বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৯

এমাসের অতিথি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল




কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  ১৪২৫

কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: অনেক ভালোবাসা 'কবিতা উৎসব কে কবিতার জন্য কবিতা উৎসবের এই অন্তরের প্রয়াসকে আমিও অন্তর দিলাম কোনোদিন ভাবিও নি আমি কবিতার সাথে  দিন কাটাবো রাত কাটবে  আমি যখন কবিতা লিখতে আসি  তখন ব্লগ বা অনলাইন ম্যাগাজিনের কোনো অস্তিত্বের কথা আমার জানা ছিল নাহয়ত ছিল না আমার দেশে   ক্লাসের কবিতা পড়তে পড়তে কিছু ছন্দ কিছু লাইন মনের মাঝে জোনাকির মত দপ্ দপ্ করত সেটা আনন্দ না কি কষ্ট তাও বুঝতে পারতাম না  বাড়ির সকলের আড়ালে এমন কি  ক্লাসেও লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেই নিজের লেখা খাতাটা খুলে  পড়তামভয় পেতাম যদি কেউ দেখে ফেলে এই কবিতা  কবিতা আমাকে তাগাদা দিয়েছে কবিতা লিখতে,  তাও আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে  এর জন্য আমিও ছটপট করতামনুতন লেখা,  তাও আবার গুচ্ছ  এভাবে কবিতা উৎসব আমাকে দিয়ে অনেক কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে   এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ           


কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে মনে হয় আপনার।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: কবিতা লেখার শুরুতে কবিতা লেখা হতো কাহিনী ভিত্তিক অথবা বর্ণনামুলকআমি ছন্দের কথা কিংবা ছন্দহীনতার বলব না,  কেন না মনে করি প্রত্যেক কবিতার একটা সুপ্ত ছন্দ আছে  যেমন  সকালের এক ছন্দ আছে, বিকেলের আছে,  সন্ধের আছেতেমনি কবিতার থাকেইসেটা বুঝে নিতে হয়মহাবিশ্বে ছন্দ বিহীণ কিছুই হয় নাসেই প্রভাবে আমিও প্রভাবিত ছিলাম  যেমন বলতে পারি  - কোনো এক শীতের সকালে  আমি মাদুর পেতে সূর্যের দিকে পিঠ করে আমাদের উঠোনের সামনে   বই খাতা বিছিয়ে পড়তে বসেছিদুটো শালিক ডানা ঝাড়তে ঝাড়তে পালকের পোকা খুঁটে খাচ্ছে  আর লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে  আসছে আমার  পাতা মাদুরের কাছে  আমি লিখে  ফেলেছিলাম  ' শীতের সকাল  সেই ছিল আমার প্রথম  লেখা  যে লেখাটা প্রবন্ধের মত মনে হয়েছিল   কবিতাটি ছিল বিষয় কেন্দ্রিক  প্রচুর আবেগ ছিল,  কিন্তু মেধা প্রায়ই ছিল না বললে চলেহুজুগে আর যাই হোক কবিতা হয় না, অনেকেই মনে করেন  - উনিও লিখছেন ,  আমি লিখিব কেন - 'পথ দিয়ে জল গড়িয়ে যায়   কিন্তু তারপর?? হুজুগ মরে যায় একদিনকবিতা লেখার জন্য তপস্যার প্রয়োজন রত্নাকরের মতোতবেই না রামায়ণ সৃষ্টি হবে   


কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক বিকাশ, কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন এই বিষয়ে।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: কবিতা আসে আবেগ দিয়েইআবেগ না থাকলে কবিতার জন্ম হয় নাকিন্তু কবিতার জন্ম মুহূর্তে ওই আবেগ  অস্তিত্ব বোঝা যায় নাতখন শুধুই আনন্দসে এক আশ্চর্য শিহরণকিন্তু সেখানে আত্ম নির্ভরতা থাকে নাকোন বিশ্বাসের জগৎ গড়ে ওঠে নিআর এই আবেগকে বাঁচাতেই অভিজ্ঞতা প্রয়োজন,  প্রয়োজন জীবনবোধআবেগ সদা চঞ্চল,  অকারণ লম্ফনে উল্লাস প্রকাশ করা তার অভ্যেস তাকে সংযত করার প্রয়োজন অবশ্যই প্রয়োজনতা সংযত করতে পারে তার  একান্ত জীবনবোধ  আমি লিখলাম  - ' রোদ দেয়ালে আটকে আছে শিশু কান্নারাতার পাশে / মায়ের ভেজা কাপড়,  হাওয়া ঝাপটাচ্ছে দুপুর বেলায় -  / এখন ভাত ফোটার সময়, /  খিদেরা  সারি সারি দাঁড়ায় প্রার্থনায়    এখানে দেখা যাচ্ছে আমাদের যাপন   কারও প্রভাবে নয়, সে সততার সঙ্গে কুমোরের হাতে গড়তে থাকবে কবিতাসেখানে জীবন কাঁদবে হাসবে আবার সংগ্রামও করবে       


কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন। একবিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল:   এ তর্ক চলছেইবর্তমানে আপনাদের প্রশ্ন দেখেই  মনে হচ্ছে চলতে থাকবে আরও কয়েক ' শ বছর  আমাদের সংস্কারে শ্লীলতা আর অশ্লীলতা বিষয়টি লুকিয়ে আছেসেখান থেকে না বের হতে পারলে তা থাকবেইএ সবই পথের পাশে ফুটে থাকা আনমনা ফুলতাকে তুলে আনলেই যত বিভ্রাটকোথায় রাখি তাকেএই রাখার জায়গা নিয়েই অস্বস্তি শুরু হতে থাকে মনে   আসল কথা হল মানসিক ভাবে প্রস্তুত হওয়াসংস্কারটাকে  একই ভাবে জিইয়ে রাখব নাকি নতুন ভাবে আবিস্কার করব    


কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল:    সাহিত্যের বিরাম বলে কিছু নেইকেবল এগিয়ে যাওয়া,  এগিয়ে যাওয়াশুধুই চরৈবেতি এই হলো  সাহিত্য সাধনার মূল কথাকোনো থামা নেই,  নেই কোন বাসস্টপ কিংবা স্টেশন  নেই  সেই শুরু  এক নক্ষত্র থেকে আর এক নক্ষত্রেরাত আসুক,   দিন আসুক  এ এক আকাশনক্ষত্র জীবন এই আকাশেই ফিরে আসে নতুন স্নিগ্ধ  আলোয়  শিশির সাথে নিয়ে  এভাবেই  জীবন বদলে যায় কিন্তু   বাংলা সাহিত্যে থাকেন রবীন্দ্রনাথ নাথতিনি বাঙালি কবি,  এমন কি নোবেলের কারনে  বিশ্ব কবিওসেই তুলনায় নজরুল এবং জীবনানন্দ  পুরোপুরি বাঙালি কবি৷ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পরেই বাংলার কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ বেশ জনপ্রিয়বনলতা সেন নামক চরিত্রটি ঘুরতে থাকেন রূপসী বাংলায়  তাঁদের তৈরি পথ কেউ স্বীকার করে নিয়েছেন,  কেউ আবার অস্বীকার করেন জোর গলায় তাতে বাংলা কাব্য সাহিত্য ক্ষতি হয়নি বরং এগিয়ে গেছে কয়েক ধাপজীবনকে দেখা গেছে কিংবা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন এ্যঙ্গেল থেকেঅপারেশন রিসার্চের মতো অনেক জগৎ খুলে যাচ্ছে কাব্য সাহিত্যে  যদিও অনিশ্চয়তা আছে প্রচুর, তবে  অতীত ভাবনাগুলো পাল্টে   একটা গ্র্যান্ড  কনসেপ্টের দিকে এগিয়ে  যাচ্ছে বাংলা কবিতা                


কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: সত্যিই তো, আর কত পথ হাঁটতে হবে?  রাত কতটা গভীর,  কতটা আলো আসছে জানলা দিয়ে,  তার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে নাহয়ত পরিমাপ করা যেতে পারে আলোর পরিমান  তবে তা অঙ্ক হয়ে যায় সমালোচনা দেখে  পাঠক কবিতা পড়ে শতাংশ হারে সামান্যতা কবিরা উপেক্ষা করতেই পারেনসমালোচনা কবির কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হতে পারে,  তবে কবিতা পড়া পাঠকের কাছে  কোন গুরুত্ব আছে বলে আমি মনে করি না 


কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: কবি আর সমাজ দায়বদ্ধ মানুষ  দুজনের  চরিত্র  আলাদাএকজন কেবল সৃষ্টি করেন, অন্যজন তার চারপাশকে সুস্থ রাখার জন্য চিন্তা করেন  এক জনের মধ্যে দুজনের চরিত্র থাকতে পারেকিন্তু দুজনের কাজ আলদা সামাজিক দায়বদ্ধতা কবির কবিত্ব হরণ করে নেয়   কবিকে তার সমাজের অন্ধকার দূর করার জন্য লিখতেই হবে তার কোনো বাধ্যতা নেইএকজন কবি হিসাবে আমি কবিতার  সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী নই  আমার দায় আমি নিজেইসেখানে প্রাকৃতিক ফসল নির্মান করা হয়েছেনির্মিত হয়েছে  আলপথ,   ধান গাছ,  নয়ান জুলির শালুক কেন না আমাকে কোনো কিছুই তৈরি করতে বলা হয়নিযা করেছি  আমি নিজে থেকেই করেছি        


কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি। না কি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: মহত্বর সৃষ্টি বলুন কিংবা তার বিপরীত, যাই বলুনআসল কথা হচ্ছে কবিতার বাঁচা নিয়ে  সে কতদিন বাঁচবে  কিংবা তার  আয়ু কত? কে কিভাবে কথা বলবেন, তার মাত্রা তার গমকের উপর নির্ভর করবে,  কবিতা কাকে কতদিন ছুঁতে পারবে   যে কবিতা রাজনীতি কিংবা নির্দিষ্ট কোন সময়ের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে যায়, ওই সময়টুকু হারিয়ে গেলে সে কবিতাও হারিয়ে যায়ক্ষণিক উন্মাদনায় হয়ত আকাশে ফুলঝুরি হওয়া যায়,  প্রদীপ হওয়া যায় না            


কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজআপনিও কি সেই মতে বিশ্বাসী? আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়। একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে আপনার মনে হয়?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল:  এটা মানছি যে এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে না থাকলে কবিকে একা হয়ে পড়তে হয়  কবির মান থাকে না সম্মান থাকে না সেই কবির পরিচয়ে ফ্লাড লাইট জ্বলে  নাএমন তো নয় কবির কলম বন্ধ হয়ে যায়  তিনি লিখতে থাকেন  নির্জনে কিন্তু ওই যে তৃতীয় রিপু, সেই লোভ সম্বরন করা সত্যিই কষ্টের  টাকা,  নারী, সর্বোপরি চেয়ার যা  তোমার শেকড় টেনে উপড়ে ফেলবে   বর্তমান চলছে এস্টাবলিশমেন্টের যুগতার জন্য তারা সব কিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত,  নিজের হৃদয়ের কথা বাদ দিয়ে হৃৎপিণ্ড জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুতদেখুন আপনাদের চারপাশে ঝুড়ি  ঝুড়ি উদাহরণআর সব চেয়ে বড় কথা যাঁরা এসব কথা বলেন তারা কোন না কোন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েই বলেন          


কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব সর্বজনবিদিত। আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি কারা?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল:  হয়ত আছে  আমি তা জানি না চোখের পলক নিয়ে যে মানুষটি কচুরিপানা দেখে, নাবাল বেয়ে নামা আলপথে চাষি বউয়ের গোরুকে জাবনা খাওয়ানো দেখে এবং সে সবই লিখে ফ্যালে লুজ কাগজের পাতায়তার লেখায় বিশ্ব সাহিত্যের প্রভাব পড়তেই পারেপ্রভাব মানুষের পরিমণ্ডলে   তা আমার জানার কথাও নয়    আর আমি লিটারেচারের ছাত্র ছিলাম না  যা পড়েছি সীমিততা নিজের জন্যও নয় পড়ার জন্যও নয় - কেন পড়েছি বলতে পারছি না তার মধ্যে অনেক ভালো লাগা আছে,  অনেক নির্ঘুম রাত অাছেঅনেকটা '  And miles to go before I sleep ’ এর মত  তবে প্রিয় অপ্রিয় বলতে পারব না   এটা আমার মুর্খামি বলুন  সেই কারনে প্রিয় বিদেশী কবির নামও বলা  আমার পক্ষে সম্ভব নয়          


কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: এই বিষয় নিয়ে আমার পড়াশুনা একেবারেই নেই ৷ কার প্রভাব কিসের উপর   আমার  তা জানা  নেইআমার অজ্ঞানতা স্বীকার করছি  


কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল:   প্রকৃত কবি অপ্রকৃত কবি বলে কিছু আছে কিনা এই  ভাবনায় আমি নেইকবি তিনি কবিইতার ভাগ করা যায় না  আর প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার, তার পেছনে  কেউ না কেউ থাকেনই সুতরাং খ্যাতিটা তার শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকেই আসেতারাই  ঠিক করে দেবেন পুরস্কৃত মানুষটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি  দৌড় লাগাবেন প্রতিষ্ঠান জানে না এক জন কবিকে কত সময় নিরন্ন হতে হয়, কত আবর্জনার মাঝে ফুল ফোটাতে হয় সে ফুলের ভাগ প্রতিষ্ঠান কেড়ে নিতে চায়যতই সুন্দর হোক,  যতই  আলো থাকুক,  তিনি কবি, নির্জনতা খুঁজবেনইনাহলে  বেঁচে থাকাটা অসহ্য হয়ে পড়ে              


কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী আপনি?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: মানুষের বেড়ে ওঠার দুটো স্তর। প্রথম হচ্ছে নিজেকে চেনা, সেটা সম্ভব তার নিজস্ব ঐতিহ্য দিয়েসেই চেনাটাই হল নিজের হৃৎপিণ্ডকে চেনা,  নিজের শিরা উপশিরাকে চেনা  তারপরে নিজেকে পৃথিবীর লোক হিসেবে দেখা তখনই তিনি চলে এলেন  আধুনিকতায়সেখানে অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়, মানবিকতায়  আঘাত রোমান্টিকতায় আঘাততরুণ নিজেকে চেনার স্তরটা পার হচ্ছেন স্বাধীন মানুষ প্রথমে নিজেকেই চিনতে পারছেন - তার ভাষার মধ্য দিয়ে, তার মিথের ভিতর দিয়েএই চেনায় যেন আবার ভুল না হয়। আমরা যেন গণ্ডিবদ্ধ না হয়ে যাই। চেনাটাকে যেন আমরা সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি। নিজেদের যেন পৃথিবীর মানুষ হিসেবে চিনতে পারি।  একটা অবক্ষয় চলছে  প্রকট ভাবেএই অস্থিরতায়  কবিতাকে দূরে রাখা উচিত হবে নানিয়ে  আসতে হবে একে বারে মনের কাছেইমানুষের কাছে    


কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন। অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের বিষয়ে যদি বলেন।

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: আমি বিশ্বাস করি লেখাতে' না হয় তুমি দিলে এক মুঠো শিরীষ পাতা, পা ছুঁয়ে / বয়ে যাক জল,   ঝোপের ভিতর লুকিয়ে থাকা অন্ধকার / চোখ মেলে দেখুক  - গত রাতের  কস্তুরী সাপের মৃতদেহ ঝুলে আছে বাবলা গাছের কাঁটায়  '  - এ আমি লিখেছি  আমার এই টানের স্বরূপ বুঝে নিতে চাইছি নিজে নিজেইএর সাথে  বাজার মূল্যের কোন সম্পর্ক নেইআর সম্পর্ক না থাকলে জীবনও নেইকবির মূল্য আলু পটলের মত হতে যাবে কেন? আজ বন্যা হয়েছে তো আলুর  দাম বেড়ে গেলকাল  রোদ হল  তো পটলের দাম কমে গেলএ সবই গমক যদিও বলছি একথা  - তবুও কোথায় যেন মানুষ মানুষ মনে হয় নিজেকে ওই যে 'কী দিলাম  কী পেলাম ' এরূপ একটা সন্ধেতে মনে হয় সত্যি তো, আমার বাজার মূল্য কত?  এই  আর কি  আমার যা নেই,  তার ভালো মন্দ কি করে বলা যায়     


কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে জানতে চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল: পৃথিবীর কোন সম্ভাবনাকে আমি বাদ দিতে রাজি নইসুতরাং বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ  নিয়ে আমার কোনো অনিশ্চয়তা নেই  অনেক ঘাত প্রতিঘাত,  কবিতার নানা বাঁক, ভাষা পরিবর্তন  - এ সব কিছুর মধ্যেই  কবিতাই কেবল ভাবতে শেখায় জীবনকেএই ভাঙচুরের মধ্যে থেকেও কবিতা এক অর্কেস্ট্রা তৈরি করেযার কোনো বিনাশ নেই বাংলা কবিতা জয় করে চলেছে  সময়কে, সময়ের ক্লীবতাকে এক এক সময়তো নিজেকে বড্ড ছোট মনে হয়  আমরা কত সুন্দর করতে পারতাম আমার এই গ্রামকে, আমার এই পৃথিবীকেকিন্তু পারছি কই  এই কষ্টের মাঝে কবিতাই সেই অফুরন্ত কোকিলযে পুকুরের জল ছুঁয়ে দেয়  ধন্যবাদভালো থাকুন