শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে



সম্পাদকের কলমে


এবার আষাঢ় আসার দরকার। ঘন কালো মেঘের দিগন্তে জ্যৈষ্ঠের তাপদগ্ধ ঝলসানো শরীরে বর্ষার আমেজ আসুক নেমে। ঠান্ডা হোক বাতাস। জলসিক্ত হোক মাটি। বাংলার বুক জুড়ে নামুক বর্ষা। বৃষ্টিমুখরিত সকাল সন্ধ্যায় রোমান্টিক হয়ে উঠুক মন। ক্ষতি কি। পূর্ণিমার ঝলসানো রুটির মত চাঁদ জ্যোৎস্নায় বাংলা ও বাঙালির নাভিশ্বাস উঠুক না উঠুক, জাতি ও সমাজ কেউই কিন্তু ভালো নেই। একে গরম তারপর রাজনৈতিক তাপ উত্তাপের নির্বাচনী পারদে ঝরে গিয়েছে অনেক প্রাণ। তা যাক। এত বড়ো একটা নির্বাচন, তাতে দু একটা কে মরল, না কানা খোঁড়া হয়ে পড়ে রইল, তাতে গণতন্ত্রের কিছু যায় আসে না। যায় আসে না সেই সংবিধানেরও, যার আওতায় প্রতিটি নির্বাচনেই মৃত্যু মিছিল অব্যাহত থাকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কার্যক্রমে। যায় আসে না, সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও যাদের নির্বাচিত করার যজ্ঞেই আহুতি দিতে হয় সাধারণ মানুষকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই। না, যায় আসে না সাধারণ জনসাধারণেরও, যাদেরই কেউ না কেউ বলি হয় জনপ্রতিনিধিদেরকেই এক একটি নির্বাচনের বৈতরণী পার করিয়ে দিতে গিয়ে। খবরের কাগজের হেডলাইন আমাদের দৈনিক জীবনের ছন্দে ছন্দপতন ঘটায় না কখনো। এসবই তো গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পরিণতি। একটা না একটা দলকে তো ক্ষমতা দখল করতেই হবে। আর ক্ষমতা দখলের এই রাজনীতি মানুষের সমাজের আদি থেকেই বর্তমান। কোন কালেই এমন কোন রাজাধিরাজ জন্মাননি, যাঁর হাতে মানুষ নিধনের রক্ত লেগে নেই। তাই আজকের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন যজ্ঞে দুই একটা নরবলি হবে, এ আর এমন অস্বাভাবিক কি। তাই আমরা সেসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমরা বরং পতাকার রং দেখে বিজয়মিছিলে সামিল হই, বা দুই হাত তুলে বাহবা দিই। সেই বিজয় মিছিলেও যদি দুই একটা লাশ পড়ে যায়, যেতেই পারে। রাজনীতির ধরণই তো এমন। স্বাধীন দেশের স্বাধীনতায়।

যাই হোক নরমেধ যজ্ঞের সেই রক্তের লাল রঙ ধুয়ে যাক আর নাই যাক, এবার নামুক বর্ষা। আষাঢ়ের দিগন্ত জুড়ে ঠাণ্ডা হওয়ায় শীতল হোক শরীর, আমরা যারা এড়িয়ে যেতে পারি, বা পেরেছি মৃত্যুমিছিলের সংখ্যাতত্বের হিসাবে নাম লেখানো থেকে। অবশ্যই আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কে থাকলো কে গেল কি হবে সেই হিসাবে? এই পৃথিবী জয়ীদের পৃথিবী। এই বিশ্ব জীবতদের বিশ্ব। এই জীবন, উদযাপনের উৎসব বই তো নয়। তাই পরিপ্রেক্ষিত যাই হোক না কেন, আমরা আষাঢ়ের পদধ্বনিতে কান পেতে উৎকর্ণ। সান্ধ্যটিভিতে নজর রাখি, আবহওয়া অফিসের বার্তায়। কতদূর এগলো বর্ষা। পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে আষাঢ় খুঁজে ফিরি। আসবে, সে আসছে। অপেক্ষা আর একটুর শুধু

আসলে সমষ্টি নয়, সমাজও নয়, নিজেরটুকু নিয়েই আবদ্ধ আমরা। নিজের মধ্যেই নিজে আটকিয়ে রয়ে গিয়েছি। তাই শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের গণ্ডীতেই আমাদের আঁতুর ঘর থেকে শেষযাত্রার আয়োজন। আমাদের আষাঢ়েরও চলাচল সেই স্বল্প পরিসরের ভিতর দিয়েই। যে যার নিজের মতো করে আষাঢ়কেও ভাগ করে নিয়েছি। না এ কোন আষাঢ়ে গল্প নয়। কবি বলবেন, এটাই জগতের বৈচিত্র। না হলে জগতের লীলা বোঝা দায়। না হলে জগতের মাধুর্য্যই যে নষ্ট। তাই ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ বিশেষ ভালো লাগা ও না লাগা, এত মূল্যবান। হয়তো সেই পথেই এক আষাঢ়ের নানান রূপ নানান মানুষের অনুভবে। এটাই হয়তো জগতের বিধান। সবকিছুরই সমষ্টিকরণ সুখকর নয়। সম্ভব নয়। তাই কবির অনুভবের আষাঢ়ের সাথে কৃষিজীবী মানুষের অনুভবের আসমান জমীন ফারাক। একজনের সৃষ্টি সুখের উল্লাসের সাথে আর একজনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম জীবনজীবিকার একান্ততার মিল না থাকারই কথা। এইভাবেই হয়তো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির ভিতরে আষাঢ় উপস্থিত হয় ভিন্ন থেকে ভিন্নতর মাত্রা নিয়ে।

অনেকেরই স্মরণে থাকবে কৈশরের নিষ্কলুষ সময় পর্বে আষাঢ়ের আগমন। বিশেষত গ্রাম বাংলার জীবনধারায়। তার রূপ রং মাধুর্য্য একরম। যার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর অনুষঙ্গে উপস্থিত হয় যৌবনের আষাঢ়। ঝমঝম বৃষ্টিমুখর কালো মেঘে ঢাকা সেই আষাঢ়ের বৈভবের সাথে বুঝি আর কোন কিছুরই তুলনা হয় না। যৌবনের অবগুন্ঠন খুলে সে আষাঢ় যেন জগত আর জীবনের এক ঐকান্তিক সাঁকোর মতো। জীবন যখন তার সকল সম্ভাবনায় ভরপুর। সৃষ্টিবিন্দুর উপর দাঁড়িয়ে অনাদী অনন্তের সাথে তার চিরন্তন মিতালী। সেও আষাঢ়ের আর এক রূপ। এই রকম ভাবেই আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্বেই বারে বারে আষাঢ় ফিরে ফিরে আসে নতুন থেকে নতুনতর রূপে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর অনুভবে। কত বিচিত্র বৈভবে। আর সেই বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর বৈভবেই রূপ নিতে থাকে বাংলার সমাজজীবনে আষাঢ়। ব্যক্তি আর সমষ্টির দ্বন্দ্ববিধুর সমন্বয়ের ভিতর দিয়েই।

সেই সমন্বয়ের রেখাচিত্রেরই একটি দিক হতে পারে কবিতা। হতে পারে বলিই বা কেন, হয়েই ওঠে বলা ভালো। কবিচিত্তের ক্যানভাসে আষাঢ়ের বিচিত্র লীলায় বাংলার মানসপটে প্রতিফলিত হয় বর্ষণসিক্ত মননের চিরন্তন বৈভব। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেও এক অনন্য অধ্যায়। সেই অধ্যায়েই অঞ্জলি সরূপ কাবিতাউৎসবের এবারের আয়োজনে তাই বৃষ্টিমুখর কবিতার এক অনন্য কবিতাসংকলন। অংশগ্রহণে দুই বাংলার কবিবৃন্দ। শতাধিক বৃষ্টিমুখর কবিতার এই সংকলনের নিবেদনের ভিতর দিয়েই আসুক না হয় এবারের আষাঢ়। অশান্ত বাংলা ও বিভ্রান্ত বাঙালির সমাজজীবন ভিজে উঠুক মানবিক সংবেদনশীলতার সহৃদয় ধারায়। ধুয়ে যাক মুছে যাক সমস্ত গ্লানি। ক্ষত বিক্ষত এই সময়ের চালচিত্রে প্রলেপ লাগুক নবসৃষ্টির নবউদ্যম নতুন উদ্যোগে!

৫ই আষাঢ় ১৪২৬