথা ছিলো মনের আকাশ_
সাত রঙেতে ভরবে,
জানতো কেবা নীল পরীরা
ধূসর ডানা মেলবে।।
ভগ্ন ধ্রুবক
অনেক নিরুপমার চোখের জলে
অকাতরে ভিজিয়েছি বুক_
এবার একটু আড়চোখে চেয়ে
দেখ
আত্মবলিদানে নিরূপের সুখ ।
দৈন্যতা নিত্য সঙ্গী, তবুও দীনবন্ধু_
হাসিমুখ, লড়াই,
শরীরে অজান্তে গুপ্তক্ষয়...।
তবুও টেনে চলা সংসার
রথের রশি
অকাল ছিন্ন, অকূলে পাড়ি...
রেখে অভাগী বিধবা ও
অপরিণত মৃত্যুঞ্জয় ।
নামে মৃত্যু জয়ের শপথ,অভাবী সংসারের নির্দয় পথে
আন্ধকার চোখে ধ্রুবতারা, সাথী 'মা'।
কিন্তু! সংসারে সদস্য
ধ্রুবক রাখার প্রবল ইচ্ছে বুকে
হয়তো কিছুটা শোক প্রশমনে মায়ের অকাল বধূবরণ ।
তাই টাটকা শোক মাখা
অগোছালো বরণডালায়
প্রাণভরে স্বাগত
জানিয়েছিল তাঁকে ।
ছেলেও সদ্য যৌবন প্লাবনে
ভেসে সাততাড়াতাড়ি
সংসার তীরে আবাহন করে
ভালোবাসার নতুন ফসল ।
ভরা সংসার, কিন্তু হায়,
বিধি বাম!
ঐ এ সংসারে সদস্য সংখ্যা
নাকি ধ্রুবক!
ভারসাম্যের নির্মম কোপ
অবশেষে
নবস্বপ্নে বিভোর হতভাগী বিধবার উপর।
নববধূর নিপুণ দখল
দক্ষতায়
নতুন শোক পাথর বুকে
বিতাড়িত মা।
মা তাড়ানোর যন্ত্রণা, সন্তানপালন ...
একলা কাঁধে বয়ে চলা দুঃসহ
বোঝা।
না, তাও সহ্য হল না বিধাতাপুরুষের_
তার প্রেম-মোহ নিমজ্জিত
পরকীয়া বাণে।
মৃত্যু কে জয় নয়, অসহায় আত্মসমর্পণ_
অবলীলায় আত্মাহুতি নীল
বোতলে।
সংসার সংগ্রামের ন্যায়
জীবন সংগ্রামেও...
কদিনের অসম লড়াই, কাঙ্খিত পরাজয়
স্বপ্নের লাশ আঁকড়ে
ফিরতি মায়ের হা-হুতাশ...
চোখ সমুদ্রে অনিবার্য
মরুভূমি...
আবার শূন্য ঘরে ধ্রুবকের
সুত্র ভাঙা একাকী দীর্ঘশ্বাস ।।