রীনা
তালুকদার
আমার কোনো দুঃখ নেই
দুঃখ কোনো দুঃখ নেই
যার থাকে থাক
কারো কাছে কিছু চাইনা
চাইবার কোনো দরকার নেই
ভালোবাসা নয়, করুণ দৃষ্টি নয়
বিপদকালীন আশাবাণী নয়
হতাশায় আশ্বাস নয়
শ্বাপদ অরণ্যে একাকি
চলছি
দুঃখ তাপে ঝলসানো সব
সুখের চিহ্ন মাত্র নেই
বুঝিনা দুঃখ সুখের
ভেদাভেদ
সুখ খুঁজিনা; খুঁজতে চাইনা
খুঁজতে চাই না কোনদিন
কেবল দুঃখ ভাব কম হলে
ভাবি;
এইতো আছি ভাল।
সুখের কোনো বাড়ী নেই
সুখের কোনো বাড়ী নেই
ঘরবাড়ি সব দুঃখের
সুখের ক্ষণ স্থায়ী অনুভব
দুঃখ ধরে রাখে বিত্ত
বৈভব
তবুও সুখের পেছনে নিরলস
ঘোরা
পিছুটানে মানুষ ফেরারী
আসামী
সুখ-সুখ খেলায় মেতে ওঠা
সুখ আছে দূরবীনের কাঁচে
দূরে দেখা
সুখের অসুখে মগজে জমে
জটা
সুখ আগুনে দিশাহারা মন
ক্ষোভ-লোভে সে থাকে
উচাটন
পাবে পাবে স্বপ্নের ঘোরে
দুঃখকেই ঠাঁই দেয় আপন
ঘরে
সুখ আদরে ভীরু স্নায়ু
ভেসে বেড়ায় দুঃখের অগ্নি
তরঙ্গে।
যে দুঃখ দেয়
যে দুঃখ দেয় সেই তো
ভালোবাসে
ভালোবাসলেই দুঃখ এসে ভীড়
জমায়
দুঃখের সাথে ভালোবাসার
দারুণ নিবিড়তা
সব দুঃখ জীবনে এক রকম
অর্থ বহন করে না
কিছু কিছু দুঃখ খুব কাছে
থেকে
দুঃসহ দহনের ধোঁয়ায় পোড়ে
ভালোবাসা সুদূর হলে
শত্রু হয়
তুমি শত্রু বলেই আমি ভাল
আছি
নিজেকে গুছিয়ে রাখার
তাগিদ থাকে
তুমি দুঃখ দিলে তা মন
মান মন্দিরের
নক্শী খিলান ছুঁয়ে যায়
আমি সেই দুঃখের পূজায়
সময় পার করি
তুমি দুঃখই দাও; জমতে থাকুক দুঃখের কালি
পূজার থালায় অর্ঘ্য হয়ে
আমি ভালোবাসাই দিবো।
অধ্যাপক নির্মল চৌধুরী
সবে মাত্র কলেজের অধ্যাপক
হয়ে এসেছেন
অল্প বয়েসী নির্মল
চৌধুরী
মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা
দাড়ি
দেখেই মনে হয় উঠতি
বয়েসের যৌবন ছাপ
পাকা লিচু অধর
নাকটা একেবারে গিরিখাতের
ভঙ্গিতে খাড়া
দু’চোখের তারায় কেঁপে ওঠে চন্দ্রনাথ পাহাড়
হাসি মাখা ঠোঁটটা বন্ধ
থাকলেও মনে হতো
অনেক অনেক চিত্র কথার
ভিড়
মুখ দেখে মনে হতো
যেনো অ-নে-ক কালের চেনা
ক্লাসে যখন বাংলা পড়াতেন
ব্যালল তাকিয়ে থাকতাম
আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের
ছাত্র
নদীর স্রোত উপছে পড়া স্বপ্ন চোখে
হৈমন্তী গল্প শুনে
নিজেকে কতবার অপূর্বর স্ত্রী মনে করেছি
আর নির্মল চৌধুরী আপনাকে
মনে হয়েছে
গভীর প্রেম পূজারী
অপূর্ব
বিলাসী গল্পে উত্তাল
প্রেম তরঙ্গে ভাসতাম
আপনাকে নিয়ে সেই
পাহাড়-বন-জঙ্গল পেরিয়ে
মৃত্যুঞ্জয় ভেবে মনে মনে
ওঝা খুঁজতে যেতাম
তৃষ্ণায় বিদূর তাকিয়ে
থাকতাম থ হয়ে
কখনো খুব একটা রাগ হতেন
না
মনে আছে একবার-
দুষ্ট এক ছাত্রের
প্রশ্নে খুব ক্ষেপেছেন
তখন দেখলাম সরু নাকটা
শ্রী মহাশয়ের কেমন ফুলে
ওঠেছে
যেন ফেটে যাওয়া পাকা
ডালিম
আপনার মায়াবী মুখটা যতই
দেখতাম
ততই আপনার প্রতি ভীষণ
দুর্বল হয়ে যেতাম
আপনি অবশ্য কখনো জানতে
পারেননি
আর জানবেন কী করে
কখনো তো সাহস করে বলা
হয়নি
একবার দীর্ঘ সময় ছুটির
পর
কলেজ খোলার প্রথম দিনে
খুব অস্থিরতায় আপনাকে
দেখতে যাই
আপনার অফিস কক্ষে
তখন খুব সাহস করে বলতে
চেয়েছিলাম
বুকের কন্দরের ভাঁজে
লুকানো অভিসার কথা ;
আমাকে দেখেই ঢুকবার
অনুমতি দিলেন
তারপর হঠাৎ আপনার
অনামিকায় চোখ পড়ল
এরই মধ্যে আপনি যেনো কী
কী প্রশ্ন করলেন
আমি তার কিছুই শুনতে
পাইনি
মনে হলো ভরা শ্রাবণে পথ
না পেয়ে
উজানি জল সাংঘাতিক
এলোমেলো
আপনি কোনো সাড়া না পেয়ে
আমার দিকে চেয়ে কিছুটা
অপ্রস্তুত হলেন
সম্ভবত: বুঝে নিলেন আমার
চোখের ভাষা
তখন পরিবেশ বদলাতে আপনি
খুব জোরে হেসে ফেললেন; আর বললেন ঃ
কাল থেকে আরো কিছু দিন
ছুটি নিচ্ছি
আর সামনে তোমাদের
পরীক্ষা
প্রয়োজনীয় সাজেশন দিয়ে
দেবো;
তারপর যতবার দেখা হয়েছে
উচ্ছলতা নিয়ে কারণে
অকারণে ক্লাসে
কোনও প্রশ্নের উত্তর
জানতে
আপনাকে অযথা বিব্রত
করিনি
সমুদ্র তরঙ্গ হাসিটা
চুপসে গিয়েছিল একেবারে
আপনি খুব খেয়াল করেছিলেন
এসব
কিছু দিন পর কলেজের মধ্য
মাঠে একা পেয়ে বলেছিলেন :
মানুষের সব চাওয়া কখনোই
পূরণ হয় না
সে-ই আপনার সাথে একতরফা
নীরব কথন পর্ব সমাপ্ত
অথচ মনের কোণে আপনার-
উঠতি বয়েসের যৌবন ভরা
মুখখানি
দীর্ঘ কুড়ি বছর কারণে
অকারণে ভেসে ওঠেছিল
তবুও সাহস করে আর কোনো
দুঃসাহসি হতে চাইনি
আজ হঠাৎ স্টেশনে দেখে-
সেই পুরনো লজ্জার
লীলাবতী রেশ ধরে; কথা
বলছি যখন
তখন আড় চোখে দেখছি খুব
স্বাভাবিক আপনি
বললেন ঃ যে এসেছিল সে
একা করে চলেও গেছে
মাঝখানে দিয়ে গেছে কেবল
আধফোঁটা ফুলকলি
শোনামাত্রই, এতদিনের অজানা অভিমান
ঝরে গেলো আমার অজান্তেই
মনে হলো আমিও পেরিয়ে এসেছি
অ-নে-কটা পথ
যে দিন এ ঘরের দরজাটি
ছিল খোলা
সেদিন আপনি বন্ধ
করেছিলেন ওদিকেরটা
আর আজ বন্ধ আমার এ ঘরের
দরজা
অধ্যাপক নির্মল চৌধুরী
এ-ই মানুষের জীবনের সরল
অংক
জটিল রূপে থাকে।
কবিতা সত্য শক্তির
মনুমেন্ট
কীর্তি অমর হলে লাগে না
কিছু
মানুষ অমর না তার কীর্তি
কথা
মাটিতে মাটি সার হয়
রাসায়নিক গুণে
বীজ পড়লে সালোক সংশ্লেষণ
সজাগ
সমাধি অমর হয় কী হাড় গোড়
নিয়ে ?
সৃষ্টির ঘোষণা মানুষ
মাটির সৃষ্টি
লোকান্তরেও মাটি হয়ে
যাওয়া
প্রকৃতির ল্যাবরেটরীতে
বস্তুর ধর্মানুযায়ী
মনুষ্য দেহ তৈরী করবে
জৈবসার
বাধ্যতামূলক বেকার কর্ম
তার চেয়ে সৃষ্টির
আনুগত্যে
হাসপাতালে হোক উৎসর্গ
কাজে লাগুক জ্যান্ত মৃত
হাতির মূল্যে
কবির মৃত্যু নেই মৃত্যু
অমর হয় কবিতায়
ভাল লাগা কবিতাই শ্রেষ্ঠ
সমাধি
সতীর্থরা যুগে যুগে
শ্রদ্ধায় স্মরণে
চিত্ত থেকে অনুভব করবে
মাটির সমাধি বিবর্তনে
হারিয়ে যায়
আদম হাওয়ার সমাধি কোথায়
!
কোথায় বড়–চন্ডীদাস কেউ জানে না
চর্যাপদ যুগের ধারায়
শ্রেষ্ঠত্বে সমুজ্জ্বল
মাটির সমাধি হোক না হোক
আপত্তি নেই
কবিতা আমার মানুষের
হৃদয়ে
সত্য শক্তির মনুমেন্ট
হোক।
কবিতা হোক কিংবা
মৃত্যু
কবিতাকে আষ্টে পিষ্ঠে
আঁকড়ে ধরেছি
হারিয়ে যাবার রাস্তা
বন্ধ
তালা এঁটে চাবি রাখা জগত
সৃজনের সিন্দুকে
কবিতা অবাধ্য কিশোর
উদ্দীপণ
সিঁধ কাটে মাটির ঘরে
পাহারায় চৌদিকে কলম
দাঁড়কাক
তবু ছাড়িনা কোনো অজুহাতে
কবিতার হসন্তী বুকে
চিত্র আঁকা যাপিত জীবনের
কুঁড়ে ঘরে জন্মেছে
একসাথে থাকতে হবে
বোমা-গুলি যা আসুক কঠিণতম
সমরে
হয় কবিতা থাকবে নয় কবির
মৃত্যু হবে।
রীনা তালুকদার:নব্বই দশকের কবি, গবেষক।
সাবেক ছাত্রনেতা (ছাত্রলীগ)। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ। সহ-সভাপতি, (তথ্য ও প্রযুক্তি)- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। বিভাগীয়
সম্পাদক-অনুপ্রাস সাহিত্য পাতা দৈনিক নব অভিযান এবং দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা। বাবা
-মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম। পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম -২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা-লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৩টি, গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও কাব্য কথায়
ইলিশ), সম্পাদনা কাব্যগ্রন্থ-১টি, ‘জাগ্রত’ ছোট
কাগজের সম্পাদক, সহযোগী সম্পাদনা (বিষয়ভিত্তিক)-
১১টি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- সাত মার্চ
শব্দের ডিনামাইট (বঙ্গবন্ধু সিরিজ), বিজ্ঞান
কবিতা, প্রেমের বিজ্ঞান কবিতা, স্বাধীনতা মঙ্গলে, বিজ্ঞান সনেট। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় নব্বই দশকে। লেখালেখির জন্য বীর
মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর মহান বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও
সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন।